শিক্ষায় শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় ভাগ্য পরিবর্তন হয়

0
990
নজরুল ইসলাম তোফা:
নজরুল ইসলাম তোফা:
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:26 Minute, 13 Second

শিক্ষায় শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় ভাগ্য পরিবর্তন হয়

লেখকঃ নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।

নজরুল ইসলাম তোফা:: জীবন কর্ম ব্যস্ততায় হাজারও মানুষ যেন হারিয়ে ফেলছে অতীতের বিশেষ কিছু স্মৃতি আর যেন নেতিবাচক রাজনীতির ভীড়েই হারিয়ে যাচ্ছে আমার, আপনার আমিত্ব। ক্ষীণ হয়ে আসছে আমাদের সম্প্রদায়। হাটে-ঘাটে-মাঠে যেখানে যাই, সেখানেই দেখি সবাই এক একটা রাজনীতিবিদ।

স্নায়ুযুদ্ধের রনক্ষেত্রেই আছে পুরো সমাজ সংস্কৃতি বা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম। মন’কে প্রশ্ন করি হাজারো বার। মন আমার কোথায়! প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েই কিনা উত্তর দেয়, ‘শৈশবে’। যেকোনো পেশায় আমার অবস্থান আসুক না কেনো, শৈশবের এক একটা স্মরণীয় স্মৃতিময় মুহূর্ত ভুলবার নয়। হঠাৎ আজ খুঁজেই পেলাম স্মৃতির মলাট উল্টিয়ে প্রদ্ধেয় স্যার ছবের আলী সাহেবের মৌলিক কিছু গল্প।  

পাঁজর ভাঙ্গা গ্রামেই সরকারি প্রাথমিক স্কুলের একজন ধার্মিক শিক্ষিক ছবের স্যারের কথা আজ স্মরণ হলো। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। স্যারকে দাঁড়িয়ে সকল ছাত্র- ছাত্রীর যে ছালাম দেয়ার রেওয়াজ উনিই শিখিয়ে ছিল। সকল ক্লাসেই স্যারও অনেক জোরে ওয়ালেইকুম ছালাম বলতো, তাঁর আরো এক অভ্যাস ছিল, তা হলো ছালাম গ্রহন করবার পরেই রোজ তিনি “আই লাভ ইউ অল”সহ সিট ডাউন শব্দ উচ্চারণ করে নিজের চেয়ারে বসেই সবার দিকে দৃষ্টি ভালো ভাবে দিতেন। ‘আই লাভ ইউ অল’ তিনি যে বলতেন, তার গুরুত্ব তখন একবারও ভাবে দেখেনি। তিনি জানতেন, তিনি সত্য বলছেন এবং সবাইকে ভালোবাসার কথাটা বলছেন। উনার ধারনাতে ছিল, নিজের ক্লাসের সবাইকে এই রকমভাবে ভালবাসা দিয়ে আপন করা যায়। 

আমি তখন একজন বাচ্চা ক্লাসে আমাকে তিনি মোটেও সহ্য করতে পারতোনা। আমার ছিল খুব পুরোনো ময়লা জামা-কাপড়, তা পরে স্কুলে যেতাম। নিজের মাথার চুল গুলি থাকত অনেক উষ্কো-খুষ্কো, আবার খোলাও থাকে নিজ জুতার বকলেস,শার্টের কলারটাতে অসংখ্য ময়লা দাগ, ক্লাসে পড়া বোঝানোর সময়ও আমি থাকি অনেক উদাসিন বা অন্য মনস্ক। শিক্ষিকের বকুনি খেয়ে, চমকে গিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়েই থাকতাম। কিন্তু- আমার শূন্য দৃষ্টি দেখে স্পষ্ট বোঝা যেতো, আসলেই শারীরিক ভাবে ক্লাসে উপস্থিত থাকলেও ‘আমার মন’ যেন অন্য জগতে উধাও হয়ে গেছে। সেই “ছবের স্যার” আমার প্রতি ধীরে ধীরেই যেন মনের ঘৃণা বাড়াতে থাকলো। 

আমি ক্লাসে ঢুকতেই, স্যারের খুব সমালোচনার শিকার হতে হতো। নানা খারাপ কাজের উদাহরণই যেন আমার নামে হতেই থাকে। বন্ধুরা আমাকে দেখে আর খিলখিল করে হাসে, স্যারও আমাকে অপমান করে আনন্দ পান। আমি যদিও এসব কথার কোনও উত্তর দিতামনা। স্যার আমাকে নিষ্প্রাণ পাথর বলে যেন মনে করতো, আবার বলেও বসতো যার মধ্যে অনুভূতি নামে কোন জিনিসটা নেই সে এই তোফা। তাঁর সমস্ত ধমক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর শাস্তির জবাব না দিয়েই শুধু মাত্র নিজের ভাবনায় শূন্য দৃষ্টিতেই থাকতাম। আমার মাথাটা যেন অনেক নীচু হয়ে যেতো। এভাবে আমি স্যারের অত্যন্ত বিরাগ ভাজন হয়ে উঠলাম।
অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার শেষ হয়েছে, ফলাফল বেরোনোর সময়ে স্যার রেজাল্ট কার্ডে আমার সম্পর্কে সব খারাপ কথা লিখে l মা -বাবাকে দেখানোর আগে রিপোর্ট কার্ড হেড স্যার ‘আজিজার রহমানেরকে’ দেখিয়ে ছিল। তিনি আমার ফলাফল দেখে এবং ছবের স্যারকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে বলেছিল, নজরুল ইসলাম তোফার রিপোর্ট কার্ডে কিছু অনুপ্রেরণার কথা লেখা উচিৎ ! আপনি তো এমন কথা লিখে আমাকে দেখাচ্ছেন,- তা যদি তোফা’র বাবা-মা দেখে একদম নিরাশ হয়ে যাবেন।” শ্রদ্ধা ভাজন সেই স্যার বলে ছিলেন, “আমি মাফ চাই, তোফা একদম খারাপ আর নিষ্কর্মা ছেলে। আমার মনে হয় না যে আমি ওর সম্পর্কে ভাল কিছু লিখতে পারবো!”  স্যার ঘৃণাতেই এমন কথা বলে চলে গেলেন ক্লাসে। 

প্রধান শিক্ষক ঠিক তখনই এক অদ্ভুত ব্যাপার করলেন, উনার সংগ্রহে থাকা আমার আঁকা একটি বড় নৈস্বর্গিক মনোরম পরিবেশের দৃশ্যটাকে, ছবের স্যারের টেবিলের ওপর রেখেই রিপোর্ট কার্ড তার উপরে রেখে দিয়েছিল। বলে রাখি, আমি অনেক ছোট থেকে চিত্রাঙ্কন করতাম। যাক, পরেরদিন যখন ছবের স্যার স্কুলে এসে অফিসের টেবিলে বসতেই রিপোর্টটা’র ওপরে নজর পড়তে, উল্টে দেখে সেটা আমারই রিপোর্ট কার্ড। আবার রিপোর্ট কার্ড রাখতেই স্যারের দৃষ্টিটা পড়ে আমার আঁকা সেই দৃশ্যে’র প্রতি। একাগ্র চিত্তে ভাবছিল, তোফা তা হলে এসব করে সময় কাটায়, এর তো কখনোই লেখাপড়া হবে না। তিনি রিপোর্টের মন্তব্যের দিকে দৃষ্টি দেয় আবার আঁকা ছবিটা দেখে, ঠিক এমন করতে করতেই চেয়ে দেখে অফিসের দরজার সামনে প্রধান শিক্ষক আজিজার রহমান স্যার।
প্রধান শিক্ষকে উদ্দ্যেশ্য করে ছবের স্যার বলে ছিল এই গুলো করেই তোফা অধঃপতনে যাচ্ছে, প্রত্যেক বছরেই সে নিশ্চয়ই এরকম অপ্রয়োজনীয় কাজ করে রেজাল্ট খারাপ করে। এমন কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই হেড স্যারও কথা বলা আরম্ভ করেছিলেন, রিপোর্টের মন্তব্য আপনি অনেক ভালো লিখে দিন। তোফার মতো বুদ্ধিমান ছেলে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। এ অতি সংবেদনশীল ছেলে এবং নিজের সহপাঠী আর শিক্ষকের প্রতি সম্মান এবং সহযোগিতা করে অন্য ভাবেই, তা আপনার বুঝার চেষ্টা করতে হবে। সে কথা শুনে ছবের স্যার রিপোর্টের মন্তব্য ইচ্ছা না থাকলেও ভালো লিখেছিল। আমার মনে আছে হেড স্যার আমার প্রতিভার মূল্যায়ন করতো এবং কাছে ডেকে নিয়ে আদর করেই বলতো, তুমি একদিন খুব বড় হবে, তুমি ছবি অ়ঙ্কনের জায়গায় বুদ্ধিমান ছেলে। সবাই তো ছবি আঁকার কাজে পারদর্শী হয় না, তুমি তো এমন অসাধ্যকেই সাধন করতে পার। তোমার প্রতি প্রানখুলেই দোয়া রইলো বাবা। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা তোমার জন্যে খুবই মঙ্গলজনক হবে, তাহলো ছবের স্যার একটু ধর্মপরায়ন ব্যক্তি তোমাকে কিন্তু ভালোবাসে। লেখাপড়া ভালো করে করবে বাবা দেখবে আমার চেয়েও ঐ স্যার তোমাকে ভালবাসবে এবং ভালবাসা বুঝতে দিবে।

প্রধান স্যারের এই ‘উপদেশ’ কেন জানি ভালো লাগলো।বাড়ির পাশে আত্রাই নদীর পাড়ে বসে একাকীত্বেই চিন্তা করছি আমাকে লেখাপড়ায় মনোযোগী হতেই হবে। অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে কিন্তু বাকি মাত্র ৬ মাসে কি আমার পক্ষে কখনো ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। এমন অন্তিম সময় যদিও, তবুও আমি দ্বিতীয় স্থান আধিকার করি। আমার টার্গেটটা ছিল প্রথম স্থান আধিকার করা।এবার ছবের স্যার রিপোর্টের মন্তব্য সকল স্যারের চেয়ে অনেকাংশেই ভালো করে। আমার এইধরণের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার রিপোর্ট কার্ড পড়ে পরিবারের সবাই অনেকটা খুশি। কিন্তু আমি “প্রথম স্থান” আধিকার করতে পারিনি বলেই একটু চিন্তায় আছি। আমার টার্গেট মিস হয়েছে। কিন্তু ক্লাসের বন্ধুদের আশ্চর্যের সীমাটা দেখে আবারও নতুন চিন্তা মাথায় ঘুরপাক করছিল। সেটা অবশ্য আমি পজেটিভ চিন্তা করেছি।

স্মৃতির এমন অধ্যায় যেন আমার কাছে সবচেয়ে সুখের ছিল, ‘অস্থির বা উদাসীন’ ভাবটা প্রায় কেটে গেল। স্যার ইতিমধ্যেই আমাকে সবচেয়ে ভালোবাসা দেওয়া আরম্ভ করেন, আমি পড়ালেখায় গভীর মনোযোগী হলাম। ৪ র্থ শ্রেণী থেকে ৫ ম শ্রেণী পাস করলাম ১ ম স্থান আধিকার করে। ছবের স্যার সে মুহূর্তে আমার ফলাফলের রিপোর্ট লেখার আগেই উনার কাছে ডেকেছিল, মনে পড়ে আমি বিকেল বেলা স্কুল মাঠে ফুটবল খেলছি। স্যার প্রতি দিন স্কুল ছুটির পরেও কেন জানি স্কুলে থাকেন, জানা নেই। আমার সেই স্কুল বাড়ির পার্শ্বে। তাই, আমরা বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া সম্পূর্ণ করে ফুটবল নিয়ে স্কুল মাঠে এসে স্যারকে অফিসের রোমেই দেখতে পাই। স্যার আছরের নামাজ উদ্দ্যেশে ওজুর বদনা হাতে নিয়ে সেই অফিসের বারান্দায় এসে আমাকে ডাকলেন। আমি খুব আতঙ্কিত হয়েই সরকারের কাছে গেলাম। সে স্যার আমার জড়তা অনুভব করেই বললেন ভয় পাচ্ছ কেন, আমি তোমাকে আগে চিনতে পারিনি। তোমার হেড স্যার আমার দুচোখ খুলে দিয়েছে। আমি তো তোমার এবারের রেজাল্টে খুব খুশি বাবা। ফলাফল ঘোষণার আগে কাউকেই জানানো হয় না তবুও তোমাকে জানাচ্ছি কাউকে বলবে না। তুমি প্রথম হয়েছ। যাও এবার খেলাধুলা করো, কিন্তু স্যারের কথায় খেলা আর ভালো লাগে না, খেলছি আর ভাবছি স্যার কি শুনাল। স্যার আমার খেলা দেখছে কিন্তু আমি তো খেলতে পারছিনা। আমার মনের এমন আনন্দ যেন মাঠের খেলোয়াড়রা টের পাচ্ছিল এবং তারা বলে ছিল তুই স্যারের কাছে গিয়ে আর খেলতে পারছিস না কেন! আমি তো অনুভূতিতেই আছি, স্যারের নির্দেশ এ কথাটি আমি কাউকে না বলি। না আর পারছি না উত্তেজনা বাআনন্দটা লুকিয়ে রাখতে, তাই খেলার মাঠ থেকে হঠাৎ পালিয়েই আত্রাই নদীর পাড়ে কাশবনের আড়ালে চলে গেলাম। আশ্চর্য হবার কিছু নেই, আমি খুব ছোট থেকে কবিতা লিখতাম এবং আবৃত্তিও করতাম। এগুলো কেন যে ভালো লাগতো তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। সেসব নিয়ে অনেক কথা, এ স্মৃতি চারণে তা আলোচনা করছিনা। তবে বলতেই হবে আগে কখনো স্বরচিত গান রচনা করিনি, কিন্তু আমার গানের শব্দ যেন অনায়াসেই চলে আসছে।

সুতরাং সে গানটা রচনা করছি আর উচ্চ স্বরে গাওয়ার চেষ্টা করছি যেন অন্য কোনো চিন্তা আমার মাথাতেই না আসে। সেখানের ঐ গানটা ঠিক এমন ‘আমার মন বলে গো হবোই হবো,…কি হবো তা জানি না।….জানলে পরে সোনার জীবন বৃথা যাইতো না গো।…কুলে মোর ভিড়বে তরী,….সদাই আমি ভেবে মরি,….ভাবনা আমার ভাবেই থাকে,..কাজের রূপ তো লয় না।…..লইলে পরে সোনার জীবন বৃথা যাই তো না গো।….ঘৃণার রথে শূন্য পথিক,.. জয় করে পায় সোনার হরিণ,..কি যতনে রাখবে তারে,.. ভেবে কুল পায় না,…চাইলে পরে সোনার জীবন,….বৃথা কর্মে হয় না..আমার মন বলে গো হবোই হবো,..কি হবো তা জানি না।..জানলে পরে সোনার জীবন,.বৃথা যাইতো না গো।

কয়েক দিন পর স্কুলে পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিন তার আগেই সকল ছাত্র/ছাত্রীর অভিভাবকদের নিকট চিঠি দিয়ে স্কুল মাঠে উপস্থিত হওয়ার জন্যে জানালেন। সকল ছাত্র/ছাত্রীদেরকে স্কুল মাঠে লাইন করে বসিয়েই রেজাল্ট ঘোষণার পালা শুরু। শিক্ষক ও অভিভাবকরা সব ছাত্র/ছাত্রীদের উপদেশ বক্তব্য দিলেন। প্রতিবারের ন্যায় সেবারও সেই স্কুল মাঠে বার্ষিক পরীক্ষার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান হবে। আমি মনে মনেই ভাবছি, আমার বন্ধু বকুল প্রত্যেকবার প্রথম স্হান অধিকার করে কিন্তু  এবার আমি প্রথম হয়েছি, এ খবরটা আমিই শুধু জানি।  বেশ আনন্দে আছি আমি। সারা বছর এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করতো সকল অভিভাবকরা। শুরু হলো- একে বারে ১ম শ্রেণী হতে রেজাল্ট ঘোষণা। শুধুমাত্র যেসকল ছাত্র/ছাত্রীরা ১ম, ২য় বা ৩য় স্হান অধিকার করে ছিল তারাই শুধুমাত্রই স্কুল মাঠে আছে। অভিভাবকরা এবার আমাদেরকে গভীর মনোযোগ সহকারে দেখছে আমিও দেখছি ‘অল্প সংখ্যক ছাত্র/ছাত্রী স্কুল মাঠে’ আছে, সেটা লক্ষ্য করছি এবং মনে ফুর্তিতেই আছি। যাক, আবারও ১ম শ্রেণী থেকে ১ম, ২য় বা ৩য় স্হান অর্জনকারীর নাম ও পুরস্কার বিতরণের আরম্ভ হলো। সর্বশেষেই ৪র্থ শ্রেনী থেকে ৫ম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হবে এমন তিন জন স্কুল মাঠে আছে। সেখানে সেদিনটার পরিবেশ যেন সম্পূর্ণ স্তব্ধ বা একেবারে কোলাহল মুক্ত। বকুল, সেলিনা সহ আমি এই মাঠে আমাদের উদ্দেশ্যে হেড স্যার বক্তব্য রেখেছিলেন, তার দু’একটা কথা না বললেই নয়। জয়পরাজয় থাকবে কিন্তু তোমরা তিন জনেই পরিশ্রম করে মেধা তালিকাতে এসেছ। রেজাল্টে প্রথম যে হয়েছে তার নামটাই ঘোষণা হবে পরে। তোমরা তিন জনেই প্রতিযোগিতায় কেউ কম নও। পরীক্ষামূলক বার্ষিক পরীক্ষাতে শুধুমাত্র ৫ মার্কের ব্যবধানে একজন প্রথম স্হান অধিকার করেছ। যে ‘২য় স্হান অধিকার’ করেছ, তুমিও অনেক ভালো ছাত্র। মন খারাপ করবে না। বলেই তিনি ৩য় স্থান অধিকার করেছ  মোসাঃ সেলিনা পারভীন নাম উচ্চারণ করেছিল। আমি ও বকুল মাঠে, বকুল জানেই আমি তো প্রত্যেকবার ১ম হই, আর আমিও ছবের স্যারের কথায় বুঝতে পারছি এ পরীক্ষায় বকুল ২য় হবে এবং আমি ১ম হবো। ঠিক যেন তাই ঘরে গেলো। আমি প্রথম স্হান অধিকার করে হেড স্যার সহ সকল স্যার এবং অভিভাবকদের ছালাম দিয়ে দোয়া নিলাম। সেইদিনটা হৈ-হুল্লোড়, আনন্দ-কোলাহল, আমোদ-কৌতুকে কেটে গেল। বিজয়ী পুরস্কার ও প্রথম হওয়ার মজাটা আজঅবধি যেন হৃদয়ে গেথে আছে।

তারপর থেকেই সবার সাথে ভালো আচরণ বা নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া এবং লেখা পড়ায় মনোযোগী হওয়া জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় থাকতাম। তখন থেকে ছবের স্যার আমার সাথে ভালো ব্যবহার বা প্রসংসা করে। খুব উল্লেখযোগ্য আর একটা বিষয় মনে রাখার মতো গুরুত্ব পূর্ণ তা হলো, প্রত্যেক বছর ছাত্র-ছাত্রীদের হাতের কাজ জমা দিতে হতো। সুতরাং আমি বরাবরই একটু আলাদা  ও নতুনত্ব ভাবনায় মসগুল থাকি। তাই সেবার সচরাচর তা করে থাকি তা সকল শিক্ষকদেরকে করলাম, একটি করে লাক্স সাবান দিয়েলাম। কিন্তু ছবের স্যারের জন্যই শুধু বিকল্প চিন্তা মাথাতে ভর করে ছিল। আমার বাবার সংগ্রহে রাখা ‘নামাজ পড়া টুপি’, আর আমার নানী মারা যাওয়ার পরেই রেখে গিয়েছিল একটি তসবি ও ব্যবহৃত  জান্নাতুল ফেরদাউস আতর, তা নিজের হাতেই প্যাকেট করে ‘প্রদ্ধেয় ছবের’ স্যারকে দিয়ে ছিলাম। অবশ্যই সেই সুগন্ধি আতরটা আমার নানী ব্যবহার করে কমিয়ে হাঁফ শিশি করেছিল।

ধর্মপরায়ন সেই শিক্ষক আমার ক্রিয়েটিভ প্রতিভা দেখে অবাক হয়েছিল। প্রতিদিন স্কুলে আসেন আমার দেওয়া আতর, টুপি এবং সুগন্ধি আতরগুলি লাগিয়ে। জান্নাতুন ফেরদৌস আতরের ঘ্রাণ ক্লাসে শুধু আমিই বুঝতে পারি অন্যরা কেউ জানতোনা। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এই ঠাণ্ডার যুদ্ধ করতে করতে ‘পঞ্চম শ্রেণী’ থেকে পাস করে স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়। চলে যাই, চকউলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে। তবুও সেই স্যারের সাথে প্রতিদিন দেখা হতো এস,এস,সি পাস করা পর্যন্ত। কারণ, আগেই বলে ছিলাম আমার বাড়ির পাশে পাঁজর ভাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল। ‘চকউলী হাই স্কুলের’ ছুটির পরেও বাড়ি এসে খাওয়াদাওয়া শেষ করেই ফুটবল মাঠে গিয়ে সে স্যারকে অফিসে দেখি। তখনো আমাকে ঠেকে নিয়ে মজার মজার গল্প করেছিল। আমার সেই শৈশবের দিন আর স্কুলের গল্প করতে গেলেই শিক্ষকদের কথা আগে চলে আসে। বন্ধু ছাড়া অনেক “গল্প কিংবা কাহিনী” দাঁড় করানো যায় কিন্তু স্কুল শিক্ষককে বাদ দিয়ে নয়। শৈশব আমি চিন্তা করতেই পারি না এ শিক্ষকগুলোকে আমার অস্তিত্ব মনে হতো। কে বেশি কাছের, তা আলাদা করাটা কঠিন।

অনেক কথার মাঝে মৌলিক কথা গুলো বলে শেষ হবে না। স্কুল, বন্ধু, শৈশব ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে আবারও ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তাতো যে আর সম্ভব নয়। সময়ের স্রোত অতীত ফিরিয়ে দেয় না। তাই স্মৃতি হাতড়ে বেঁচে থাকতেই হয় জীবনভর। সুতরাং এ কথাটা বলবো, শিক্ষায় শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় ভাগ্য পরিবর্তন হয়। আমার ভাগ্য পরিবর্তনের “প্রধান শিক্ষক আজিজার রহমান” বেঁচে থাকলেও “প্রদ্ধাভাজন ছবের স্যার পৃথিবীতে আর নেই। এই বয়সে এসেও যেন প্রধান শিক্ষক মোঃ আজিজার রহমান স্যারের হৃদয় নিংড়ানো গভীর ভালোবাসা পাই। সত্য কথাটি এখানেই বলে রাখি  হঠাৎ একদিন স্যার আমার মোবাইল নম্বার সংগ্রহ করে কল দিয়েছিল। আমি কেমন আছি তা জানার পর তিনি   ছোট্ট একটা আবদার করলেন। বাবা তুমি এখন অনেক বড় হয়েছে কিন্তু আমি খুব অসুস্থ এবং অসহায় টাকার অভাবে সংসার চালাতে পারছিনা। আমার ছেলে মামুন বিদেশ গিয়েছিল আমার জমানো টাকা দিয়েই, কিন্তু সে দেশে ফিরে মানুষের হাতে নির্মমভাবেই খুন হয়। আমার উপার্জনের আর কেউ নেই। ‘যদি তুমি’…..বলতেই আমি  কথাটা বুঝতে পারলাম এবং সেই স্যারের বিকাশ নাম্বর চেয়ে নিয়ে যতসামান্য টাকা উপহার দিয়ে ছিলাম। কিন্তু শ্রদ্ধেয় ছবের স্যারকে কোনো কিছুই দিতে পারিনি, তবে  দোয়া এবং ভালোবাসা পেয়েছি। 

আমি যখন “রাজশাহী চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করি ঠিক তখনও ছবের স্যার জীবিত ছিলেন। একদিন পাঁজর ভাঙ্গা হাটে স্যারের সঙ্গে দেখা। যেন আশ্চর্যের মুহূর্ত ছিল সেদিন! আমারই দেওয়া সেই টুপি, হাতে ছিল তসবি ও তিনার শরীর দিয়েই জান্নাতুল ফেরদাউসের আতরের সুগন্ধী। হাত উঁচিয়ে মিষ্টি হেঁসেই বলেছিলেন এই যে দেখছো তোমার দেওয়া তসবি, এটা আমি যেখানে সেখানেই ‘জপি’। আর মাথায় টুপি পরার সময় বারবার তোমার কথা মনে পড়ে। আমিও বললাম, এটাই আমার ”অনেক সৌভাগ্য স্যার”!! কিন্তু, স্যার সেই অর্ধশিশি সুগন্ধী আতরের কথা তো বললেন না। তখনই স্যার বলেছিল- সুগন্ধি আতর, সেটা তো তোমার স্কুলেই কয় দিনে শেষ হয়েছে। আমি বললাম,- এখনও যে সেই ‘আতরটার গন্ধ’ পাচ্ছি স্যার! স্যার বলেছিলেন, তুমি যা দিয়েছিলে তাতো জান্নাতুল ফেরদাউসের একটি সুগন্ধী যুক্ত আতর। সেটা আমার ‘প্রিয় আতর হওয়ায়’ আজও শরীরে লাগায়। অবশ্য বাজার থেকে কিনতে হয়। আমি তখনই বললাম আজকে আপনাকে সে আতবটার ‘এক শিশি কিনে দিই স্যার’। স্যার বলে ছিল,- না থাক বাবা!! তুমি যে অনেক বড় হতে পারছ, সেটাই আমার ‘শ্রেষ্ঠতম সুগন্ধী আতর’। সুতরাং- এতেই প্রমাণ হয়েছে যে তাঁদের অবদানের কথা ভুল বার নয়। তাঁদের স্নেহ-ভালোবাসায় আমার স্কুলজীবন যেন সুশিক্ষায় আলোকিত হয়েছিল। এমন বিদ্যাপীঠের শিক্ষক, আমি আর কোথাও পাই নি।  ধন্য আমি, তাঁদের মতো গুরুজনদের নিয়েই কিছু স্মৃতি চারণ করতে পেরেছি।

আজ নিজেকে খুব আনন্দিত ও গৌরবান্বিত মনে হচ্ছে।

লেখকঃ নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD