জনতার একতা – একটি বিনীত নিবেদন
PEOPLE’S UNITY is paramount
মোশারফ হোসেন
আমাদের দেশ ভারত এক মহৎ আশীর্বাদের মতোই। একদিকে সুউচ্চ পর্বতমালা, অন্যদিকে অনন্ত জলরাশি সমৃদ্ধ সাগর-মহাসাগর। মাঝে মরুভূমি থেকে মালভূমি, উপত্যকা থেকে সমভূমি। সবুজ বনানী থেকে বৃক্ষহীন রুক্ষ্ণ প্রান্তর- প্রকৃতির সমস্তরকম বৈচিত্রই আমাদের প্রিয় জন্মভূমির অঙ্গজুড়ে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।
ঠিক একইভাবে দেশের মানুষের ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক পরিচ্ছদ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, এমনকী নামের মধ্যেও নানান বৈচিত্র ভারতকে বিশ্বের দরবারে এক অনন্যসাধারণ পরিচিতি দিয়েছে। এই বৈচিত্র, এই সংস্কৃতি এই সভ্যতা একদিনে গড়ে ওঠেনি। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে চোখ ফেরালে দেখা যায়, ভারতের আদি পুত্র-কন্যারা যেমন দেশের আদি সংস্কৃতি নিয়ে প্রধানত আরণ্যক জীবন যাপন করতেন, তেমনি পরবর্তীকালে, আর্য থেকে শুরু করে শক, হুন, পাঠান, মোগল, পার্সি, গ্রিক, শৈব, বৈষ্ণব, মুসলিম, খ্রীস্টান প্রভৃতি নামের নানা জনগোষ্ঠী, নানা ধর্ম, নানা সম্প্রদায় এদেশকে স্বদেশ করে তুলেছেন। এদেশের সভ্যতায়, এদেশের সংস্কৃতিতে কম-বেশি প্রত্যেকেরই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আধুনিক ভারত সেই নানারকম সভ্যতা-সংস্কৃতিরই সমাহার। এই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যই ভারতের আত্মা। ভারতের অনন্যতা। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মূল শক্তি। নাগরিক একতাই আমাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ইদানীং সংকীর্ণ স্বার্থে, অসাধু উদ্দেশ্যে এক শ্রেণীর মানুষ ভারতীয় নাগরিকদের এই একতাকে আঘাত করতে, তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। কখনও ধর্মের নামে, কখনও বর্ণের নামে, কখনওবা অন্য কোনও বিষয়কে শিখণ্ডি খাড়া করে নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। তাদের ওই অপপ্রয়াস সফল হলে সামগ্রিকভাবে সমস্ত ভারতবাসীই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আঘাতপ্রাপ্ত হবে ভারত-আত্মা।
এই বিভেদকামী মানসিকতার বিরুদ্ধে সমস্ত ভারতীয় নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ রাখার লক্ষেই ‘জনতার একতা’ পথ চলা শুরু করল। এই সংগঠনের দরজা সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভারতীয় নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। সবার সক্রিয় সহযোগিতার প্রত্যাশায় এই সংগঠন উন্মুখ। ‘এক জাতি এক প্রাণ একতা’র মন্ত্রে সদা সমর্পিত থাকতে চায় ‘জনতার একতা’। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি আরও সমৃদ্ধিলাভ করুক। আমাদের জনগণ নিরাপদ পরিবেশে, পারস্পরিক প্রীতির আবহে প্রগতির এক এক জন সৈনিক হিসেবে দেশসেবায় নিয়োজিত থাকবেন, এটাই ‘জনতার একতা’র আকাঙ্ক্ষা। আমাদের মন্ত্র: সবার উপরে মানুষ সত্য। আমাদের আওয়াজ: জয় হিন্দ।
২.
‘জনতার একতা’- কৈফিয়ৎ
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, দেশজুড়ে এত রকমের সংগঠন থাকা সত্ত্বেও ‘জনতার একতা’ নামে ফের একটি নতুন সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজন হচ্ছে কেন? ওই বন্ধুদের এবং অন্য সবার জন্য প্রথমেই জানিয়ে রাখি, ‘জনতার একতা’ কোনও রাজনৈতিক দল বা দলের শাখা সংগঠন নয়। প্রধানত একটি সমাজকল্যাণমূলক ও সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। কিন্তু রাজনীতি সম্পর্কে উদাসীন নয়। বরং যথেষ্ট সচেতন। তাই এককথায় বলা যেতে পারে ‘জনতার একতা’ একটি রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন সমাজকল্যাণমূলক ও সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। যা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন দৃঢ়তর করে তাঁদের সামগ্রিক বিকাশের পথে এগিয়ে চলতে সাহায্য করবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজনৈতিক চেতনার কথা বলা হচ্ছে কেন?
উত্তরে বলি, আমরা সাধারণ নাগরিকরা দৈনন্দিন জীবনে রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও আমাদের প্রাত্যহিক জীবন রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হতে পারে না। নানান রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পড়েই, এবং আমরা তা মেনে নিতে বাধ্য হই। যেমন, ধরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইরানের শাসকদের রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ল। ইরান বা আমেরিকা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসবাস করলেও বসিরহাটের প্রতিটি চাষি বা বাঁকুড়া অথবা বহরমপুর কিংবা বর্ধমানের সাধারণ দোকানদারদেরও কিন্তু তার দায় খানিকটা হলেও বইতে হবে। কারণ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সমস্তরকমের পরিবহন যানের খরচ বাড়বে। ফলে বসিরহাট কেন, ভারতের যে কোনও প্রান্তের চাষিকে আগের চেয়ে বেশি দামে সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতি কৃষি উপকরণ কিনতে হবে। দোকানদারদেরও মালপত্র কিনতে হবে বেশি দাম দিয়ে। তারপর চাষকে উৎপাদিত ফসল বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে যেতে আগের চেয়ে বেশি পয়সা গুণতে হবে। একইভাবে দোকানদারকেও পাইকারি বাজার থেকে কেনা মালপত্র দোকান পর্যন্ত বয়ে আনতে বেশি ভাড়া বইতে হবে। সূতরাং চাষি ও দোকানদারকে তাঁদের পণ্যের দাম বাড়াতে হবে। দাম বাড়লেই বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। ফলে চাষির লোকসান বাড়বে, দোকানদারের লাভের পরিমাণ কমবে।
ওটা তো গেল বিদেশের কথা। দেশের মধ্যেও রাজনৈতিক কারণে ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। যেমন সাম্প্রতিককালে সর্বাধিক আলোচিত এনআরসি অথবা নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমাদের রাজ্য বাংলায় সাতে পাঁচে না থাকা নিরীহ নাগরিকদের কেউ এনআরসি বা নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের দাবি করেননি। কিন্তু এই দু’টি কার্যকর হলে তার ভালো-মন্দ দুই ধরনের প্রভাবই পড়তে পারে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জীবনে। এই দুইয়ের কারণে অনেকের সাজানো সংসার ভেঙে যেতে পারে, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হতে পারে, অকালমৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে( সম্প্রতি অসমে যা হল), আরও বহু রকমের হয়রানি ও দুর্দশার মুখে পড়তে হতে পারে অসংখ্য সাধারণ মানুষকে। এককথায় বলা যায় দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে শান্তিতে চালানো জীবন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে পারে।
এখানেই শেষ নয়, রাজনৈতিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশলে ধর্মীয় পরিচয়ের মাপকাঠিতে সমাজের মধ্যে বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা হতে পারে। আজন্মের প্রতিবেশী, সুখে-দুঃখের সাথীকে পরস্পরের শত্রু বলে দেগে দেওয়ার মতো অপকর্ম হতে পারে। আরও মারাত্মক কিছু ঘটিয়ে দেওয়াও অসম্ভব নয়।
আমাদের দেশ ভারত অসংখ্য উপাদানের সমাহারে, অজস্র মানবগোষ্ঠীর সম্মেলনে, বহু ধর্ম ভাষা প্রভৃতির সমন্বয়ে কয়েক হাজার বছর ধরে সমবেত কর্মক্ষমতায় আজকের এই রূপ পেয়েছে। এদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক পরিচ্ছদ, ভাবনা, সম্মান সাফল্য-সমস্তকিছুতেই সংখ্যাতীত মানুষের হাতের স্পর্শ যুক্ত রয়েছে। লেগে রয়েছে পরিশ্রমের ঘাম। এই ঐক্যই আমাদের সৌন্দর্য। আমাদের অনন্যতা।
এই বিষয়গুলি সম্পর্কে দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ অবহিত নন, এমন নয়। কিন্তু অনেক সময়ই তাঁদের অনেকেই এগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। সজাগ থাকেন না নিজেদের করণীয় সম্পর্কে। তাঁদের এই সচেতনতা, সজাগতা, একতার অভাবের সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষীরা ওই সব সাধারণ মানুষের বুকের ওপর দিয়ে নিজেদের সাফল্যের রথ চালিয়ে দেয়। মানুষ বাধা দিতে পারে না। স্বার্থান্বেষীরা হয়ত সফল হয়, কিন্তু সর্বনাশ ঘটে সাধারণ মানুষের। তার জের বয়ে চলতে হয় পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্মকেও।
তাই সাংস্কৃতিক ভাবনা যেমন দরকার, সাহিত্যের যেমন প্রয়োজন, সমাজকল্যাণমূলক কাজ যেমন জরুরি, ঠিক তেমনই জরুরি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবহিত থাকা। সুস্থ ও নিরাপদ জীবনের জন্য ভাষা ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষ ভারতীয় নাগরিকদের একতাই আমাদের আঘাত রুখতে সাহস জোগাবে, এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নির্বিঘ্নে জন্মভূমিতে জীবনযাপনের পরিবেশ দেবে।
সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চার পাশাপাশি সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়গুলি সম্পর্কে বিশিষ্টজনদের বক্তব্য শুনতে চায় ‘জনতার একতা’। সেই বক্তব্য ও বিশ্লেষণ শোনাতে চায় যুব প্রজন্মকে। তাদের মাধ্যমে অবহিত করতে চায় সর্বসাধারণকে। এজন্য এলাকায় এলাকায় আলোচনা সভা, সাহিত্য সম্মেলন, প্রয়োজনে পথসভা প্রভৃতি মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একসূত্রে গাঁথতে আগ্রহী এই সংগঠন। এরই পাশাপাশি চালাতে চায় স্বাস্থ্য পরিষেবা শিবির প্রভৃতি জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি। তাই, শুধু সাহিত্য নয়, শুধু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিই নয়, সমসাময়িক সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে চর্চার মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রয়োজনেই ‘জনতার একতা’ পথ চলা শুরু করেছে।
এই বক্তব্যের, এই লক্ষ্যের, এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত হলে আপনিও স্বাগত ‘জনতার একতা’য়।
জনতার একতা সংগঠনের সভাপতি মোশারফ হোসেন, সহ সভাপতি লেখক অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংবাদিক সুমন মুন্সি, লেখক ও সাংবাদিক জয়ন্ত সিংহ প্রমুখ।
জনতার একতা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ।
জনতার একতা সংগঠনের সদস্য হতে বা পরামর্শ দিতে কথা বলুন এই ফোন নম্বরে: +৯১ ৭০০৩৮২১২৯৮
লেখক: সভাপতি, জনতার একতা।