মোর বীণা আজি কোন সুরে বাজে – সত্যি কি মনো বিনা মনোবীণার কোনো দাম আছে ?
ড:পলাশ বন্দোপাধ্যায় ,কলকাতা ,১সেপ্টেম্বর ২০২০
আমরা মানুষেরা জীবকুলের মধ্যে সবথেকে বেশি দ্বিচারী।কি চাই,না চাই তা নিজেরাই বুঝিনা।অথবা আজ যা চাই কাল তা চাই না।ফলত ভাবনায়,চিন্তায়, মননে,আচরণে,সিদ্ধান্ত গ্রহণে সব ব্যাপারে আমরা দ্বিখন্ডিত।
আমাদের এই দ্বিচারিতা, দ্বিখন্ডত্ব জীবনে,সমাজে,জীবনধারণ বা জীবনচর্যা সর্বত্র;যদিও এতে আমাদের কোনো চ্যাতবোধ তাপ উত্তাপ নেই। আমিত্বে,অহং এবং বাগাড়ম্বরে আমরা প্রত্যেকেই স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ এবং সর্বদা অকারণে ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গায়ে ব্যাথা করে চলেছি সুকুমার রায়ের সেই চরিত্রটির মতো।আমরা যা বলছি তাই চূড়ান্ত।এর কোনো অন্যথা নেই,কোনো ব্যতিক্রম নেই,অন্য মানুষের অন্যরকম করে ভাবার এবং টিকে থাকার আলাদা করে কোনো অধিকার নেই।সমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট অণুপরিবার থেকে শুরু করে পৃথিবীর বৃহত্তম ইউনিট বিশ্বপ্রশাসন ও বিশ্বরাজনীতি পর্যন্ত সেই একই গল্প।শুধু নাটকের কুশীলবেরা নামে ও চরিত্রে পাল্টে যায়।বদলে যায়।
আপনি নতুন করে শুরু হওয়া কোনো একটা অণু পরিবার থেকেই আপনার কাহিনী ক্যালাইডোস্কোপে দেখা শুরু করুন।দেখবেন কোথাও একটা গিয়ে গল্পটা মিলে যাচ্ছে। অণু পরিবারে যখন প্রথম দুজন মানুষ যৌথ জীবন শুরু করে তার কিছুদিন পর্যন্ত থাকে মোহ বা ঘোরের পর্যায়। সে পর্যায় পেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই দুজনে নিজের মর্জির মালিক।দুজনের আলাদা পথ।পরস্পরের প্রতি অনাস্থা অবিশ্বাস অশ্রদ্ধা এবং অপ্রেম তখন যৌথ জীবনের মূল কথা।হয় নীরবে অথবা সরবে।এর কোনো অন্যথা কোনো ব্যতিক্রম নেই।কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণও নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে ভাঙনহীন সুখী সংসার যাকে মনে হয় অনেক ক্ষেত্রে, তাও আসলে একজনের চরম ত্যাগ স্বীকার করে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার ফলশ্রুতি।নিজেদের শৃঙ্খলে বাঁধতে গিয়ে এবং তাকে নিজেরাই ভুল প্রমাণ করতে গিয়ে আমরা, কখোনো শেষ না হওয়া বিশৃঙ্খলায় নিজেদের জড়িয়ে ফেলে যারপরনাই পুলকিত হই।শান্তি নেই,স্থিতি নেই,থিতু হওয়ার বাসনা বা তাগিদ নেই।শুধু কি চাইলাম অথচ কি পেলাম না সেই কখনো না শেষ হওয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে এবং তার শেষ ধাপের সন্ধান করতে করতে গিয়ে আমাদের গোটা জীবনটা কেটে যায়।
জিন আর পরিবেশের বৈচিত্রের কারণে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ চরিত্রগতভাবে ভিন্ন।ভিন্ন তাদের ভালো লাগা, ভালোবাসা সম্পর্কে ধারণা।ভিন্ন তাদের স্বাধীনতাবোধের গঠন,স্বকীয়তা ও জীবনশৈলী।এই সহজ সত্যিগুলো মেনে নিতে পারলে মানুষে মানুষে কোনো ক্ষেত্রেই কোনো বিরোধ থাকে না।কিন্তু ওই জায়গাটাতেই সব থেকে বেশি গন্ডগোল।পরিবার থেকে যৌথ পরিবার, তার থেকে পাড়া,
গ্রাম,শহর,মহকুমা,জেলা,রাজ্য,রাষ্ট্র,মহাদেশ,বিশ্ব সর্বত্রই পরস্পরের সঙ্গে লড়াই এবং তার কারণে রক্তক্ষয়,যুদ্ধ আর ধ্বংস।নিজেদের বোধ বুদ্ধির জোরে,বিজ্ঞান ও দর্শনকে সঙ্গী করে মানুষ প্ৰতি মুহূর্তে সাফল্যের সর্বোচ্চ বেঞ্চমার্কটাকে আরো উঁচু করলেও তার থেকে আবার নিজেদের খেয়োখেয়িতে মাটিতেও পড়তে হচ্ছে অহরহ।সর্বদা সেই শ্ৰেষ্ঠত্ব অর্জনের ফ্রী স্টাইল কুস্তি! এসব দেখে শুনে মাঝে মাঝে মনে হয় ,মেধা ও মননের সাথে সাথে যদি অন্যান্য পশু পাখিদের মতো ন্যূনতম শৃঙ্খলাবোধটাও আমাদের মধ্যে থাকতো তাহলে বোধহয় পৃথিবীটা এত তাড়াতাড়ি ধ্বংসের খাদের সামনে এসে দাঁড়াতো না।এরই নাম হয়তো শ্রেষ্ঠত্বের বিপন্নতা।