“সা বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেতুভূতা সনাতনী।”
ড. রঘুপতি সারেঙ্গী
মা-দুর্গার পুজো ছেড়েই দিন, শক্তি-সাধনা বা তন্ত্র-মতে যে কোনো ক্রিয়া-কর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ চণ্ডীপাঠ। মার্কণ্ডেয় পুরাণের
৮১- ৯৩ নং পর্যন্ত এই ১৩ টি অধ্যায়ে, সাকুল্যে ৭০০ টি মন্ত্র নিয়ে শ্রী শ্রী চণ্ডী। তাই চণ্ডী’র আর এক নাম “সপ্ত-শতী”। এর প্রতি টি মন্ত্রই সিদ্ধ এবং আহুতি প্রদানের যোগ্য।
এটি সংস্কৃতে লিখা হলেও এর অর্থ বুঝতে বিশেষ অসুবিধে হয় না। বেদ এর মতো আপাত-দুর্বোধ্য অবশ্যই নয়। কাহিনীর ঘন-ঘটা নেই। মহাভারতের মতো অসংখ্য চরিত্রের আনাগোনাও নেই এতে। সাবলীল সংলাপে দেবী’র স্তুতি ই প্রাধান্য পেয়েছে এখানে এর। ‘স্তুতি’ মানে কিন্তু স্তাবকতা নয়। আগেকার দিনে রাজা-জমিদাররা কোষাগার থেকে অর্থ ব্যয় করে ‘স্তাবক’ পুষে রাখতো। এদের কাজ ই ছিল লজ্জা-সরম এর মাথা খেয়ে ঘুরে ঘুরে রাজা বা জমিদার এর নির্লজ্জ গুণ-গান করা। স্তুতি বিষয়টি কিন্তু একদমই আলাদা।
বাড়িতে কোনো আত্মীয়-পরিজন এলে, সাউন্ড-সিস্টেম চালিয়ে, ভালো-মন্দ খাওয়ানো টাই কী শেষ কথা হয় ? অবশ্যই নয়। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে, বিশ্রাম নেওয়ার পর গল্পে-গল্পে, মিষ্টি কথার মাধ্যমে আমাদের প্রতি ওনাদের টান ও গভীর ভালোবাসার প্রসঙ্গ তুলে ওঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই আমরা। শ্রী শ্রী চণ্ডী ও অনেক টা যেন তাই। এর ছত্রে-ছত্রে কৃপাময়ী ঁমা এর কাছে কৃপা-ধন্য সন্তানের স্তুতি ও প্রার্থনা। সনাতন ধর্মের ক্ষমতা বলতে ঠিক এটাই।
কাহিনীর শুরু এভাবে….. কাশ্মীর এর কাছাকাছি কোন এক নগরে সুরথ নামে এক অতি-প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল ‘কোল’। শত্রুদের প্রবল আক্রমনে তিনি একসময় কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েলে, সেই সুযোগে তাঁরই রসদে পুষ্ট পাত্র-অমাত্যবর্গ বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাঁকেই রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেয়। বিতাড়িত, বিমর্ষ, দিশাহীন রাজা ঘোড়ার পিঠে বনে-জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে, একসময়ে মেধা-ঋষি’র আশ্রমে এসে পৌঁছান।( উল্লেখ্য, এই বাংলার ই পূর্ব সীমান্তের কাছাকাছি করালডাঙা পাহাড়ের ওপর আজও ‘মেধসাশ্রম’ আছে।)
অপর দিকে, সমাধি নামে বৈশ্য কূল-জাত আর এক জন তাঁর ধনলোভী সহধর্মিণী ও অসাধু পুত্রের নির্যাতনের স্বীকার হয়ে নিজের গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে বনে বনে ঘুরতে, শেষে এখানেই এসে হাজির। উভয়ের একান্তে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা। পরে, দু’জনেই, ঋষিকে যে যার দুঃখের করুন ইতিহাস জানান। অতিথি সেবার পরে, সব কথা শুনে, ঋষি-বর উভয়কেই শান্ত-সমাহিত চিত্তে শ্রী শ্রী চণ্ডী পাঠ করার আদেশ দেন।
উভয়েই সেই নির্দেশ নিষ্ঠা-সহ পালন করতে শুরু করেন।
“অর্ণাঞ্চক্রতুস্তস্যাঃ পূষ্পধূপাগ্নিতর্পণৈঃ ।
নিরাহারৌ যতাহারৌ তন্মনস্কৌ সমাহিতৌ।।”
নদীতটে, দেবী দুর্গার মৃণ্ময়ী মূর্তি বানিয়ে সুদ্ধ-চিত্তে, স্বল্পাহারে থেকে ধূপ-দীপ এবং হোম ইত্যাদির দ্বারা দেবীর স্তুতি-প্রার্থনা করলেনঃ
” দেবি প্রপন্নার্তিহরে প্রসীদ প্রসীদ মাতঃ…….” ।
পরিশেষে, দেবী প্রসন্না হয়ে, দর্শণ দিয়ে, উভয়কেই বর প্রার্থনা করতে বললেন। স্ত্রী-পুত্র, সৈন্য-সামন্ত, হাতি-ঘোড়ার চিন্তায় চিন্তিত রাজা-সুরথ, শত্রুকে নাশ করে হারানো রাজ্য পুনরায় ফিরে পেতে চাইলেন। দেবী বললেন, ‘তথাস্তু’।
“……. নৃপতে স্বরাজ্যং প্রাপ্স্যতে ভবান্।”।
হে নরপতি! অল্প দিনের মধ্যেই তুমি তোমার হারানো রাজ্য ফিরে পাবে। ক্ষত্রিয়-রাজা মহানন্দে ফিরে গিয়ে আবার রাজ্য-পাঠ শুরু করলেন।
এদিকে, বৈশ্য কূল-জাত হোয়েও বিবেক ও বৈরাগ্যবান সমাধি …..
” জ্ঞানং বব্রে নির্বিণ্ণমানসঃ।”….. সংসারের অস্মিতা বোধ এর উপরে উঠে দেবীর চরণে প্রকৃত জ্ঞান-মুক্তি প্রার্থনা করলেন। স্মেরমুখী দেবী বর-মূদ্রা দেখিয়ে বললেন…”সংসিদ্ধ্যৈ তব জ্ঞানং ভবিষ্যতি।” দেবী’র বরে সমাধি জন্ম-মৃত্যু চক্রের বাইরে চলে গেল চিরদিনের জন্য।
” ইতি দত্বা তয়োর্দেবী যথাভিলসিতং বরম্”…….দেবী যে আমাদের “সপিং-মল” কি না ! দেখুন,দেবী’র বরে রাজা পেলেন “ধর্ম-অর্থ-কাম”। সমাধি পেলো “মোক্ষ”। দেবী যে “চতুঃবর্গ” ফল-দাত্রী ! প্রার্থনার মাধ্যমেই আপনি চামর পাবেন আবার, চাদর ও পেতে পারেন ; সোনার -হার ও পাবেন আবার, সাইকেল এর চেন ও পাবেন………….যা চাইবেন।
পুরাণ এর দৃষ্টিভঙ্গী ঠিক এটাই। নিছক একটা হালকা গল্প দিয়ে শুরু হযে জীবন-মূখী এক সত্য। তারপর, গড়িয়ে চলে অধ্যাত্মিকতার গভীর থেকে গভীরতমে। বৌদ্ধ-তন্ত্রে তো কথাই নেই, জৈনদের বহু প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে লেখা মন্ত্রে চণ্ডীর স্পষ্ট উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো ঘটনা। জাপানের “চণষ্টী- দেবী” ও কী তবে আমাদের মহামায়া চণ্ডী’র ই আর এক পরিভাষা ? সঠিক সিদ্ধান্তে আসা হয়তো বা একটু মুস্কিল ই।
বর্তমানে, নব্য-ভক্তদের কেউ কেউ চণ্ডী’র এই ” রূপং দেহি…. জয়ং দেহি… যশো দেহি…. ” মন্ত্র শুনে সমালোচনা করে। কী করে ভুলে যাই বলুন, দেবী যে আমাদের মাতৃ-স্বরূপা ! সন্তান তার মা এর কাছে চাইবে না তো পাড়ার আর কার কাছে চাইতে যাবে ? যদিও দেখা যাচ্ছে, স্বয়ং চৈতন্যদেব সহ প্রাচীন বৈষ্ণবদের মধ্যে চণ্ডী’র প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ছিল । “প্রেম-বিলাস” গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে, চৈতন্য একবার বাংলাদেশে তার পিতামহ, উপেন্দ্র নাথ মিশ্র’র বাড়িতে গেছিলেন। পৌঁছেই চোখে পড়লো, কাঁপা-কাঁপা হাতে নুব্জ- পিতামহ অপর এক ব্রাহ্মণ এর বাড়ি থেকে আনা শ্রী শ্রী চণ্ডী থেকে এক একটি শ্লোক লিখে রাখছেন। নাতি আসার আনন্দে উপেন্দ্রবাবু তার কম্বলাসন থেকে উঠে পড়তেই চৈতন্য শ্রদ্ধাভরে ওখানেই বসে, পুরো চণ্ডী টাই নিজে লিখে দিয়ে এসেছিলেন।
আবার দেখি, নিমাই এসেছে শুনে, পাড়া থেকে একজন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে জানতে চান, ” নিমাই! কী করলে আমি আমার এতো সাংসারিক কষ্ট-দুঃখ থেকে রক্ষা পাবো…… বলতে পার ?”
চৈতন্য-দেব এই প্রশ্নের চঠ-জলদি উত্তর দিয়েছিলেনঃ ” নিত্য চণ্ডী-পাঠ করলে।”
চৈতন্যের প্রজ্ঞা যদি চন্ডী পাঠের পথ বলে দেয়,তবে কষ্ট লাঘবের উত্তর কি অজানা বলা চলে ।
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.