গন্ডগোল
পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের টাকা ছিল না,
তাই আমরা গরিব ছিলাম।
তাতে বড়লোক না হয়ে
ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন ছিল।
সে কারণে আমরা সুখী ছিলাম।
ভালো ছিলাম।
যদিও বুঝতাম না
সুখে থাকার, ভালো থাকার মূল কারণ।
আমরা দুই ভাই। এক বোন।
আমাদের বাবার কম মাস মাইনের
সরকারি চাকরি।
আমাদের মা উচ্চাকাঙ্খী বাড়ির বউ।
ছেলেমেয়েদের বড় করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
মায়ের সে ইচ্ছাতে আমরা অবাক হতাম।
বড়? সে তো দিন পিছিয়ে
সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে
সবাই হয়! এতে আকাঙ্খার কি আছে?
আমাদের কথা শুনে
গায়ে ঘাসফুলের গন্ধ ওঠা আমাদের মা হাসত। বলত,
দিন কাটানোর বড় হওয়া ,
বড় হওয়া নয় রে মা!
বড় হওয়া ,ছোটবেলা ফেলে আসাও নয়।
তা হলো,
কারো প্রতি অন্য ভালোমানুষের
শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম। আর-
হিংসুটে মানুষের ঈর্ষা।
আমরা ওসব বুঝতাম না।
হেসে কুটি কুটি হয়ে গড়াতাম
এ ওর গায়ে।
বলতাম, মা’টা কী বোকা!
মা’ও হাসত চাঁদের আলোর মতো।
মনে মনে ভাবত,
ওদের এ সারল্য যেন থাকে আজীবন।
আমাদের ছোটবেলায়
কোনো ডায়েট চার্ট ছিল না।
প্রোটিন ফ্যাট কার্বোহাইড্রেট
ভিটামিন মিনারেল ফাইবারের বদলে
আমরা আরামসে
ডাল ভাত সব্জি খেতাম
আর জুটলে
কালেভদ্রে মাছ মাংস গোটা ডিম।
আমরা স্কুল যাওয়ার আগে
টো টো করে ঘুরতাম
এ পাড়া ও পাড়া।
স্কুল থেকে ফিরে
পাঁই পাঁই করে ছুটতাম হাওয়ার মতো।
আমাদের লিকলিকে কঞ্চির
মতো শরীরেও একটা বুক ছিল।
তাতে একটা করে সতেজ
হৃৎপিন্ড ও ফুসফুস ছিল।
সরু পেটে,
সব সাধারণ খাদ্যে স্বাদ খুঁজে পাওয়া
খিদে ছিল।
ছোটবেলার আমরা
আমাদের জীবন নিয়ে
ধুলোখেলা ছেলেখেলা করতাম,
আর মনে মনে ভাবতাম,
বড় হয়ে বড় হতে হবে।
যেমন আজকের ছোটরা
বড় হয়ে বড় হওয়ার কথা ভাবে
ঠিক তেমন বড় হওয়া নয়।
তীব্র গরমের
এবড়োখেবড়ো মালভূমির দেশে
আমাদের বাবার চাকরিস্থল ছিল।
সেখানে তার আলো আর পাখাহীন
কোয়ার্টার ছিল।
জ্বলতে শুরু করার পর থেকে
ক্রমশ কাচে কালি পড়তে থাকা
হ্যারিকেনের তিনদিকে বসে
আমরা তিন ভাইবোন যত না পড়তাম,
তার থেকে বেশি ভান করতাম পড়ার।
আর তালপাতার পাখার হাওয়া খেতাম
নিজেরা পাখা নাড়িয়ে।
তারপর এক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম
শীত ও গরমের বোধহীন আরামের ঘুম।
আমাদের কোনো রেস্তোরাঁ ছিল না,
কিন্তু মাসে একবার করে
লুচি আলুর দম আর ক্ষীরের
স্বঘোষিত ভোজ ছিল।
ক্ষীরের হাঁড়ি চামচ দিয়ে চেঁছে
সঙ্গে প্রায় খানিকটা এলুমিনিয়াম
খেয়ে ফেলার পালি ছিল।
রেডিওতে সুনীল গাভাস্কার আর
গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের ক্রিকেটের
ধারাবিবরণী শোনার মারফি রেডিও ছিল।
প্রায় প্রতিটা ম্যাচ হেরে
মুষড়ে পড়া মন খারাপ ছিল।
ক্রিকেট খেলা না বোঝা
আমার মায়ের অর্থহীন মন্তব্যে
সে মনখারাপ কেটে যাওয়া ছিল।
আজ আর সেসব কিছু খুঁজে পাইনা।
আমরা বড় হয়ে
বড়লোকেদের মতো
শিক্ষিত ও সমৃদ্ধ হয়ে গেছি।
স্বার্থের চুল চেরা হিসাব করতে করতে
তেমন বড় হওয়া হয়নি
যাতে ভালো মানুষেরা সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা করে আর হিংসুটে মানুষেরা, ঈর্ষা।
বড়লোক আর বড় মানুষের
মানের গণ্ডগোলে
সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে আমাদের।
০৫.১১.২০২১

Dr. Palash Bandopadhyay popular pediatrics expert with Post Graduate of Pediatric Nutrition,(Boston University). Doctor, Author, Poet, and a beautiful mind. He, always a great content provider for the readers with value to the core of the subject.