বাংলাদেশের লেখিকা ইফরানা ইকবালের ছোট গল্প “বিভ্রান্তি”

0
1192
Lady with the Lamp by Raja Ravi Varma
Lady with the Lamp by Raja Ravi Varma
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:39 Minute, 51 Second

বাংলাদেশের লেখিকা ইফরানা ইকবালের ছোট গল্প “বিভ্রান্তি”

বিভ্রান্তি

ইফরানা ইকবাল

(১ম পর্ব)

চেয়ারম্যান সাহেবের বাসার ভিতরে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে।

ঠিক ঘরের মাঝখানে একটা তরুণী মেয়ে বুকের সাথে থুতনি লাগিয়ে দাড়িয়ে আছে। মাথায় ওড়না জড়ানো। তার এতটাই লজ্জা লাগছে যে, মনে হচ্ছে মাটি দুই ভাগ হোক আর সে তাতে ঢুকে যাক!!!!

ভিড়ের ভিতর থেকে একজন বলে উঠল, দিনে দুপুরে নষ্টামি চেয়ারম্যান সাব। এইসব সহ্য করা যায় না!! সেগুন কাঠের বড় একটা চেয়ারে একজন বয়স্ক লোক বসে আছেন। হাতে একটা লাঠি, লাঠির মাথায় সিংহের মাথা। বয়স্ক লোকটি সিংহের মাথাটাতে হাতের পাঁচ আঙুল একবার খুলছেন, আরেকবার বন্ধ করছেন। বুঝা যাচ্ছে ইনিই চেয়ারম্যান।

উনি পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমার কি কিছু বলার আছে? এই প্রথম মেয়েটি চোখ তুলে তাকালো। দুই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পরছে মেয়েটির!! আপনি কিছু জানতে চাইলে নিশ্চয় বলব। আস্তে করে উত্তর দেয় মেয়েটা। এত অপূর্ব মায়াকাড়া চেহারা মেয়ে টার! ঘরের ভেতর অনেকের মধ্যে চেয়ারম্যান এর ছেলে নীল ও আছে। পেশায় ডাক্তার। বাইরে থেকে পড়ার ফাঁকে দেশে ফিরেছে।

এই সব শালিশ বিচার তার একদম ই ভাল লাগে না। বাবার আদেশ যে, এগুলো দেখতে হবে, বুঝতে হবে। বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নীল। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে বোকা হয়ে গেল। চেয়ারম্যান সাহেব ওনার পাশের চেয়ারে বসা রহমত সাহেব কে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন যে, এটা কি ঠিক যে তুমি রহমত সাহেবের মেয়ে কে অন্য পাড়ার একটা ছেলের সাথে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছো?

মেয়েটি এক মিনিট চুপ থেকে একটা লম্বা নিঃশাস নেয়, তারপর বলে, জ্বী এটা সত্যি। ঘরের ভিতর একটা তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সবাই একসাথে কথা বলতে থাকে। চেয়ারম্যান সাহেব খুব জোরে ধমক দিয়ে বলেন , এই চুপ সবাই!! মেয়েটি এত জোরে ধমক শুনে চমকে গিয়ে সামনে তাকায়, আর তার চোখা চোখি হয় নীলের সাথে। এই ঘরের সমস্ত মানুষের চোখে তার প্রতি সকল ঘৃণা কে উপেক্ষা করে পরম মমতা ভরা চোখে একটা ছেলে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যে দৃষ্টি কে উপেক্ষা করা যায়না ……….

২য় পর্ব)
তোমার নাম কি? চেয়ারম্যান সাহেব প্রশ্ন করেন। আমার নাম জোনাকি । মেয়েটি উত্তর দেয়।

নীল মনে মনে ভাবে, আওড়ায় “জোনাকি” চেয়ারম্যান সাহেব বলেন, তুমি এই কাজটা কেন করলা? তুমি তো জানতে যে, রহমত ভাই এর মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে!! কি যেন নাম মেয়েটির?

রহমত সাহেব পাশ থেকে উত্তর দেন আমার মাইয়ার নাম “মায়া’। চাইর দিন পর বিয়া হওয়ার কথা আছিল।

জোনাকি চোখ তুলে তাকায়। মায়া আমার বান্ধবী। একসাথে পড়াশুনা শেষ করেছি আমরা। ওর থেকে ২০ বছরের বড় একজনের সাথে বিয়ে দেয়া হচ্ছিল। আমরা প্রাপ্ত বয়স্কা। এটাতো আইনত দণ্ডনীয়!! আর মায়া যার সাথে চলে গেছে তাকে ও ভালবাসে!! চেয়ারম্যান সাহেব এর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। নাউযুবিল্লাহ্!! কতত বড় বেয়াদদব মেয়ে- ছেলে দেখছেন চেয়ারম্যান সাহেব?! রহমতসাহেব বলে উঠলেন।

তুমি কি আমাকে এখন আইন শিখাবে মেয়ে? চেয়ারম্যান সাহেব প্রশ্ন করলেন।

জোনাকি চুপ করে থাকে। আমার মেয়ে কখনোই এই বিয়েতে আপত্তি করে নাই! মায়া আমাকে বলেছে যে আপনার কথার বাইরে গেলেই আপনি দা হাতে নিয়ে দৌড়ান!! তাই ও আপনাকে কিছু বলেনি।

রহমত সাহেব থতমত খেয়ে গেল। নীল মনে মনে হাসলো। মেয়েটির সাহস দেখে সত্যিই মুগ্ধ হচ্ছে।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন একজন বাবা মায়ের থেকে বেশী তার সন্তানের ভাল কেউ চায়না। তুমি কতটুকু একটা মেয়ে এত বড় বড় কথা বলছো!! আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তুমি মায়া আর ওই বদমাইশ ছেলেকে আমার সামনে এনে দাড়ঁ করাবা! নাহলে আমাকে তোমার ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে !!

জোনাকি চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আজকের মত আপনারা সবাই আসুন। একে একে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। জোনাকি হালকা পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে নদীর ঘাটের দিকে। ওর মন খুব অস্থির হয়ে আছে!! ধুপকাঠি (কাল্পনিক নাম) গ্রাম হলেও এটা সদর গ্রাম। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আছে। মোটামুটি শিক্ষিত এলাকা। সন্ধার আগে আগে এই সময়টা বড় ভাল লাগে জোনাকির। আকাশটা কেমন কনে দেখা আলোয় জড়িয়ে যায়।

বাসন্তী-লালচে আলো এসে পরে জোনাকির মুখে। ও জানেও না কেউ একজন ওকে অনুসরন করছে। জোনাকি বাসা থেকে থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই নীল ওর পিছনে হাঁটতে শুরু করে একটু দুরত্ব রেখে। শেষ বিকেলের আলো মেয়েটার মুখে পরেছে। নতুন বউয়ের মত লাগছে দেখতে।

ঘাটে গিয়ে বসে জোনাকি। চিন্তা করতে থাকে মায়ার কথা। পালিয়ে যাওয়ার সময় খুব কাঁদছিল মেয়েটা। বলছিল বার বার যে তুই যদি ধরা পরিস অনেক বড় বিপদে পরবি। আর তাই হল!! ওদের নদীর ঘাটে পার করে দেয়ার সময় মায়ার ভাই দেখে ফেলে।

কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর কথাটা জানলে কি হবে? মায়া যে ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে সে ছেলেটার পরিচয় যখন সামনে আসবে!!! হঠাৎ একটা খসখস শব্দে চমকে তাকায় জোনাকি। চেয়ারম্যান সাহেবের নিজস্ব কাজের ছেলেটা এগিয়ে আসছে ওর দিকে। নীল মাত্র পা বাড়াতে যাচ্ছিল জোনাকির দিকে। তখনি নীল চমকে উঠল। একি! বাবার কাজের ছেলে রতন কি করছে এখানে!! নীল দাঁড়িয়ে যায়।

জোনাকি উঠে দাঁড়ালো। ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর হাতে এক টুকরো কাগজ দিয়ে বলে , “চেয়ারম্যান সাহেব দিছেন”। বলেই লম্বা পায়ে হাঁটা দেয়। জোনাকি বোকার মত তাকিয়ে থাকে। মাগরিবের আযান দিচ্ছে। আকাশে হালকা মেঘ করেছে। বাড়ি ফিরতে হবে। জোনাকি হাতের কাগজটা খুলবে কিনা ভাবছে। তখনি ওর দৃষ্টি একটু দুরে ঘন ঝাড় এর দিকে যায়। কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। একটু ভাল করে খেয়াল করে দেখার চেষ্টা করে জোনাকি।

একি!! এতো চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে। এখানে কি করছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই ছেলের মুখোমুখি হওয়া যাবেনা এখন। কোনো ভাবেই না। ওড়না টা মাথায় ভাল ভাবে জড়িয়ে কাগজটা হাতের মুঠোয় নিয়ে দৌড় দেয় জোনাকি। ইশ! বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। নীল অবাক হয়ে দেখে জোনাকি দৌড়াচ্ছে। নীল ও দৌড়ানো শুরু করে।

সাহস করে ডাক দেয়, “জোনাকি শুনুন ” জোনাকি দাঁড়ায় না। হঠাৎ ধড়াম করে একটা শব্দ শুনে পিছনে তাকায়। ছেলে টা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। হাঁটু চেপে বসে আছে। কি করব এখন? নিজকে প্রশ্ন করে জোনাকি। চলে যাব? নাকি সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যাব?

(৩য় পর্ব)

এক সেকেন্ড চিন্তা করল জোনাকি। কাগজটাকে ওড়নায় গিট দিয়ে, এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, উঠে আসুন। বৃষ্টির ছাট অনেক জোরে হচ্ছে। নীল তাকালো চোখ তুলে। জোনাকির গাল বেয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পরছে। নীল তাকিয়েই রইল। যেন একটা ভেজা শাপলা।

আরে কি আশ্চর্য, তাকিয়ে আছেন কেন?? আসুন!! বলল, জোনাকি। তাড়াতাড়ি ওর হাত টা ধরল নীল। জোনাকির হাতে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটতে শুরু করল। বেশি লেগেছে? জোনাকি প্রশ্ন করল।

না, একটু মোচড় লেগেছে। উত্তর দিল নীল। কেমন যেন ঘোরের ভিতর চলে যাচ্ছে নীল। এটা সত্যি ঘটছে নাকি কোনো স্বপ্ন দৃশ্য !?

জোনাকির কোমল হাতের ভিতর ওর হাত। অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে। বড় একটা বট গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো দুই জন। জোনাকি হাঁটু গেড়ে বসল মাটিতে। আরে আরে কি করছেন, নীল প্রশ্ন করল। চুপচাপ দাঁড়ান। বলেই খুব পারদর্শী হাতে নীলের পায়ের গোড়ালি তে একটা চাপ দেয় জোনাকি। উফ! করে উঠে নীল।

এখন কি ঠিক আছে? নীল বলে,’ হ্যা ঠিক আছে।’ এখন বলেন তো, আপনার বিষয় টা কি? জ্বি আমার নাম নীল। আমি জানি, আপনি চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে। পেশায় ডাক্তার। কিন্তু আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন? নীলের পুরো মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। কি বলবে সে? নিজেইতো জানেনা।

জোনাকি শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আমার খুবই ঠান্ডা লাগছে। বলল নীল। জোনাকি বলল ভেজা শরীরে অনেক সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তাই। বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে এখন বাসায় চলে যান। আমি আসি। এটা বলেই হাঁটতে শুরু করে জোনাকি।

আমাদের কাজের ছেলে রতন আপনাকে কি বলছিল? পিছন থেকে প্রশ্ন করে নীল। থমকে দাঁড়িয়ে পিছনে না তাকিয়েই উত্তর দেয় জোনাকি ” কিছু না “। বলেই হেঁটে যায় সামনের দিকে। অন্ধকার নেমে এসেছে। ওর হাঁটার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে নীল। ভেজা ওড়না থেকে পানি নিংড়াতে নিংড়াতে ঘরে ঢুকে জোনাকি।

জোনাকি একি অবস্থা তর??!! পুরো তো কাক ভেজা হ‌ইয়া গেছস। মা বলে উঠে। আর কি শুনতাছি আমি এইসব?? তোরে নিয়ে নাকি শালিস বসছে?? আমারে কি একটু বাঁচতে দিবি না??

আমি কোনো ভুল করিনি মা! জোনাকি তোর সবটাই ভুল!! একে তো নার্সিং এর উপর পড়াশুনা করছিস। যা নিয়ে পাড়ার লোকে দুনিয়ার কথা বলতেছে। সেবিকা!! আর এখন হ‌ইছিস বিপ্লবি নেত্রী!! এইসব চেয়ারম্যান গো লগে তুই টেক্কা দিয়া পারবি??

জোনাকি কোনো উত্তর না দিয়ে আস্তে করে ওর ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। ভেজা কাপড় গুলো বদলাতে হবে। পায়ের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে জোনাকি এক পায়ের নূপুর টা নেই!! রূপার নূপুর জোড়া ছিল। কোথায় পড়ল কে জানে! একটু অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ারম্যান এর ছেলের কথা ভাবতে থাকে জোনাকি। কি চায় ছেলেটা ওর কাছে? নাকি বাপ-ছেলে মিলে কোনো খেলা খেলছে ওর সাথে? কিন্তু ছেলে টার চোখের দৃষ্টি তো তা বলেনা। এক অদ্ভুত মায়া চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ডাক্তার ছেলে। বাইরে থেকে পড়াশুনা করে এসেছে। কি চায় ওর কাছে।

এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ওড়নার খুঁটি তে চোখ পড়ে ওর। চেয়ারম্যান সাহেব যেটা দিয়েছেন। তাড়াতাড়ি গিট খুলে কাগজটা বের করে, অনেক টাই ভিজে গেছে। খুব সাবধানে কাগজ টার ভাঁজ টা খুলে। বৃষ্টির পানিতে কালি ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু পড়া যাচ্ছে। “আগামীকাল ঠিক বিকাল ৪.০০ টায় আমার দপ্তরে দেখা কর” ।

জোনাকি বোকার মত তাকিয়ে থাকে। ঘটনা টা কি? কি করবে ও এখন? নদীর ঘাটের পাশ দিয়ে হাঁটছে জোনাকি খোলা চুলে। বাতাসে চুল উড়ছে। ওর পরনে সিঁদুর লাল রঙের শাড়ি। হঠাৎ অনেক জোরে বাতাস শুরু হয়।

“জোনাকি আমি এসেছি। ” বাতাসের সাথে ধুলো উড়ছে। জোনাকি ভাল মত তাকাতে পারছেনা। কোনো মতে তাকিয়ে দেখলো যে, নীল দাঁড়িয়ে আছে হাসি মুখে। আর তার পর পর ই ওর লাল রঙের শাড়ি রক্ত হয়ে ঝরতে শুরু করলো। জোনাকি চিৎকার করে সামনে তাকিয়ে দেখে নীলের সাদা পাঞ্জাবি রক্তে লাল হয়ে গেছে। নীল পড়ে আছে মাটিতে আর জোনাকির শাড়ি ধবধবে সাদা হয়ে আছে। ধরমড়িয়ে বিছানায় উঠে বসল জোনাকি।

অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে যে, ও স্বপ্ন দেখছিল। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কি স্বপ্ন দেখল এটা?! তাহলে কি খুব ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে??!! সকাল থেকেই মেডিকেলে আজকে অনেক কাজ জোনাকির। দম নেয়ারি সুযোগ পাচ্ছে না। বার বার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ৪ টায় দেখা করতে হবে চেয়ারম্যান এর সাথে। কিন্তু এখনো বুঝতে পারছেনা যাবে কিনা। অবশেষে ৩.৩০ এ বের হল কাজ শেষ করে।

হাঁটতে শুরু করল আর অনেক হাবিজাবি ভাবনা ঘুরতে থাকল মাথায়। ঠিক ৪.০০ টায় চেয়ারম্যান সাহেব এর দপ্তর অফিসের বাইরে এসে দাঁড়ায় জোনাকি। দরজায় আলতো করে টোকা দিতেই , রতন হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসে। জোনাকির সামনে এক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর হাতে রুমালে জড়ানো শক্ত কিছু একটা গুজে দিয়ে দ্রুত চলে যায়। জোনাকি অবাক হয়ে যায়। আর হাতের রুমাল টার ভিতর তাকিয়ে দেখে , একটা ছোট ধারালো খুর!! স্তব্ধ হয়ে যায় জোনাকি।খুর দেয়ার মানে কি!!!!

জোনাকি বাইরে থেকে প্রশ্ন করে, আসবো? চেয়ারম্যান সাহেব উত্তর দেয়, এসো। জোনাকি ভিতরে যায়। চেয়ারম্যান সাহেব একটা বড় টেবিলের ওই পাশে বসে আছেন একটা চেয়ারে। আর এই পাশে দুটো চেয়ার। বসো জোনাকি। জোনাকি দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু খাবা? ঠান্ডা? গরম? জি না। ধন্যবাদ বলে জোনাকি।

তোমার আব্বা খুব ভাল মানুষ ছিলেন। পেশায় স্কুল এর শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু সৎ ছিলেন অতিরিক্ত বেশি। পাগল পদের ছিলেন। প্রকৃতি প্রেমি। বনে বাদারে চলে যাইতেন। আমি তারে পাগলা মাস্টার ডাকতাম।

জি আমি জানি। উত্তর দিল জোনাকি। মনে মনে ভাবে, কি বলতে চান চেয়ারম্যান সাহেব? শেষ বার পূর্নিমা দেখতে বনে গিয়া লাশ হয়ে ফিরল লোকটা। জোনাকির মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ অতীতটা সে ভুলে থাকতে চেষ্টা করে। ওনার মৃত্যুর রহস্য কিন্তু উদ্ধার করা যায় নাই। তোমার জানতে মন চায় না তোমার আব্বা কিভাবে মারা গেছেন??!!!!

জোনাকি প্রচন্ড চমকে উঠল। চেয়ার এর হাতল টা চেপে ধরল। দুই বছর আগের সেই ভয়ংকর দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। সব চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।

শেষ পর্ব)

বাবা যখন তখন বনে- জঙ্গলে চলে যেতেন। কখনো চাঁদ দেখতে, কখনো এমনি ই প্রকৃতি দেখতে। দু’বছর আগে পূর্নিমা দেখতে বনে গিয়েছিলেন, কিন্তু দুইদিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। শরীরে কোনো ক্ষত চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

কিন্তু লাশ টাকে পরীক্ষা ও করতে দেননি তখন চেয়ারম্যান সাহেব। বলেছিলেন কি দরকার কাঁটা ছেড়া করার?! খুব দ্রুত বাবার দাফন করানো হয়ে গিয়েছিল।

জোনাকির মাথা ঘুরছে। তার মানে কি এর মধ্যে খুব বড় কোনো রহস্য ছিল?! জোনাকি চেয়ারম্যান এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি জানেন আমার বাবার মৃত্যুর রহস্য?

মুচকি একটা হাসি দেন চেয়ারম্যান। জোনাকি শুনো, তোমাকে এখানে ডাকার কারনটা এখন বলি। তোমার আব্বার স্কুলটা যে জমিটার উপর ওই জমিটা আমি অনেক বার তোমার আব্বার কাছে চাইছি। আমি তারে বহু বার বলছি যে আমি জমিটা কিনবো, যত টাকা লাগে দিব । তোমার স্কুল ও থাকবে। তুমি বেতন ও পাবা। শুধু আমার অধীনে সব থাকবে। কিন্তু তোমার আব্বা কিছুতেই তা মানতে রাজি হয় নাই। এখন দেখ তোমার মা আর তুমি দুইজন মহিলা মানুষ। একজন তো মাথার উপরে থাকতে হয়। তুমি স্কুল ঘরের জমিটা আমার কাছে বেঁচে দেও।

প্রচন্ড চমকে উঠল জোনাকি। কি বলেছেন আপনি?! ওই স্কুল ঘরটা বাবার স্বপ্ন। আমাদের তো ওই জায়গা টুকুই শুধু আছে!! ওই জায়গা আমরা কেন বেঁচবা?

চেয়ারম্যান খুব জোরে হেসে উঠে। কেন বেচঁবা? উঠে দাঁড়ায় চেয়ারম্যান।

জোনাকির খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। অসসস্তি হয় জোনাকির। ফিসফিস করে তিনি বলেন, রহমত সাহেবের মেয়ে মায়ার প্রেমিকের নাম তো “ডেভিড” তাইনা?? সেতো খৃষ্টান!!!!

১০০০ ভোল্টের ইলেকট্রিক শক লাগে জোনাকির। উনি এটা কি করে জানলেন?মায়া যে একটা খৃষ্টান ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে!!!

কিছু বুঝে ওঠার আগেই চেয়ারম্যান সাহেব জোনাকির কোমরের পিছনে ধরে হেচকা টান দিয়ে বললেন, ডেভিড ছেলেটা তো খৃষ্টান!! আর মায়া হইল মুসলমান। এই কথাটা এখনো কেউ জানে না!! জোনাকি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা ধাক্কা দেয় চেয়ারম্যান সাহেব কে। হাতের ভিতরে থাকা খুর টা শক্ত করে চেপে ধরে। রতন কেন খুর টা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল বুঝতে পারে। এই ধরনের ঘটনা আরো অনেক বার নিশ্চই ঘটেছে এই ঘরে! তাই রতন, জোনাকি যাতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে তাই খুরটা দিয়েছিল!

চেয়ারম্যান সাহেব প্রচন্ড রাগে কাঁপতে লাগল। তুমি আমাকে ধাক্কা দিলা? জি আমি ধাক্কা দিলাম কারন আপনি অশোভন আচরণ করেছেন।

শোনো জোনাকি! তোমার হাতে একটা রাস্তাই খোলা আছে! স্কুল ঘরটা আমাকে দিয়ে দাও! নাহলে রহমতের মেয়ে মায়ার আর ওর খৃষ্টান প্রেমিক কোথায় আছে আমি জানি। তাদের তো চরম পরিণতি হবেই!! সেই সাথে তোমাকেও পুরা গ্রাম বাসি একঘরে কইরা দিবে। গ্রাম ছাড়াও করতে পারে, কারন তুমি সব জাইনা তাদেরকে সাহায্য করছো! এখন তুমি ভাইবা দেখ কি করবা!!

জোনাকি শক্ত গলায় জবাব দিল, আমি ওই জমি দিব না। বলেই দ্রুত বের হয়ে গেল।

এলাকার স্থানীয় কলিম চাচার বাসায় গিয়েছিল নীল। ওনার মেয়ের ঘরের নাতিটার ভিষণ জ্বর। নীল ভাল মত দেখে ঔষধ দিয়ে দিল। ওখান থেকে বেরিয়ে কিছু দুর এগোতেই দেখল জোনাকি হেঁটে যাচ্ছে।

কিন্তু মেয়েটা অমন টলছে কেন?! দেখে মনে হচ্ছে পুরো ঘোরের মধ্যে আছে। জোনাকি হাঁটতে পারছেনা! প্রচন্ড মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে বমি করে দিবে। হঠাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মূহুর্তে শুধু টের পেলো কেউ একজন ওকে ধরে ফেলেছে।

স্কুল ঘরের বাইরে বসে জোনাকি কড়ি খেলছে। ভিতর থেকে বাবার শব্দ আসছে পড়ানোর, তিন দুগুনি ছয়, তিন তিরিকে নয়… জোনাকি , আম্মা পড়বা না? জোনাকি ঘুরে তাকায়। আব্বা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি খেললে হবে? অনেক বড় হইতে হবে গো আম্মা। আর সততার পথে চলতে হবে। ন্যায় এর পথে। নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিবানা কোনোদিন……… “

জোনাকি, জোনাকি মা চোখ মেইলা তাকা, কি হইছে তর? আস্তে আস্তে চোখ খুলে জোনাকি। ওর ঠিক সামনেই ওর মা। পাশে নীল আর আরো দু চার জন এলাকার স্থানীয় লোক। চেয়ারম্যান সাহেবের পোলা আজকা না থাকলে খুব বিপদ হইতো! জোনাকি চুপ করে থাকে। তুই অজ্ঞান হয়া গেছিলি। উনি আর দুই চারজন মিলা তরে নিআসছে। উনিই তর জ্ঞান ফিরাইছে। আস্তে আস্তে ঘর থেকে সবাই চলে যায়। জোনাকি নীল আর ওর মা থাকে। বাজান তোমারে একটু শরবত কইরা দেই। না না ব্যস্ত হবেন না। বলে নীল। জোনাকির মা চলে যায় শরবত বানাতে। জোনাকির প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। এই ছেলেটা ওকে বাসায় নিয়ে এসেছে।

আপনার আসলে কি হয়েছিল জোনাকি? আর আপনার হাতের মুঠোয় একটা ধারালো খুর ও ছিল। আপনার টেবিলের উপর রেখেছি খুরটা। কিছু না জোনাকি জবাব দেয়। আমাকে বলেন। আমি সাহায্য করতে পারবো।

জোনাকি হেসে উঠে। হাসছেন যে? আপনি একমাত্র মানুষ যিনি আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না। বলে জোনাকি।

মানে??!! কেন?? অবাক হয় নীল। জোনাকি মনে মনে বলে, আপনি নিজের বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবেন না।

জোনাকি? আবারো ডাকে নীল। দেখেন এসব ঝামেলায় আপনার না জড়ানোই ভাল। বলে উঠতে যায় জোনাকি।

তখন নীল বলে , আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছিলাম। ভেবেছিলাম যখনি দেখা হবে দিব। জোনাকি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নীল ওর কাঁধের ঝোলা থেকে একটা কালো কাপড়ে মোড়ানো বড় কিছু একটা বের করে জোনাকির হাতে দেয়। কি এটা , বলে জোনাকি খুলতে যায়। নীল ওর হাত ধরে বাঁধা দেয়। ‘না’ না এখন না। রাতে দেখবেন। একদম নিকষ অন্ধকারে। জোনাকির হাতটা ছুঁয়েই থাকে নীল। জোনাকি আস্তে করে হাতটা সরিয়ে নেয়।

আপনি আমাকে এড়িয়ে যান কেন সবসময়? জোনাকি একটা নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দেয়, আমার অবস্থানে দাঁড়িয়ে আপনিও এটাই করতেন যা আমি করছি।

জোনাকির মা শরবত আর মুড়ি বাতাসা নিয়ে ঘরে ঢুকে। জোনাকি চট করে ওড়না দিয়ে নীলের দেয়া জিনিসটা ঢেকে ফেলে।

নীলের চোখ এড়ায়না বিষয়টা। কেন যেন খুব ভাল লাগে নীলের। মনে হয় যেন জোনাকি ওকেই লুকিয়ে ফেলছে ওর আঁচলের নিচে !!

সেদিন রাত বেশ গভীর হলে জোনাকি ওদের উঠোনে কদম গাছের তলায় এসে বসে। নীলের দেয়া জিনিসটার থেকে কাপড়টা সরায়। একটা বড় কাঁচের সাদা জার। যার ভিতরে ছোট ছোট হাজার হাজার কি যেন জ্বলছে নিভছে। জোনাকি হতভম্ব হয়ে দেখে জারের ভিতরে অসংখ্য জোনাকি পোকা। অন্ধকারে জ্বলছে নিভছে। জারের মুখটা আস্তে করে খুলে দেয় জোনাকি।

জোনাকির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। নদীর ঢেউয়ের মত একসারিতে এগিয়ে যেতে থাকে জোনাকি গুলো। জ্বলছে নিভছে। সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে নীলকে উদ্দেশ্য করে বলে জোনাকি, আপনি ভুল মানুষ কে ভুল উপহার দিলেন। এতত সুন্দর কিছুর যোগ্য আমি নই।

পরদিন সকালে অনেক হট্টগোলের শব্দে জোনাকির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসল জোনাকি। ওর মা ছুটে এসে বলল, অই জোনাকি মায়ারে তুইলা নিয়াসছে চেয়ারম্যান সাহেব এর লোকজন বর্ডার এর ওইখান থেইকা। কি সর্বনাশা কান্ড! মায়া নাকি একটা খৃষ্টান পুলার লগে পলায়ে গেছিল!!

জোনাকির মুখ থেকে রক্ত সরে যায়। ছেলেটাকেও কি ধরে ফেলছে? পোলাডা মায়ার লগেই আছিল। মায়ারে ধইরা আনছে । আর পোলাডারে এইখানে আনে নাই।

মায়া খালি পায়ে ছুটতে শুরু করল, চেয়ারম্যান এর দপ্তরের দিকে। ওখানে অনেক মানুষ। মাঝখানে মাটিতে বসে আছে মায়া। মেয়েটাকে অনেক মেরেছে। ঠোঁট ফুলে পাশ কেটে রক্ত ঝরছে। জোনাকি ছুটে গিয়ে মায়ার পাশে বসে মায়ার গায়ে হাত রাখে।

ওই দেখেন, আরেক বদমাইশ আইসা হাজির হইছে! রহমত মিয়া চিৎকার দিয়া বলে , অই জোনাকি তুই জানতি যে, মায়ার লগের পোলাডা খৃষ্টান আছিল?

জোনাকি কোনো উত্তর দেয়ার আগেই মায়া বলে উঠল, না না এইটা জোনাকি জানতো না। জোনাকি বুঝতে পারে যে, মায়া তাকে বাঁচাতে চাইছে! চেয়ারম্যান বলে। থামো রহমত! মায়া মেয়েটা আমাগো। অরে তো আর পানিতে ফালায় দেয়ন যায় না! ভুল একটা করছে ঠিক। মেয়েরে আগে বাড়িত নিয়া যাও। খাওয়াও কিছু। শালিস হইবো পরে।

ঘরের ভেতর নীল ও ছিল। এই প্রথম সে কথা বলে। এখানে কি শালিস হবে , বাবা? আর এই মেয়েটাকে এইভাবে মারলো কেন? মায়া তো প্রাপ্ত বয়স্কা একটা মেয়ে। ওর জীবনের সিদ্ধান্ত তো ও নিজে নিবে।

তুমি থামো নীল এটা তোমার বিলাত না। এইটা গ্রাম এলাকা। এখানে গুরু জনদের কথাই শেষ কথা! নীল বুঝে যে, ও কিছু বলেও আর লাভ হবেনা। আস্তে আস্তে ঘর খালি হতে থাকে। মায়াকে ধরাধরি করে ওদের বাড়ি নিয়ে যায় রহমত চাচা।

সেদিন বিকেলে পাশের বাড়ির মেয়ে খুকু ছুটতে ছুটতে মায়ার কাছে আসলো, হাপাতে হাঁপাতে বললো, জোনাকি আপা তাড়াতাড়ি নদীর ঘাটে চল!! বলেই ছুটে চলে গেল। এই খুকু কি হইছে দাড়া! জোনাকি ও ওর পিছনে পিছনে ছুটতে থাকে। নদীর ঘাটে পৌঁছে দেখে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে । ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে যা দেখলো জোনাকি তার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিল না!! মায়ার প্রেমিক ডেভিড পড়ে আছে! পেটে ছুরি বসানো। শরিরের বিভিন্ন অংশে ছুরি দিয়ে মারা হয়েছে। রক্ত গড়িয়ে নদীর পানি তে মিশেছে অনেক খানি।

জোনাকি ধপাস করে মাটিতে বসে পরলো। ও কান দিয়ে কোনো শব্দ শুনতে পারছিল না!! কতক্ষণ এভাবে ছিল ও জানেনা। নীল ওকে ধরে ঝাঁকি দিচ্ছিল জোরে জোরে। অনেকের মাঝে নিল ও ছিল। জোনাকি খেয়াল করেনি। জোনাকি, জোনাকি আপনি কি এই ছেলেটাকে চিনেন?

জোনাকি ঘোলা চোখে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলে , ও ডেভিড। মায়া যার সাথে পালিয়ে গিয়েছিল! নীল প্রচন্ড চমকে যায়। আর তারপরই দৌড়াতে শুরু করে মায়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে। মায়াকে খবর দেয়ার সাথে সাথেই মায়া অজ্ঞান হয়ে যায়! জ্ঞান ফিরার পর বার বার বলে যে, একটা বার যেন ডেভিডের লাশ টা তাকে দেখতে দেয়া হয় কিন্তু ওর বাবা ওকে বেঁধে রাখে । ওর মা ওকে এক ভাবে চড়াতে থাকে। অসভ্য , কলংকিনি মাইয়া! আইজ থিকা তিন দিন বাদে তোমার বিয়া!! তোমার বাপ যার লগে তোমার বিয়া ঠিক করছিল, তার লগে!! তুমি তো অহন কারো পাতে পরনের যোগ্যি না! এতো চেয়ারম্যান সাবের দয়া যে, উনি হাতে ধইরা পয়সা দিয়া এই বিয়ার আবার ব্যবস্থা করছেন!অসভ্য কূলাটা মাইয়া।

এরপর দুঃস্বপ্নের মতো তিনটা দিন যায়। চেয়ারম্যান সাহেব তার অতি চিকন বুদ্ধি দিয়ে সব দিক সামলে ফেলেন। জোনাকির বাবার মৃত্যুর মত ডেভিডের মৃত্যুটাও অমিমাংসিত ভাবেই লাশের সৎকার হয়ে যায়। জোনাকি স্তব্ধ হয়ে থাকে। আজ মায়ার বিয়ে। জোনাকি, মায়ার পাশে বসে আছে। মায়া বোবার মত বসে আছে। হলুদ শাড়ি পড়ানো হয়েছে মেয়ে টাকে। সারা গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে গোসল করানো হয়েছে। খালা চাচিদের মুখ বন্ধ নেই। ফিসফাস করছে তারা সমানে। জোনাকি মায়ার গায়ে হাত রাখে। মায়ার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পরছে। আজ রাতে মায়ার বিয়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল এর দিকে ঘর ফাঁকা হতে লাগলো।

মায়া জোনাকি কে বলে , আমাকে একটূ একা থাকতে দে। আমি একটু ঘুমাবো। ঠিক আছে আমি সন্ধায় আসবো। তোকে সাজিয়ে দিব। বলেই জোনাকি ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মায়া দরজা টা ভিড়িয়ে দেয়। জোনাকি নদীর ঘাটে এসে বসে থাকে। কিছুক্ষণ হাটে। মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। অনেক্ষণ এভাবে বসে থাকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। যখন ভাবে যে মায়ার বাসায় যাবে, ঠিক তখন নীল হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়ায়।

জোনাকি আপনি এখানে?? কেন কি হয়েছে?? খুব খারাপ একটা খবর আছে!! তাড়াতাড়ি চলুন। নীল জোনাকির হাত ধরে ছুটতে থাকে। মায়ার বাসার উঠোন। অনেক লোক। মায়ার ঘরের ভেতর থেকে ওর মায়ের চিৎকার শুনা যাচ্ছে। ছুটে গিয়ে দাঁড়ায় জোনাকি ওর ঘরে। লাল টুকটুকে বেনারশি পরে পায়ে আলতা লাগিয়ে মায়া সিলিং ফ্যানে ঝুলছে!!!! ওর বাঁ হাতের তালু তে কলম দিয়ে লেখা— “আমি বাঁচতে চাইছিলাম, কিন্তু এরা দিলনা! তুই এদের ছাড়িস না”!!!! জোনাকি ছুটে বের হয়ে নিজের বাসায় চলে যায়।

নীল কিছু বলেনা। শুধু তাকিয়ে থাকে। জোনাকি নিজের ঘরে ঢুকে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে জ্ঞান হারায়। এরপরের একটা দিন কিভাবে রায় জোনাকি বলতে পারেনা। বিছানায় পরে থাকে।

তার এক দিন পর রতন এসে জোনাকির হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলে যে, চেয়ারম্যান সাহেব দিছেন। আর জোনাকির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, হার মাইনেন না আফা!! বলেই চলে যায়।

কাগজে লেখা “আমার সর্ত মাইনা নেও, একটা আঁচড় ও পরবেনা তাইলে তোমার গায়ে। আর না মানলে . ……” জোনাকি একটা লম্বা নিঃশাস নেয়। তার দুই দিন পর। নীল নদীর ঘাটে পায়চারি করছে। বিকাল প্রায় ৫টা বাজে। জোনাকি চিঠি পাঠিয়েছে , দেখা করতে চায়।

অপেক্ষা করছে নীল। খামের ভিতর অনেক গুলো কদম ফুলের পাপড়ি। বিশেষ কিছু কি বলবে জোনাকি? যা সে শুনতে চায়? জোনাকি লাল একটা শাড়ি পড়েছে। কপালে লাল টিপ। চোখে মোটা করে কাজল দিয়েছে। আয়নায় তাকিয়ে ভাবলো জোনাকি, আমাকে দেখতে এত সুন্দর?! মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়ায় জোনাকি। মা ঘুমোচ্ছে।

খুব সাবধানে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে যাতে মার ঘুম না ভাঙ্গে। আর মনে মনে বলে, অনেক বড় একটা কাজ করতে যাচ্ছি দোয়া কইরো মা! টেবিলের উপর থেকে রতনের দেয়া খুর টা আঁচলের নিচে কোমরে ভাল করে গুজে নেয়। নীল ওর জন্য নদীর ঘাটে অপেক্ষা করছে। মনে মনে ভেবে মুচকি হাসে জোনাকি। কদম গাছের দুটো কদম ফুল খোঁপায় গুঁজে নেয়। তার পর হাঁটতে শুরু করে।

চেয়ারম্যান নতুন পাঞ্জাবি পরে গায়ে আতর মেখে বসে আছে। জোনাকি চিঠি দিয়ে রতনের কাছে যে , সে চেয়ারম্যান এর সব সর্তে রাজি। দেখা করতে আসতেছে।

জোনাকি চেয়ারম্যান এর বাড়ির নিচে এসে দাঁড়ালো। রতন কে দেখতে পায় । জোনাকি ইশারা করতেই রতন সরে যায়। সন্ধা ৬ টার মত বাজে। চেয়ারম্যান এর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শেষ বার জোনাকি তার বাবা , ডেভিড আর মায়ার কথা ভাবে। মায়ার বাঁ হাতের তালু তে কলম দিয়ে লেখা— “আমি বাঁচতে চাইছিলাম, কিন্তু এরা দিলনা! তুই এদের ছাড়িস না”!!!!

লম্বা দম নিয়ে চেয়ারম্যান এর ঘরের ভেতর ঢুকে যায় জোনাকি। এর দুই ঘন্টা পর । চেয়ারম্যান সাহেব এর বাসার বাইরে পুলিশের গাড়ি।

চেয়ারম্যান এর লাশ বের করা হইছে। জোনাকির কোমরে হাতে দড়ি দিয়ে বাঁধা। খবর পেয়ে নীল , জোনাকির মা ছুটে আসছে। এক ভাবে কেঁদে যাচ্ছে জোনাকির মা। নীল দাঁড়ায় জোনাকির সামনে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জোনাকির দিকে।।

নীলের হাতের মুঠোয় জোনাকির হারিয়ে যাওয়া নূপুর টা। বৃষ্টি তে ভেজার দিন জোনাকির পা থেকে খুলে পরে গিয়েছিল। ভেবেছিল আজ সরিয়ে দিবে। কেন জোনাকি, কেন??? কেন করলা এটা তুমি?? জোনাকি উত্তর দেয় “নিয়তি” পুলিশ তাড়া দেয়। জোনাকি ওর মাথা থেকে কদম ফুল দুটো খুলে নীল এর দিকে বাড়িয়ে দেয়। নীল ফুল দুটো নিয়ে জোনাকির হাত ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে।

পুলিশ টানতে টানতে জোনাকি কে গাড়িতে তুলে। গাড়ি এগিয়ে যায়। রাত বাড়ছে। গ্রামের রাস্তার পাশে একটা কদম গাছের দিকে চোখ পরে জোনাকির। সার বেঁধে অনেক গুলো জোনাকি গাছ বেয়ে উঠছে। জ্বলছে নিভছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল জোনাকি। মনে মনে ভাবলো, আচ্ছা এই জোনাকি পোকা গুলো কি সেই জোনাকি পোকা, যেগুলো নীল তাকে দিয়েছিল??

সমাপ্ত

ইফরানা ইকবাল
ইফরানা ইকবাল

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD