ছোটোগল্প – পূজা
হীরক মুখোপাধ্যায়
(১)
“কাল সকালে কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি উঠবি,” মেয়ের পাশে শুয়ে রাতে ঘুমোনোর আগে মেয়েকে অনুনয় করে বললেন উপাসনার মা।
উপাসনা-রা দক্ষিণেশ্বরের আদ্যাপীঠ মন্দিরের কাছেই এক ফ্লাটে থাকে। এবছর দুর্গাপূজার আগে থেকেই ওর বাবা অসুস্থ। এতদিন ওর বাবাই ঘরের নারায়ণ শীলার পূজা করতেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এখন ওঁনার পক্ষে নিত্য নারায়ণ সেবা সম্ভব না হওয়ায় নারায়ণ শীলার মাথায় কয়েকটা সাদা ফুল আর জল বাতাসা দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পড়েছে উপাসনা-র উপর। যদিও এতে মোটেও বিরক্ত নয় ও।
উপাসনাই বাড়ির একমাত্র সন্তান, সহোদর না থাকায় রাখি পড়ানো বা ভাইফোঁটার দিন যাতে ওর মনে কোনো কষ্ট না হয়, সেজন্য ওর মা ছোটোবেলা থেকেই ওকে দিয়ে গোপালের হাতে রাখি বাঁধিয়ে গোপলকে উপাসনার ধর্মভাই বানিয়ে দিয়েছে।
উপাসনা আইন ব্যবসা করে। পাতানো ভাইয়ের সঙ্গে প্রত্যেকদিন সকালে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে তবেই উপাসনা কজে বের হয়।
“কেনো মা ?” কৌতূহলের সাথে জানতে চায় উপাসনা।
“আজ রাত ৯.৫০ থেকে বৈকুণ্ঠ চতুর্দশী পড়ছে, যোগ চলবে আগামীকাল বেলা ১২ টা পর্যন্ত; আগামীকাল আবার বৃহষ্পতিবার। তুই একটু হাত না লাগলে চাপে পড়ে যাব।”
মায়ের কথা শুনতে শুনতে উপাসনার মনে পড়ে গেল ও যেন কোথায় শুনেছিল- আষাঢ় মাসের শুক্ল একাদশী থেকে কার্তিক মাসের শুক্ল একাদশী পর্যন্ত মোট চার মাস এই জগৎ সংসারের দায়িত্ব দেবাদিদেব মহাদেব-এর হাতে অর্পণ করে বিশ্রামে যান জগদীশ্বর বিষ্ণু।
পরে দেব উঠনী একাদশী-র দিন নিদ্রা ছেড়ে জেগে ওঠেন জগদীশ্বর শ্রীহরি বিষ্ণু। ওইদিন দেব দীপাবলি উৎসব পালন করেন স্বর্গের দেবতারা।
এই বৈকুণ্ঠ চতুর্দশীর দিন বিষ্ণু ও শিব একই রূপে হরিহর আত্মা রূপে একই শরীরে বিরাজ করেন।
কিছু কিছু ধর্মগ্রন্থের মতে এই দিনকে ‘বৈকুণ্ঠ চতুর্দশী’ রূপে চিহ্নিত করেন স্বয়ং শিবশঙ্কর। তিনিই এদিন শ্রীবিষ্ণু-র হাতে কোটি সূর্য্যের কান্তি যুক্ত দিব্যাস্ত্র ‘সুদর্শন চক্র’ প্রদান করেন। বৈকুণ্ঠ চতুর্দশী-র দিন ‘বৈকুণ্ঠ লোক’-এর দরজা পুরোপুরি খোলা থাকে।
(২)
আজ বাড়িতে বৈকুণ্ঠ চতুর্দশী-র পূজা, তাই সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উপাসনা যখন চুল আঁচড়াচ্ছিল তখন কী জানি ওর মনে পড়ে গেল রাজ-এর বলা বেশ কিছু কথা। রাজ-এর কথা মনে পড়তেই ও নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেলল।
রাজ একদিন ওর কাছে জানতে চেয়েছিল, “কৃষ্ণ বেশিরভাগ সময় হলুদ রঙের পোশাক, আর রাধা বেশিরভাগ সময় নীল রঙের পোশাক কেনো পড়তেন জানো ?”
উপাসনা উচ্চ মাধ্যমিক-এর পর আইন পড়তে শুরু করেছিল, ও ছাতা এসব কী বুঝবে; তাই ও হতভম্বের মতো তাকিয়ে জানতে চেয়েছিল, “কেনো ?”
“একে বলে বর্ণশ্রদ্ধা। তোমরা আজ যারা সবসময় আদালত কক্ষে বর্ণবিদ্বেষ-এর বিপক্ষে সওয়াল করো, তাঁরা বেশিরভাগ সময় এই বিষয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা-র কথা স্মরণ করে যুক্তির জাল বুনে চলো।
কখনো কী ভেবে দেখেছো, আজ থেকে বহু বছর আগে ‘বর্ণবিদ্বেষ’ বা ‘বর্ণবৈষম্য-র বিরুদ্ধে পৃথিবীকে প্রথম শ্রেণী সংগ্রামের পথ প্রদর্শন করেছিল আমাদের এই দেশ।”
উপাসনা আজ পর্যন্ত কোনোদিন এরকম অদ্ভুত তত্ত্ব কথা শোনেনি। ওর যুক্তিবাদী মন মনে মনে এই তত্ত্বকে মেনে নিতে না পারলেও শুধুমাত্র নতুন ধারণার সন্ধান পাওয়ার জন্য জানতে চাইল “ঠিক বুঝলাম না, একটু বুঝিয়ে বলবে।”
জবাব দিতে গিয়ে রাজ বলেছিল, “বলা হয়ে থাকে শ্রীরাধা লক্ষ্মী-র অংশভূতা। শ্রীরাধা-র গায়ের রঙ ছিল হলুদের মতো।
ফর্সা তো অনেক রকমের হয়, কেউ ফ্যাটফেটে সাদা ফরসা, তো কেউ লালচে বা গোলাপি ফর্সা আবার কেউবা হলদেটে ফর্সা। যদিও রঙের গুণে হলুদ ফর্সা রঙের জাতক জাতিকারা সকলের মনে একটা আলাদা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
কানাই ছিলেন নারায়ণ-এর অবতার স্বরূপ। কানাই-এর গাত্রবর্ণ ছিল ঘোর বা কালো রঙের। গায়ের রঙ কৃষ্ণ বর্ণ হওয়ার কারণে কানাই ধীরে ধীরে সমাজে কৃষ্ণ বলে পরিচিত হতে থাকেন।
সমাজের কিছু মানুষের বিদ্রুপের কারণে কানাই-এর অবচেতন মনে কোথাও যে একটা মনোবেদনা তৈরী হয়েছে, তা একসময় ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন অয়ন ঘোষের স্ত্রী রাধারাণী।
বিদগ্ধ ব্যক্তিদের মতে, কানাই-এর মন থেকে ওই বেদনা অপনোদনের জন্য এরপর থেকেই শ্রীরাধা অধিকাংশ সময় তাঁর প্রেমিক প্রবর কানাই-এর গায়ের রঙের মতো ঘন নীল রঙের পোশাক পরতে শুরু করেন।
উল্টো দিকে কৃষ্ণও রাধার পবিত্র প্রেমকে সম্মান জানাতে রাধার গায়ের রঙের সাথে সাযুজ্য রেখে হলুদ রঙের পোশাকে নিজেকে আবৃত রাখতে শুরু করেন।
তুমি জানো, এখনো আমাদের দেশে এমন অনেক সম্প্রদায় আছে যাঁরা মনে করেন কৃষ্ণর দর্শন পেতে গেলে মনটাকে শুধু পবিত্র করলেই হবেনা, বরং হলুদ রঙের পোশাকও পরতে হবে।
অন্যদিকে লক্ষ্মী বা শ্রীরাধার আরাধনা বা দর্শন পেতে হলে মনটাকে প্রেমিক রূপে গড়লেই হবেনা মাঝেমধ্যে নীলরঙের পোশাকও পরতে হবে।”
“এ আবার কী কথা, এসব তো কোথাও শুনিনি। বরং শুনেছিলাম, লক্ষ্মীকে প্রীত করতে হলে সবসময় হলুদ রঙের পোশাক পরতে হয় !”
“ঠিকই শুনেছো, কিন্তু বুঝেছো ভুল।”
“মানে ?” অবাক হয়ে জানতে চায় উপাসনা।
“দেখো, লক্ষ্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেলে সবার আগে নিজের মনকে নারায়ণের অনুরূপ করে গড়ে তুলতে হয়। নারায়ণ যেহেতু লক্ষ্মী বা রাধার গাত্রবর্ণকে সম্মান জানিয়ে হলুদ রঙের পোশাক পরতেন তাই এখনো অনেকে বলে থাকেন- ‘লক্ষ্মীর আরাধনা করতে গেলে হলুদবসন পরে কপালে হলুদের টিপ বা টিকা লাগিয়ে তবেই আরাধনা করতে হবে।’
কিন্তু এর মানে এই নয় যে হলুদ পোষাক পরলেই লক্ষ্মী লাভ হবে। হলুদ পোষাক পরলে বা পরালে যদি অত সহজে লক্ষ্মীলাভ হতো, তাহলে বিয়ের আসরে তো সবাই নতুন বউকে হলুদ রঙের শাড়িই পরাতো তাই না !
তুমি বোধহয় জানোনা, বিয়ের আসরে নববধূকে শুধুমাত্র লাল কিংবা নীল রঙের বসন পরানোর সুনির্দিষ্ট অনুশাসন রয়েছে আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে। কেনো শুধুমাত্র লাল বা নীল আশা করি বুঝতে পারছো।”
না বিশেষ কিছু বুঝতে পারেনি উপাসনা। তাই ঘাড়টা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল পুরো বিষয়টাই ওর গুলিয়ে গেছে।
ওর অবস্থা দেখে রাজ হাসতে হাসতে বলেছিল, “ওসব ধর্মতত্ত্ব ছাড়ো, এসো তোমাকে সঙ্গীত তত্ত্ব দিয়ে বুঝিয়ে বলি..। হারমনিয়ম বাজিয়ে নিশ্চয়ই গান গাইতে পারো। তাহলে নিশ্চয়ই জানো ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী স থেকে ন পর্যন্ত সাতটা স্বর নিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব তৈরী করেছেন স্বরসপ্তক। আবার পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা স থেকে র্স পর্যন্ত আটটা স্বরকে নিয়ে গড়েছেন স্বরাষ্টক যাকে সাধারণ ভাবে সবাই ‘অকটেভ’ বলে থাকে।
ধরো তোমার গলা এ শার্প বা বি ফ্লাটে বাঁধা, অন্যদিকে আমার গলা ডি শার্প তাহলে তুমি যেখান থেকে গান তুলবে সেখান থেকে আমিও কী শুরু করব ! নিশ্চয়ই না তাই না।
কিন্তু আমাদের দুজনের গানটাই কিন্তু গানই হবে।
যেমন তুমি যে পোশাক পরেই পূজা করো, ওটা অন্যকিছু নয় পূজাই হবে।”
নিজের সেরেস্তায় বসে সেদিন রাজের মুখ থেকে ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি সঙ্গীত তত্ত্বের মতো গুরু গম্ভীর বিষয় শুনতে শুনতে বেশ কিছুটা নাকানিচোবানি খেয়েছিল উপাসনা।
হলুদ রঙের মানানসই চুড়িদার পাঞ্জাবি পরে কপালে একটা টিপ লাগিয়ে নিজেকে বৈকুণ্ঠাধিপতি-র পূজার উপযুক্ত সাজে সাজিয়ে ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো উপাসনা।
বারান্দার ব্যালকনিতে আসতেই খুশিতে মনটা ভরে উঠল উপাসনার। এ বছর ওর জন্মদিনের দিন রাজ ওর হাতে কয়েকটা ফুলের বীজ দিয়ে বলেছিল, “আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কথা না বললেও চলবে, কিন্তু এদের উপস্থিতিকে সম্মান জানিয়ে একটু হেসো, পরম মমতায় এদের গায়ে তোমার কোমল আঙুলগুলো দিয়ে আলতোভাবে একটু স্পর্শ কোরো।”
সেদিন বীজগুলো নিয়ে এসে একটা টবে ফেলে রেখেছিল। ওগুলোকে কোনোদিন সামান্য একটু যত্নও করেনি উপাসনা। কিন্তু বিধিলিপি কে খণ্ডাবে…, বরুণদেবের দাক্ষিণ্যে, সূর্য্য নারায়ণের কিরণে, পবনদেবের করুণায় আর প্রকৃতি মায়ের অপার কৃপায় অনাকাঙিক্ষত সেই বীজগুলো থেকে সবার অজান্তে কবে যে এই ফুলের গাছ জন্মেছিল উপাসনা কোনোদিন সেভাবে খেয়ালও করেনি।
আজ বারান্দার ব্যালকনিতে এসে ফুলের শোভা দেখে মনটা খুশিতে ডগমগ করে উঠল, নিজের অজান্তেই নানারঙের ফুলগুলোর কোমল পাপড়ির উপর হাত বোলাতে শুরু করল উপাসনা।
ওর মা ঘরের কাজ করতে করতে চেঁচিয়ে বললেন, “কেউই এই সংসারে সারাজীবন থাকেনা রে… মায়া না করে তাড়াতাড়ি ফুলগুলো তুলে পূজাটা সেরে ফ্যাল।”
গাছগুলোতে হওয়া প্রথম ফুলগুলো তুলতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। ও ভাবছিল, ‘যিনি নিজেই ফুল সৃষ্টি করেছেন তাঁকে আবার ফুল দিয়ে কী পূজা করব..।’
ভাবতে ভাবতে ও ব্যালকনির আরো ধারে এগিয়ে গিয়ে ফুলের কোমল পাপড়িগুলোর উপর ওর হাত রেখে মুগ্ধ চোখে ফুলের শোভা দেখতে লাগল।
এদিক ওদিক ফুলের নয়নাভিরাম শোভা দেখতে দেখতে নীচের তুলসিমঞ্চের দিকে তাকাতেই ও যেন তড়িতাহত হলো। কী দেখছে ও!
উপসনা দেখতে পেল, তুলসিমঞ্চের এক পাশে সবুজ রঙ দিয়ে বাঁধানো চাতালের উপর ফুলসাজে সেজে যেন শুয়ে আছেন সাক্ষাৎ কৃষ্ণ।
অবাক চোখে ও দোতলার বারান্দা থেকে দেখতে লাগল ওই দৃশ্য। ওদের তুলসিমঞ্চ-র একপাশে রয়েছে একটা বুড়ো শিউলি গাছ। দুর্গাপূজার সময় ঝুড়ি ঝুড়ি ফুল দিতে দিতে গাছটা রিক্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন সেভাবে আর ফুলও তো ফুটছে না, তবে এই ফুলগুলো ওখানে এলো কীভাবে !
মনের ভেতর যুক্তি তর্কের বিবিধ বিন্যাস চলতে থাকলেও অনাস্বাদিত পূর্ব এক আবহে নিজেকে সিক্ত করে চলেছিল উপাসনা।
শিউলি ফুলে সজ্জিত কৃষ্ণ-র নব কলেবর দেখতে দেখতে ওর মনে পড়ে গেল, ‘নিদ্রাভঙ্গ হওয়ার পর আজ থেকেই মৃত্যুলোকের গুরুদায়িত্ব আবার নিজের কাঁধে তুলে নেন শ্রীহরি বিষ্ণু।’
উপাসনার অন্তরাত্মা যেন ওর কানে ফিসফিস করে বলল, শ্রীহরি-র অংশাবতার কৃষ্ণ নিদ্রাভঙ্গ হওয়ার পর মোহন সাজে সেজে ওর জন্যই অপেক্ষা করছে।
চোখের সামনে ওর ইষ্টদেবের করুণাময় রূপ জাগতিক চোখ দিয়ে প্রত্যক্ষ করতে করতে মনটা কেমন যেন ভাবুক হয়ে উঠল উপাসনার।
মনের ভেতর কীভাবে যেন সৃষ্টি হতে লাগল ভক্তিরস। একসময় ভক্তিরসের আতিশয্যে ভাববিহ্বল হয়ে উপাসনা বিড়বিড় করতে লাগল :
‘তোমায় কী দিয়ে পূজিব ভগবান,
তোমায় কী দিয়ে পূজিব ভগবান।
আমার বলিতে কিছু নাই হরি,
সকলি তো তোমারি দান।
তোমায় কী দিয়ে পূজিব ভগবান..।
মন্দিরে তুমি মূরতিতে তুমি,
পূজা ফুলে তুমি, স্তব গীতে তুমি।
ভগবান দিয়ে ভগবান পূজা করি শুধু অপমান।
তোমায় কী দিয়ে পূজিব ভগবান…।
কোটি রবি শশী আরতি করে যাঁরে,
প্রদীপ জ্বালায়ে আমি পূজি তাঁরে !
কোথা তব মুখ, কোথা শ্রীচরণ,
কোথা দিব ফুল চন্দন !
তোমায় কী দিয়ে পূজিব ভগবান..।
কী বা তব রূপ, হেরি নাই ভরি,
নিজ মন দিয়ে তব রূপ গড়ি।
তুমি হাস কিংবা কাঁদ, সে রূপ নেহারি,
কাঁদে সদা মোর প্রাণ।
নিজেরে বাঁধিয়া তুমি নিজেই করিছ লীলা,
নিজেরে করিতে মুক্ত, চলেছে অনাদি খেলা।
অচিন্ত্য স্বরূপ, তুমি নাহি দিলে পরিচয়,
কেমনে করিব অবধান !
তোমারই দেওয়া তনু, তোমারই দেওয়া মন,
তোমারই দেওয়া প্রাণ, তোমারই দেওয়া ধন।
তোমারই সকলই দেওয়া, তোমারই কাড়িয়া লওয়া,
আমি কী করিতে পারি দান !
তোমায় কী দিয়ে পূজিব ভগবান…।
অরূপ রূপ মাঝে, স্বরূপ ঢাকিয়া রয়,
মোহন মূরতি মাঝে, পুনঃ দাও পরিচয়।
অন্ধ নয়ন হতে, তিমির সরায়ে লও,
করো প্রভু করো মোরে ত্রাণ।
তোমায় কী দিয়ে পূজিব ভগবান…।
আমার বলিতে কিছু নাই হরি,
সকলি তো তোমারই দান।
তোমায় কী দিয়ে পূজিব ভগবান,
তোমায় কী দিয়ে পূজিব ভগবান… ।
বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণের মতো একই চরণ বারবার সুর করে আবৃত্তি করতে করতে কখন যে ভক্ত আর ভগবান নিজেদের অজান্তেই একাত্মা হয়ে গেছে তা না বুঝেছে উপাসনা না জেনেছে ওর উপাস্য।
ঘরের ভেতর কাজ করতে করতে অনেকক্ষণ ধরেই উপাসনার গলার গুনগুনানি শুনছিলেন উপাসনার মা।
কথাগুলোর এমনই এক অন্তর্নিহিত অর্থ রয়েছে যা উপাসনার মা’কেও ঘরে নিশ্চিন্তে কাজ করতে দিচ্ছিল না। কথার যাদু আর সুরের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে কখন যে উপাসনার মা ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি উপাসনা।
বারান্দায় এসে উপাসনার মা মেয়ের দৃষ্টি পথ ধরে দেখতে পেলেন ফুলসাজে সজ্জিত বালগোপাল রূপী নন্দলালাকে।
নীচে ফুলসাজে অপেক্ষারত বালগোপাল-এর সাপেক্ষে উপরে দাঁড়ানো আত্মজাকে রাধা ভেবে মুগ্ধ বিস্ময়ে নির্নিমেষ নয়নে বেশ কিছুক্ষণ উপাসনা-র মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের পাতা ভিজে উঠল উপাসনার মায়ের।
কোনোরকমে নিজের ভাবাবেগে অঙ্কুশ পরিয়ে উপাসনার মা মেয়ের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, উপাসনা-র দুচোখ দিয়ে উৎপন্ন অশ্রুধারা ওর ফর্সা দুইগালকে ভিজিয়ে পবিত্র স্রোতের মতো এগিয়ে চলেছে এক পবিত্র গন্তব্যস্থলের দিকে।
উপাসনার মা দেখলেন, ব্যালকনির উপরে ঝুঁকে দাঁড়ানো উপসনার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল ঝরে চলেছে নীচে শায়িত নবদুর্বাদল ঘনশ্যাম শ্রীকৃষ্ণ-র বুকের উপর।
মেয়ের এই অপ্রাকৃত রূপ দেখে উপাসনার মা-র মনে হতে লাগল, বৈশাখ মাসে তুলসি চারার উপর মাটির ফুটো ঘট ঝুলিয়ে যেমন তুলসি চারাকে সবসময় স্নাত করানো হয়, ঠিক তেমনি রাধার প্রেমাশ্রুও অনন্তকাল ধরে এভাবেই যেন কৃষ্ণর প্রেমিক হৃদয়কে স্নাত করিয়ে চলেছে।
মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে উপাসনার মা-ও কখন যে ভক্তিরসে জারিত হতে শুরু করেছেন সেটা উনি নিজেও বোধহয় ঠাওর করতে পারেননি। নিজের অজান্তেই তাঁর দুই হাত উঠে এসেছে বুকের কাছে। বুকের মাঝে দুহাত জড়ো করে একসময় তিনিও অস্ফুটে বলতে শুরু করলেন :
‘ওঁ নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণ হিতায়চ
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।
নমস্তে জলদাভাসে নমস্তে জলশায়িনে
নমস্তে কেশবানন্দ বাসুদেবায় নমস্তুতে।
হে কৃষ্ণ করুনাসিন্ধু দীনবন্ধু জগতপতে,
গোপেশ গোপিকাকান্ত রাধাকান্ত নমস্তুতে’।”