ড:পলাশ_বন্দ্যোপাধ্যায়,কলকাতা,০৬.০৭.২০২০
আপনি মধ্য চল্লিশের একজন সরকারি কর্মচারী।মফস্বল থেকে এসে রাজধানীর উত্তর শহরতলিতে লোন নিয়ে পূব দক্ষিণ খোলা গাছপালা ঘেরা একতলা বাড়ি বানিয়েছেন দু বছর হলো।আপনার স্ত্রী উচ্চশিক্ষিত হাউস ওয়াইফ।আপনি তাঁকে চাকরি করতে দেননি।দুজন চাকরি করলে ছেলে মেয়ে মানুষ হয়না সেই অজুহাতে।আপনাদের এক সন্তান।প্রাইভেট ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে।আপনি তৃপ্ত।আপনার খুব শখ ছিল এরকম একটা স্কুলে ছেলেকে পড়ানোর।সে স্কুলবাসে যাতায়াত করে।আপনার বাড়ির পাশেই বাসস্টপ।আপনার স্ত্রী ওকে বাসে তোলেন।বাস থেকে নামান।দিনকাল ভালো না।আপনি ওকে একলা ছাড়তে না করেছেন।আপনার বাড়ি থেকে অফিস পৌঁছতে বড় জোর দু ঘন্টা সময় লাগে আপনার।দশটায় অফিস পৌঁছতে,আপনি যাতে সাড়ে ছটার সময় গরম গরম মাছ সব্জি ডাল ভাত খেয়ে হাতে টিফিন বাক্স নিয়ে বেরোতে পারেন,আপনার ছেলে তার আধ ঘন্টা বাদে টিফিন নিয়ে খাবার খেয়ে স্কুল বাস ধরতে উঠতে পারে, তার জন্য রাত বারোটার সময় সব কাজ সেরে শুয়ে আপনার স্ত্রী আবার ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ উঠে পড়েন ঘুম ছেড়ে।আপনার অফিসে সময়ে পৌঁছনো নিয়ে কোনো কড়াকড়ি নেই।অফিসের পাশে ফুটপাথে অফিসপাড়ার খাবারের দোকানের সারি।
সেখানে আপনার অন্যন্য সহকর্মী নারী পুরুষদের সঙ্গে আপনিও ভিড়ে যান নটা নাগাদ।গুলতানি,চা খাওয়া ও হাবিজাবি আড্ডার শেষে অফিস ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে দশটা।ঢুকে বিভিন্ন বিভাগের বড়, মেজ, সেজবাবুর টেবিল ছুঁয়ে মিলি, শেলী, এশার খবর নিয়ে নিজের টেবিলে যান সাড়ে বারোটা নাগাদ।ততক্ষনে আপনি ভীষণ টায়ার্ড।আপনার খিদে পেয়ে গেছে।
স্ত্রীর বানিয়ে দেওয়া টিফিনের কৌটাটা খুলে পুরোনো বড় বিল্ডিঙের একতলার ঠান্ডা ঘরে আপনার টেবিলের স্তূপীকৃত ফাইল এক পাশে সরিয়ে পুরোনো পাখার নিচে বসে সেগুলো খেয়ে ফেলেন।তারপর চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে।ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দেড়টা।ততক্ষনে শিলিগুড়ি থেকে কোনো এক ভদ্রলোক একটা জরুরি ফাইল নিয়ে তদ্বির করতে এসেছেন আপনার কাছে।আপনিই ডিল করছেন সে ফাইল।আপনি নিজের হাঁ করা মুখের সামনে তুড়ি মেরে হাই তুলে তাকে অনায়াসে বলে দেন,’আপনি পরশু আসুন।আজ হবে না’।
তারপর সামনের টেবিলের ঘটকবাবু এসে গল্প জোড়েন, তার ছেলের বিয়েতে কি কি আইটেম হয়েছিল।সুইটি বিসয়াল এসে বলে যায়,’বড় হ্যান্ডসাম লাগছে আপনাকে।ম্যাডাম খুব যত্ন করছেন বোধহয়’।মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে সে সব কথা উড়িয়ে দিয়ে,আরো ঘন্টা দুয়েক কোনরকমে অফিসে কাটিয়ে সাড়ে তিনটে নাগাদ আবার অফিসের পাশের ফুটপাথের খাবারের দোকানগুলোর সামনে হাজির হন আপনি।আপনার খিদে পায়নি,তবুও একটা চিকেন কাটলেট দিয়ে এক কাপ কফি খেয়ে, দেশ কেন এগোচ্ছে না,কোন রাজনৈতিক দলের নেতারা কত শয়তান,কলিগদের সঙ্গে একপ্রস্থ এসব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেরে স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হন।সাড়ে পাঁচটার ট্রেন।
ট্রেনে উঠে অন্য ডেলি প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে তাস পেটানো,আড্ডা,হুল্লোড়,ঝগড়া করতে করতে সাতটা নাগাদ বাড়ির কাছের স্টেশন।নেমে হরেনের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা গরম আলুর চপ আর একটা বেগুনি খান।বাড়ির কথা,স্ত্রী পুত্রের কথা মনেই পড়ে না তখন। সাড়ে আটটা নাগাদ খুব ক্লান্ত ক্লান্ত ভাব করে বাড়ি।ফিরে স্ত্রীর হাতে অফিসের ব্যাগ,ছাড়া জামা কাপড়,টিফিন কৌটা দিয়ে স্নানে ঢুকে যান।আধঘন্টা পরে স্নান সেরে গায়ে পাউডার দিয়ে বারমুডা পরে বাইরে বেরিয়ে চা,স্ন্যাক্স আর পেপার নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে ব্যালকনিতে গিয়ে বসেন।দেশের সব খবর পড়া হয়ে যাবার পর নটা নাগাদ ডিনারের খোঁজ করেন।স্ত্রী বলেন,’এই তো দিচ্ছি। আর একটু অপেক্ষা করো’।আপনি খুব বিরক্ত হন তাতে।গোটা দিন বাইরে থেকে, স্ত্রীর ঘাড়ে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব চাপিয়ে, এমন কি মুদি বাজার,কাঁচা বাজার,মাছ মাংসের বাজারও কোনোদিন না করা আধদামড়া আপনি স্ত্রীর দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন,’গোটা দিন বাড়িতে বসে করো টা কি’?
ঘরানাটা মিলছে আপনার সাথে? না মিললে ,আপনি জাস্ট একটা ধারাবিবরণী শুনলেন।
আর মিললে? অভিনন্দন! আপনি একজন সফল গর্বিত গড়পড়তা বাঙালি।
●●●●●●●●●●●●●●
ড:পলাশ_বন্দ্যোপাধ্যায়,কলকাতা,০৬.০৭.২০২০