দলে বেনোজল ঢুকিয়ে এখন তৃণমূল ভুগছে ভবিষ্যতে বিজেপিও ভুগবে
হীরক মুখোপাধ্যায় (১ সেপ্টেম্বর ‘২০):- দলভারী করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দলে অবাধে বেনোজল ঢুকিয়ে তৃণমূল এখন ভালোরকম ভুগছে, ভবিষ্যতে বিজেপিও ভুগবে।
তৃণমূল কংগ্রেস যখন রাজ্য রাজনীতিতে প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পেলো, ঠিক সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেসের ঘরের ছেলে তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও খাদ্য সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছিলেন, “সিপিএম-দের একঘরে করুন, ওদের সাথে চা খাবেন না, ওদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করবেননা, আপনাদের উৎসবে ওদের আমন্ত্রণও জানাবেননা। আর স্থানীয় রাজনীতিতে তৃণমূল-এর ছত্রছায়ায় ওদের আসতে দেবেননা..।”
কিন্তু পরে দেখা গেলো, ঘরের ছেলের কথায় কান না দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস উল্টে ঘরের ছেলেকেই একঘরে করে দিল।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ইচ্ছাতে দল সেইসময় বামফ্রন্টের হিতেন বর্মন থেকে শুরু করে অন্যান্যদের মুড়ি মুড়কির দরে দলে নেওয়া শুরু করল।
ঠিক যে প্রক্রিয়ায় আজ তৃণমূলের ঘরে শোভা পাচ্ছে সুজিত বসু, তাপস চ্যাটার্জি-র মতো সিপিআই(এম) থেকে আসা নেতারা।
বামফ্রন্ট বা অন্য দল থেকে যে সমস্ত সদস্য পরে তৃণমূল কংগ্রেসে নাম লিখিয়েছেন, তাঁরা কেউই দলকে ভালোবেসে কাঁধে ঝাণ্ডা তুলে নেননি; বরং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পাশে থেকে ছলে বলে কৌশলে বেশ কিছু অর্থ কামিয়ে নিতেই দলে এসেছেন।
যে সমস্ত নেতারা নিজেদের আখের গুছনোর জন্য জার্সি বদল করে ভোটযুদ্ধে নেমেছিলেন বা পরে দলে এসেছেন, তাঁরা তো আপাদমস্তক চিহ্নিত, কিন্তু যাঁরা সমাজে সেরকম চিহ্নিত নন, তাঁরাই আজ রাজ্যে যেকোনো সমস্যা সৃষ্টির মূল হোতা।
খোঁজ নিলেই দেখা যাচ্ছে, সারা রাজ্যে যে সকল মানুষের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ‘কাটমানি সরকার’-এর ‘অক্ষয় তকমা’ গ্রহণ করতে হলো, এরা কেউই আদি তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য নয়, আদি তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্যরা আজ বেশিরভাগই হয় দলে পাত্তা পাননা বা দল থেকে অপমানিত হয়ে দলের সাথে আর কোনরূপ সংস্রবই রাখেননা।
তৃণমূল কংগ্রেসের নামে সারা রাজ্যে যেখানে যত মিড-ডে-মিল-এর চাল চুরি হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজন, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা বা ১০০ দিনের কাজ থেকে কাটমানি খাওয়া হচ্ছে বা আমফান পরবর্তী সময় ত্রান সামগ্রী বা টাকা অনৈতিক উপায় হাতবদল হয়েছে তাঁর মূল কারিগর তৃণমূল কংগ্রেসের এই বেনোজল তুল্য দলীয় সদস্যগণ।
একটু খোঁজ নিলে জানা যায়, একসময় তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের যাঁরা চরম অত্যাচার করেছেন, মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছেন, খুন করেছেন বা তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের ঘরের মহিলাদের শ্লীলতাহানি করেছেন বা ক্ষেত্রবিশেষে ধর্ষণ করেছেন, তাঁরাই আজ তৃণমূল কংগ্রেস কার্যালয়গুলো আলো করে বসে থাকেন। যাঁদের কারাগারে বা যমের বাড়ি যাওয়া খুব দরকার ছিল দলে তাঁরাই আজ জামাই আদর পেতে পেতে গদিতে ঠেলে উঠেছে।
এই বেনোজল তুল্য নেতারা একসময় নিজেদের পিঠ বাঁচাতে তৃণমূল কংগ্রেসের অতিমূর্খ বা অতিলোভি নেতাদের হাত করে দলে ঢুকে, প্রথম দিন থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসেরই বড়ো সর্বনাশ করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
পাঠকদের নিশ্চয়ই খেয়াল আছে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক যে সময় দলে বেনোজল ঢোকাতে নিষেধ করছিলেন, সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেস ছিল প্রায় নিষ্কলুষ।
আজ এই বেনোজলই তৃণমূল কংগ্রেসের বড়ো বিড়ম্বনা, তৃণমূল আজ এদের ছেঁটে ফেলতে গেলে মস্তানবাহিনী ও বাহুবল যেমন হারাবে তেমন ভোটও হারাবে। আবার উল্টোদিকে এদের প্রশ্রয় দিয়ে দলে রাখলে মানুষের কাছে তৃণমূল কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
সত্যি কথা বলতে গেলে, আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই আটকে গেছেন। সেদিন তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মলগ্নের সঙ্গী ঘরের বাধ্য ছেলে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথায় কান দিলে মমতাকে আজ এতটা নাকানিচোবানি খেতে হতনা।
সেদিন দলের মাথামোটা যে নেতারা সামান্য কিছু ফায়দার জন্য ও জ্যোতিপ্রিয়র বিরুদ্ধাচরণ করার প্রয়োজনে মমতাকে প্ররোচনা দিয়েছিলেন, তাঁরা আজও ক্ষমতার ক্ষীর চেটে পুটে খেলেও তৃণমূল কংগ্রেস নিজেই আজ রক্ত সঙ্কটে ভুগছে। এই মুহূর্তে ঠিক কী করলে দল যে আবার সুস্থ হয়ে উঠবে তা মমতাও ভালোভাবে জানেননা। তাই দুমদাম বেফাঁস কথা বলতে অভ্যস্ত মমতাও এক সভায় জনৈক পুলিস কর্তার সাথে কথা বলতে গিয়ে বলে ফেলেছেন, “আমি বেশিদিন থাকবনা বুঝেই কী কাজে ফাঁকি দিচ্ছ… ।”
দলে অবাধে বেনোজল ঢুকিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস আজ যেমন ফাটাবাঁশে আটকে পড়েছে, একদিন ঠিক এভাবেই হাহুতাশ করবে রাজ্য বিজেপি।
এমনিতে এখন থেকেই বিজেপি নেতা এবং সাংসদদের নামে যেভাবে দুর্নীতি থেকে নারী নির্যাতন এমনকি ধর্ষণের অভিযোগ আসছে, তাতেই রাজ্যবাসীকে শিউরে উঠতে হচ্ছে।
বিজেপি এমনিতে বলে বেড়ায় তাঁরা নাকি ভীষণ সংঘবদ্ধ, সংঘশক্তির জোড়েই তারা নাকি অসাধ্য সাধন করতে পারবে।
কিন্তু রামভক্ত বিজেপিরা এটা বোঝেনা, দলে একটা পচা আপেল ঢুকে এলে কদিনের মধ্যেই পুরো দলটাকেই পচিয়ে দিতে পারে ওই একটা পচা আপেলতুল্য ব্যক্তি।
এই মুহুর্তে দলভারী করার জন্য এসএমএস মাধ্যমে দল বাড়াচ্ছে রাজ্য বিজেপি। এই প্রক্রিয়ায় খাতায় কলমে হুহু করে দল বাড়ছে। সকালে দুজন সদস্য, দুপুরে চারজন সদস্য, বিকেলে ছয়জন সদস্য, সন্ধ্যায় দশজন সদস্য, রাতে কুড়িজন নতুন সদস্য দেখে বিজেপি নেতারা আনন্দে নিজেদের পিঠ নিজেরাই চাপড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু আহাম্মক নেতারা একবারও ভেবে দেখছেননা এই অচেনা লোকগুলো কে, কী উদ্দেশ্যে তাঁরা দলে সামিল হচ্ছেন, এরা সত্যি কী ভবিষ্যতে দলকে সমর্থন (ভোট) দেবেন !
ভুলে গেলে চলবেনা, মমতার থেকে বেশি ভালো করে পশ্চিমবঙ্গকে চেনেন এমন কোনো নেতানেত্রীকে পশ্চিমবঙ্গ এখনো পায়নি।
আরএসএস-এর ছত্রছায়ায় বড়ো হওয়া দিলীপ ঘোষ তো মমতার কাছে নেহাতই শিশু মাত্র।
বিজেপির যে কেন্দ্রীয় নেতা তাঁর নিজের রাজ্যকে ঠিকভাবে চেনেননা তিনি কী পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারবেন।
তিনি কী জোড় দিয়ে বলতে পারবেন – বেনোজল আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। না পারবেননা।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, মুকুল রায় বা শোভন চ্যাটার্জি কেউই বেনোজলের মতো বিজেপিতে ঢোকেননি, বরং কেন্দ্র ও রাজ্য বিজেপি বিস্তর ভেবেচিন্তে সাধ্য সাধনা করে এঁদের দলে এনেছিলেন।
কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিজেপি এই দুজনকে নিয়েই বেশি বিব্রত।
এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে সব থেকে বড়ো ভাবনার বিষয়, যে সকল পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলাপরিষদ সদস্য বা বিধায়ক আজ অন্য দল থেকে বিজেপিতে এসেছেন, আগামীদিনে এঁরাই বিজেপির মাথা ব্যথার কারণ হবে নাতো ?
ইতিমধ্যে কয়েকদিন আগেই একজন বিধায়ক পুনরায় দলবদল করে নিজের স্বরূপ চিনিয়ে দিয়েছেন।
মাথায় রাখতে হবে, আজ কেউই স্বার্থ ছাড়া একপাও হাঁটেনা। যাঁরা দুমদাম বিজেপিতে আসছেন বা যাঁদের না ভেবেই দল সদস্যপদ দিচ্ছে আগামীদিনে এরাই বিজেপির শিরোপীড়া-র কারণ হবেনা তো !
পচা শামুকের খোলার ঘায়ে তৃণমূল কংগ্রেসের এখন যাত্রাভঙ্গ হওয়ার জোগাড়, আগামীদিনে রাম নামের মাহাত্বে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি কী সম্পূর্ণ অক্ষত থাকতে পারবে ?
এখনও পর্যন্ত যে ঝলক পাওয়া যাচ্ছে, তাতে করে বোঝাই যাচ্ছে বিজেপিরও শেষের শুরু আরম্ভ হয়ে গেছে।