শতরূপা তোমাকে কিছু বলার ছিল সুমনের (নবম ভাগ) – আমি যামিনী তুমি শশী হে
সুমন মুন্সী,কলকাতা
(আগে যা হয়েছে জানতে ক্লিক করুন প্রথম ভাগ , দ্বিতীয় ভাগ, তৃতীয় ভাগ, চতুর্থ ভাগ,পঞ্চম ভাগ,ষষ্ঠ ভাগ, সপ্তম ভাগ, অষ্টম ভাগ নবম ভাগ, দশম ভাগ)
“চলুন স্যার, আমাদের লোকাল এসপি অফিসে”,বললেন ছেত্রীদা ।
“না, দাঁড়ান আগে উত্তরা কে ফোন করি। ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিজি রিকোয়েস্ট করলে সহজে হবে। উত্তরা ডিসিপি সাইবার ক্রাইম।”, বললো পার্থ ।
দুবার রিং হয়ে কেটে গেলো । মনে হয় মিটটিং এ আছে, ভাবলো পার্থ ।
তিন মিনিট পরে কল এলো। “কে পার্থ? বল “, উত্তরা বললো ।
সময় নষ্ট না করে পার্থ বললো “ডিজি কে বলে এখানকার ডিএসপি কে একটু হেলপ করতে বল, মনাস্ট্রি কোনো হেলপ করছে না।”
“শোন কালকের আগে হবে না ডিজি হোম মিনিস্ট্রি মিটিং এ দিল্লীতে”, উত্তরা বললো ।
“চেষ্টা কর, আমিও দেখি ছেত্রীদা যদি কোনো কানেকশন বের করতে পারেন”,এই বলে ফোন ছেড়ে দেয় পার্থ।
“ছেত্রীদা আজ আর কিছু হবে না, কি করা যায় আপনি দেখুন”, পার্থ অসহায় ভাবে ছেত্রীদা কে প্রশ্ন করলো ।
পর পর দু জায়গায় ছেত্রী ফোন করলো, কিছু কথা বলে ছেড়ে দিলো ।
“আজ কুছ নাহি হোগা, শরীফ হলিডে”, বললো ছেত্রী ।
“সেই ভালো চলুন, মাইন্ড ফ্রেশ না হলে কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা, চলুন বাচ্ছাদের ডাকি।”, বললো পার্থ ।
হোটেল ঘর থেকে আধ ঘন্টা পরে আট জনের দল বেরিয়ে এলো। পুরো দস্তুর টুরিস্ট। পেলিং হেলিপ্যাডের কাছে ওদের রিসোর্ট থেকে গাড়ি নিয়ে চললো কাছের পাহাড়ি নদীর ধারে । সঙ্গে লাঞ্চ বক্স নিয়ে নিয়েছে সুতরাং দুপুর নয় বিকেলে ফিরলেও হবে । ঘড়িতে বাজে ১১টা । ১১ কিমি দূরে রিম্বি নদীর ধরে পৌঁছতে সময় লাগলো ৩৫ মিনিট ।

নেমেই ছেত্রীদা বললেন,” জংলী এরিয়া কেউ এক জঙ্গলের ভিতরে যাবে না, বাঘ না থাকলেও লেওপার্ড বা পান্ডা থাকতে পারে, অর স্নেক, ওয়াচ আউট ইওর স্টেপস।”, বললো ছেত্রীদা।
মিসেস পার্থ মানে সংযুক্তা ভালো ফটোগ্রাফার, আজ ডিএসলার নিয়ে ছবি তুলবে । প্রথম যৌবনে বিয়ের পর এই পেলিং রাবাংলা আর সিকিমের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে আছে ওদের হানিমুনের দিনগুলির সোনালী স্মৃতি। পার্থ দুই মেয়ে কে নিয়ে এগিয়ে গেছে, পা চালালো সংযুক্তা।
দুই ধরে কত গাছ, কিছু কিছু জংলী ফুল আর লতা গুল্ম । একটা সোঁদা গন্ধ আর পাখিদের কিচির মিচির এক কথা মন ভালো করা পরিবেশ। দুই মেয়ে আগে ছুটছে আর পার্থ সাবধানী বাবা পিছনে। কুলকুল করে রিম্বির আওয়াজ আসছে , যেন ডাকছে । ছেত্রী মৎস জীবি মানে মাছের ওপরই বেঁচে থাকেন। সাথে বিলেতি ফোল্ডিং ফিশিং রড আর মাছ ধরার সরন্জাম গাড়িতেই থাকে। সুতরাং বারমুডা আর টিশার্ট পরে যুদ্ধে চলেছেন।
মিসেস পার্থ আর মিসেস ছেত্রী খাবার জল , লাঞ্চ বক্স নিয়ে চলেছেন , আর গজ গজ করছে “বাবুরা ফুর্তি করছেন আর আমরা যেন কুলি”। মিসেস ছেত্রীর কথা শুনে সংযুক্তা হেসেই খুন ।
১০ মিনিট হেঁটে যখন নদীর ধরে পৌঁছলো, তখন মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া আর মিঠে কড়া রোদে সবাই খুশিতে ঝলমল করছে ।
ছেত্রী দা, সাজসরঞ্জাম নিয়ে একধারে পাথরের ওপর বসে পড়লো, টিশার্ট খুলে ফেলেছে , কারণ নদীতে স্নান করবে । এমনি তে দু বেলা চান করে , একবার দিনে, একবার রাতে । আজ বাঁধন ছাড়া শিশু সবাই ।
নিজের মনেই হাসে সংযুক্তা দেখতে দেখতে ২০ বছর কেটে গেলো একসাথে , এই সেদিনের কথা মনে হয়। একটু চাপা মাস্টারী মুখোশ পড়া থাকলেও, মানুষটা খাঁটি আর পাগলের মতো ভালোবাসে, কিন্তু, মুখে প্রকাশ কম। কথা কিছু কিছু বুঝে নিতে হয় ।
“সংযুক্তা ভাবি দেখিয়ে ভাই ক্যাইসে পানি কে আন্ডার খাড়া হায় , আপ ভি যাও, হ্যাম হয় ইধার।”, ছেত্রীদা বললেন।
ধীর পায়ে এগোলো সে , ঈষৎ লজ্জা পেলো মেয়েরা বড় হচ্ছে, কি ভাববে। এবার সংযুক্তার অবাক হবার পালা, দু হাত বাড়িয়ে পার্থ তাকে ডাকছে। একবার ভাবলো ভুল দেখছে, পরোক্ষনে বুজলো, এটা সেই ২০ বছর আগের দৃশ্য, সেদিন এই ভাবেই ডেকেছিল, বিয়ের ১৫ দিনের মাথায় । হটাৎ করে নতুন ভালোলাগায় মন ভোরে উঠলো ।
আজ সেও যেন অষ্টাদশীর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে পৌঁছে গেলো, মনের মানুষের পাশে । শক্ত করে হাত চেপে ধরলো পার্থ, এধরার মানে সংযুক্তা জানে। এই ভাবেই তো সে রোজ ধরা দিতে চায়। কোনো কথা না বাড়িয়ে মুচকি হেসে পার্থকে বললো “মেয়েরা আছে কোনো অসভ্যতা নয়” ।
কিন্তু সংযুক্তা যেটা জানত না, পার্থ দেখে নিয়েছে মিস্টার এন্ড মিসেস ছেত্রী মাছ ধরা নিয়ে খুনসুঁটি করছে। মেয়েরা পাখি আর এক বুড়ো দাদুর সাথে গল্প করছে, কেউ ওদের খেয়াল করছে না। সংযুক্তার বাম হাতে সাহেবি কায়দায় এঁকে দিলো চুম্বন, আজও সংযুক্তা শিহরিত হয়ে গেলো সেই প্রথম দিনের মতো। একটু যেন গোলাপি আভা দেখা গেলো ওর দুই গালে ,পার্থ জানে এটা পরম এক অনুভূতির প্রতীক ।
ঠিক তখনি রবীন্দ্রনাথ কে ধার করে বলে উঠলো “দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর, ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।” , “শেষের কবিতা” রবি ঠাকুরের এই উপন্যাসের অমিত আর লাবণ্যের আগমন বাস্তবের মাটিতে।
নদীতে মাছ প্রচুর, ছেত্রীদা মনের সুখে ট্রাউট মাছ ধরছে ।
কতক্ষন নদীর জলে পা ভিজিয়ে হাতে হাত নিয়ে দুজনে দাঁড়িয়ে, পাঁচ সাত মিনিট হবে কিন্তু মনে হলো যেন একযুগ।
“পার্থ”, সংযুক্ত ডাকলো ।
“কি”, খুব আস্তে আস্তে বললো যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে।
কিছু একটা বলতে নিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে দাঁতের মাঝে , বলা হয় না ।কিন্তু, পার্থ জানে সংযুক্তা কি বলতে চায় , কি শুনতে চায় ।
“আমি আজও তোমায় সেই প্রথম দেখার দিনের মতোই ভালোবাসি।ভালোবাসি ,ভালোবাসি”, শেষের ভালোবাসি বেশ জোরেই বলে ফেলেছে ।
প্রতিভা ভাবি বললেন “কোই বাত, পেয়ার জারি রাখহ, হামারা পারমিশন হায়, ভাইয়া”।
এবার পার্থ লজ্জা পেয়েছে, সে মাস্টার মানুষ তার প্রেম হবে শুদ্ধ স্বত্বিক। “রোমান হলিডে”র হিরো সাজা চলে না ।
খানিকটা রাগ হলো নিজের ওপর, মাস্টার না হলে এই আরোপিত গাম্ভীর্যের কোনো দরকার পড়েনা।
ঠিক এই সময় সংযুক্তা হাত ধরে আরো কাছে টেনে নিলো আর মাস্টার মশাই রিম্বির জলে ভেসে গেলেন, যে রইলো সে শুধু সংযুক্তার পতি, পার্থ সমাজপতি ।

গোটা ১৫ মাছ ধরা শেষে ছেত্রীদা জলে নেমে, জল ছেটাতে লাগলো বাচ্ছাদের মতো। একটা চিল ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো একটা মাছ ।
“হায় রাম সত্যনাশ হো গায়ে”, প্রতিভা ভাবি চিৎকার করে উঠলেন।
“জানে দো, ও ভি আপ্নে কে লিয়ে আপ্নে প্রতিভাকে লিয়ে লে গায়ে”, হেসে বললো ছেত্রীদা ।
“হাত ছাড়ো পার্থ আর জলে ভিজতে হবে না ঠান্ডার ধাত তোমার ।” , বললো সংযুক্তা ।
পার্থ উঠে এলো সুবোধ বালকের মতো, শুধু যাওয়ার সময় ভিজে হাতে গাল আর কানের পাশটা ছুঁয়ে গেলো । এই মুহূর্ত গুলোই বাঁচিয়ে রাখে দাম্পত্যের সদা আকর্ষণ ।
“বাচ্ছা লোগ আ যাও, খানা খ লো”, ডাক দিল, প্রতিভা ছেত্রী।
দু দিক থেকে এসে জুটলো জুনিয়র টীম । পার্থর দুই মেয়েই আন্টির ভক্ত কোনো স্পেশাল পারমিশন দরকার হলে আন্টি । প্রতিভাও ভালোবাসে বাচ্ছাগুলো কে ।
স্যান্ডউইচ, আপেল, ডিম্ সিদ্ধ, কলা, আঙ্গুর ফ্লাস্কে “টেমি টি”, টেমি টি গার্ডেনের চা দারুন প্রিয় পার্থর। আগে জানতো না, এখানে এসেই জেনেছে । অর্পিতা অলরেডি বলে রেখেছে ৫ প্যাকেট নিয়ে যেতে।
খাওয়া সবে শেষ হয়েছে, সবাই হাত ধুচ্ছে নদীর জলে, কাঁচের মত স্বচ্ছ জল । হঠাৎ প্রতিভা বললো, “ও বুড়া আদমি কিধার গায়ে, কুচ দের পহেলা তো থা”।
এমন সময় জঙ্গল থেকে বুড়ো বেরিয়ে এসে হতাশ ভাবে হাত নাড়লো। ছেত্রীদা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “কি হয়েছে”।
বুড়ো বললো, সাথে যে কুকুরটা ছিল তাকে পাচ্ছে না। ছেত্রীদা বললো চলুন দেখি । ছেত্রীর হাতে খুকরি চলে এসেছে ।
কিছুদূর এদিক ওদিক দেখে এক জায়গায় দেখলো মাটিতে ঘষতে ঘষতে নিয়ে যাওয়ার দাগ আর দু এক ফোঁটা রক্ত লেগে । ছেত্রী পাহাড় জঙ্গলের ছেলে ভালো করে আশপাশ দেখে বুঝলো, তেন্দুয়া মানে লেপার্ডের কাজ । টিবেটিয়ান মাসটিফের বাচ্ছা, বুড়োর বড় শখের কুকুর ।
ছেত্রী দ্রুত সবাইকে প্যাকআপ করে বেরোতে বললো| আলো মরে আসছে আর সাথে বৃষ্টির পূর্বাভাস। বুড়ো কে নিয়ে বাছাদের নিয়ে পার্থ আর সবার হাতে একটা করে লাঠি দিয়ে দিলো জঙ্গল থেকে । সাবধানের মার্ নেই । প্রাথমিক অবাক হওয়ার পালা পেরিয়ে এবার ভয় গ্রাস করছে সবাইকে ।
ছেত্রী বললো, “দিস ওয়ান লেওপার্ড, নট টাইগার। লেপার্ড সাধারণত মানুষ ধরতে যায় না, যদি না খুনিয়া হয়। ছাগল,বাছুর কুকুর ধরে ।”
যাই হোক গাড়ির কাছে পৌঁছে সবাই নিশ্চিন্ত হলেন। দ্রুত গাড়িতে উঠে সবে গাড়ি স্টার্ট করতে যাবে, এমন সময় সামনের রাস্তা দিয়ে চলে গেলো একটা পূর্ণ বয়স্ক লেওপার্ড ।
“আই নেভার স সাচ এ বিগ লেওপার্ড হিয়ার”, বললেন রোজার এংলো ইন্ডিয়ান বুড়ো, টেমি টি গার্ডেনে ম্যানেজার ছিল| এখন পেলিং এই থাকেন গত 5০ বছর। সিকিম কে ভারতের অংশ হতে দেখেছেন, নিজের চোখে। রাজা চোগিয়ালের ঠাঁট আর তাঁর মার্কিন স্ত্রীর রাজত্ব কাল। অজিত মিশ্রর হাত ধরে সিকিমের ভারত ভুক্তি।
রোজার নেমে গেলেন পেট্রল পাম্পের কাছে ।
এতক্ষনে পার্থ বললো, “এইভাবে অচেনা স্পটে আর যাওয়া নয়”।
ছেত্রী বললো “Pakyong District এ Pangolakha Wildlife Sanctuary একবার বাঘ দেখা গেছিলো ২০১৮ এ ক্যামেরা ট্রাপে ধরা পড়েছিল, সেটা তো ইস্ট সিকিম এখন থেকে ১১৮ কিমি “
সংযুক্তার কিন্তু এইসব কথা ভালো লাগছে না, ৫৫-২৫০ টেলিফটো লেন্স দিয়ে লেওপার্ড এর একটা ছবি তুলেছে । মাস্টার ক্লাস শট।
একবার সুমনদা ফেসবুকে একটা লেপার্ডের ছবি দিয়েছিলো, সেম । একটু খুশি হলো সে সত্যি ভালো হয়েছে ছবি । হোটেলে গিয়েই স্টেটাস দিতে হবে । বিল্টুদা কে কি একটা সিগমা ১৫০-৬০০ স্পোর্টস লেন্স আন্তে বলবে, ওদেশে বেশ সস্তা।
দেখি পার্থ কি বলে । বোলেরো পাহাড়ী পথ কেটে ছুটে চলেছে আর শেষ বেলার সূর্য লুকোচুরি খেলছে।
“হেলো কে উত্তরা, হ্যাঁ বল”, পার্থর কথায় সকলের হুঁশ ফিরলো ।
“ওকে ঠিক আছে, সুরাজ শর্মা সকল ১১ টা । যা সিগন্যাল নেই লাইন কেটে গেলো”, বললো পার্থ ।
“ছেত্রীদা, কাল ১১ বাজে ডিএসপি অফিস।”
“ওকে স্যার, হোটেল ভি আ গায়ে,” হেসে বললো ছেত্রী দা ।

(ক্রমশ)
*** কাল্পনিক গল্প বাস্তবের চরিত্র ***
[…] (আগে যা হয়েছে জানতে ক্লিক করুন প্রথম ভাগ , দ্বিতীয় ভাগ, তৃতীয় ভাগ, চতুর্থ ভাগ,পঞ্চম ভাগ,ষষ্ঠ ভাগ, সপ্তম ভাগ, অষ্টম ভাগ নবম ভাগ) […]