আত্মপ্রচার নয়, মগ্নচারী আত্মপথের স্রষ্টা শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়

0
1449
Sachin Banerjee
Sachin Banerjee
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:10 Minute, 51 Second

আত্মপ্রচার নয়, মগ্নচারী আত্মপথের স্রষ্টা শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়

তৈমুর খান

বীরভূমকে জানতে হলে যেমন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানতে হবে, এবং কয়লাখনি অঞ্চলকে চিনতে হলে যেমন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে জানতে হবে, তেমনি এই দুটি অঞ্চলকে চিনতে এবং জানতে গেলে শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও জানতে হবে । ১৯৩৯ সালে রামপুরহাট সংলগ্ন বড়শাল গ্রামে জন্ম । থাকেন এখানেই । পিতা ও মাতার নাম —বসন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্বেতবরণী দেবী।
কয়লা খনি অঞ্চলে দীর্ঘদিন চাকরি করতেন প্রশাসনিক আধিকারিক হিসেবে । সম্পাদনা করতেন “কৃষ্ণমৃত্তিকা” পত্রিকা। অবসর গ্রহণের পর সেটিরই নাম দেন “গিরিমৃত্তিকা”। স্বাভাবিকভাবেই তিনি গিরি এবং কৃষ্ণ এই দুই মৃত্তিকার মানুষের জীবনের কথাকার। তাঁর বাস্তবানুগামিতা সাবলীলতা চরিত্র চিত্রণের বিচিত্রতা প্রতিটি গল্পকেই আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পাঠককে ধরে রাখার ক্ষমতা অসাধারণ।

রাঢ় বাংলার ধূসর জীবনচিত্র, রাজনৈতিক উত্থানপতন, দিনবদলের নানা সংবাদ এবং পল্লিবাংলার জনমানুষের অন্তর্দর্শী জীবনকাহিনি তাঁর কথা সাহিত্যের বিষয় । অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল — “পরাজিত নায়ক”, “পরাজিতা অপরাজিতা”, “জনক জননী জন্মভূমি”প্রভৃতি উপন্যাস ।

“কালোমাটির মানুষ ও রাঙামাটির গল্প”, “মাটি ও মানুষের গল্প”, “জনভূমি”, “দ্বৈতস্বর”, “ছোট কাগজের ছোট গল্প”, “জনজীবন”, “কৃষ্ণমৃত্তিকার গল্প”, “ছোট গল্প পঁচিশ”, “নির্বাচিত গল্প পঁচিশ”, “সেরা ছোটগল্প পঁচিশ” প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ ।

“জীবনের ধারাপাত” স্মৃতিকথা মূলক গদ্য।

বাজারি কাগজের বাইরে থেকেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । আজীবন সচলও রাখতে পেরেছেন নিজেকে । প্রকৃতি মাটি ও মানুষের জীবনের সার্থক রূপকার বলেই যথার্থ অর্থেই তিনি বীরভূমের কথাসাহিত্যের পূর্বধারার উত্তরসূরী ।

রাঙামাটির পথের ধুলোয় ছড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস, কান্না, হতাশা, বেদনা ও স্বপ্নকে তিনি গল্পে তুলে এনেছেন। তারাশঙ্কর যেমন ম্রিয়মান ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের প্রতিচ্ছবি তাঁর কাহিনিতে বহন করেছেন, মানবজীবনের পটপরিবর্তনের সরল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়ও মানবসভ্যতার মেকি জৌলুসকে পছন্দ করেননি। যান্ত্রিক জীবনের হৃদয়হীন তাপ তাঁকেও দগ্ধ করেছে। মানবহৃদয়ের চিরন্তন প্রশান্তি ও স্বপ্নকেই তিনি অন্বেষণ করেছেন। তাই তাঁর জগৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, বাস্তববোধ সমৃদ্ধ। ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও হৃদয়পিপাসা যেমন সেসব জীবনে আছে, তেমনি আসঙ্গলিপ্সা, মাতৃত্ব এবং প্রেয়সী রূপও আছে। এক ঐতিহ্যমণ্ডিত অন্বয়ের ভেতর তিনিও জীবনের ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন। ডি এইচ লরেন্স নিজের লেখা সম্পর্কে এক জায়গায় বলেছিলেন :

“All I want is to answer to my blood, direct without fribbloing intervention of mind, or Moral, or what not.”

অর্থাৎ তিনি যে মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে, মানুষের রক্তমাংসকে পূর্ণরূপে মর্যাদা দিয়েছেন তা স্পষ্ট। উক্তিটি শচীন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কেও উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত মনে করি। সময় পরিবর্তনে কীভাবে প্রাচীন মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে, সন্তান পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব বা কর্তব্য ভুলে যাচ্ছে — এককথায় সম্পর্ক ছিন্ন করছে, রাজনীতির বাতাবরণে কীভাবে ধ্বংসাত্মক মনোভাব তৈরি হচ্ছে, কীভাবে অসহিষ্ণুতা দাম্পত্যজীবনের মধুর সম্পর্কে ভাঙন ধরাচ্ছে, পশ্চিমীদেশের প্রভাবে ভোগাকাঙ্ক্ষা কীভাবে চূড়ান্ত রূপে প্রবেশ করছে, গ্রামের সহজ সাবলীল রূপ কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে — সেসবেরই নিখুঁত পর্যবেক্ষণ আছে তাঁর লেখা গল্পগুলিতে। আর লেখক কলুষিত সভ্যতার চিরন্তন মানবের আকুতিটি শুনেছেন বলেই প্রবল জীবনীশক্তির চাপ উপেক্ষা করতে পারেননি।

শচীন বন্দ্যোপাধ্যায় আগাগোড়া বাঙালি বলেই বাঙালির আবেগকে তাঁর গল্পে স্থান দিয়েছেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত থেকে নিরক্ষর, চাকুরিজীবী থেকে বেকার, বয়স্ক থেকে যুবক, কিশোর-কিশোরী, নর-নারী সকলেই তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। সূক্ষ্ম জীবনদৃষ্টি এবং অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তি থাকায় গল্পগুলিকে জীবনের সমান্তরাল করে তুলেছেন। বাস্তবিক কোথাও অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। প্রতিটি গল্প জীবনের খণ্ড খণ্ড আকাশ আর সেখানে প্রবেশের দরজা মন, মননের গহন গভীর রাস্তা । ব্যক্তিত্ব, সংশয়, দ্বন্দ্ব, বিশ্বাসহীনতা, আভিজাত্য, অনুশোচনা, অবাধ্যতা, বিবেকহীনতা এক সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। তাই সাধু থেকে ভণ্ডামি পর্যন্ত, রাজনীতি থেকে কৃষি পর্যন্ত, স্বকীয়া থেকে পরকীয়া পর্যন্ত, অধ্যাপক থেকে মজুর পর্যন্ত জীবনের দৌড়ে কোথাও লেখককে আনাড়ি বলে মনে হয়নি। বরং মাটির কাছাকাছি পৌঁছে তিনি মাটির গন্ধ ও জীবনের শেকড় চিনিয়ে দিয়েছেন।

লেখকের ভাষা, শব্দ ব্যবহার, একটি শব্দে একটি বাক্য গঠনের রীতি, সাবলীল এবং স্বচ্ছন্দ গতি, রাঢ়ী উপভাষার ব্যবহার, অল্পকথায় বেশি বলার প্রবণতা পাঠকের বাড়তি প্রাপ্তি বইকি! গল্পের বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দার্শনিকও হয়ে উঠেছেন। কয়েকটি দৃষ্টান্ত অনায়াসে তুলে আনা যায় :
১. আঘাতে মানুষ শক্ত হয়। অবিশ্বাস অকৃতজ্ঞতা মানুষ চেনায়।
২. প্রেম পাকতে সময় লাগে। কাঁচা এবং পাকার মাঝখানে চলে প্রেমপর্ব। পরিণতি সংসারধর্মে অথবা বিচ্ছেদের বিরহ যন্ত্রণায়।
৩. যে গোরু দুধ দেয় তার চাট সহ্য করতে হয়।
৪. নরকের রাস্তা দিয়ে স্বর্গে যাওয়া যায় না।
৫. অপমান অসম্মান আঁতে আঘাত। গাছতলা আর সাততলায় একই সমান।
৬. অবেলার সূর্য নতুন দিন আনে — পুরনো সুন্দর অতীতকে ফিরিয়ে দিতে পারে না।
৭. ধান হলাম না আগড়া হলাম, কুলোর ডগায় নেচে মলাম।
৮. দগ্ধ হৃদয় চিহ্নহীন চিরকাল।
৯. শিক্ষিতা সুন্দরী বউ রাখাটাও এক ধরনের বনেদিয়ানা।

শচীন বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু গল্প লেখেন না, গল্পের ভেতরের গল্পটিকেও আবিষ্কার করেন। তাই একটি গল্প পাঠ করার পর তার রেশ বহুক্ষণ বাজতে থাকে। সমুদ্রের তরঙ্গের মতো গল্পগুলিও যেন মহাজীবনের ঢেউ। বাক্যবিন্যাস, শব্দবোধ, গীত ঝংকারে অপূর্ব গদ্যচাল। “শিকড়” নামে একটি মাত্র গল্প থেকেই এর প্রমাণ পাই :
১. মানুষের বৃত্তি প্রবৃত্তি বুঝতে অক্ষর চিনতে হয় না…
২ মানুষই ভিড় করে থাকে চিত্তে বৃত্তে প্রবৃত্তিতে।
৩. ধম্মো কম্মো তেথথো টেথতো হয়নি ভূপতির।

ছোট ছোট বাক্য, সহজবোধ্য উপমা, কথ্যভাষার সংলাপ, গ্রাম্যবাগধারার ব্যবহার গল্পগুলিকে জীবন্ত হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। কোনও গল্পেই অতিলৌকিকতার আমদানি করেননি। অতীত সময়ের সঙ্গে বর্তমানেরও একটা সাঁকো গড়ে দিয়েছেন, যার দ্বারা পাঠক সহজেই চলাচল করতে পারেন। বেশকিছু বাংলা দেশি শব্দ গল্পে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন লেলি, এঁটেপাকা, আমচুর, উসখুসুনি, সাঁতলা, বতর, উটপটাং, কাগাবগা, হড়বড়ি, হাতনুড়কো ইত্যাদি ।

দীর্ঘদিন সাহিত্যচর্চা করলেও এক মেধাবী উদাসীনতায় নিজেকে আড়ালে রাখতেই ভালবাসেন শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়। শহর তথাকথিত মেট্রোপলিটন আধুনিক জীবন-যাপনেও অভ্যস্ত নন, গ্রাম-বাংলার শান্ত নির্জন কোনও মনীষীলোকের আলোকে নিজেকে এবং সমগ্র মানবসত্তাকে দেখে নেন। শহরের জটিল যান্ত্রিক জীবনের বাইরে যে জীবন বিরাজ করছে তারই স্পন্দন শোনেন। আত্মপ্রচার নয়, এক মগ্নচারী আত্মপথেই তাঁর যাত্রা।

About Post Author

Antara Tripathy

Chief Editor & CEO of IBG NEWS (09/Aug/2018-Present), Secretary of All Indian Reporter's Association,West Bengal State Committee. Earlier Vice President of IBG NEWS (01/Jan/ 2013-08/Aug/2018). She took over the charge from the Founder Editor of the Channel.
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here