.
SC, ST, OBC আর General
এর বেড়াজালে এখন বিধ্যস্ত এই পবিত্র ভারতভূমি। আমারই অতি ঘনিষ্ট এক চিকিৎসকের কীর্তিমান পুত্র শহরের এক নামি স্কুলের মেরিট-লিস্টের শীর্ষে তার নাম দেখেও স্কুল ক্যাম্পাশেই দক্ষ-যজ্ঞ বাধিয়ে দেয় কারণ সেদিনই প্রথম সে জানতে পারে যে তার বাবা OBC গোত্রের! সে এই পরিচয় নিয়ে সমাজে বাঁচতে লজ্জা পায়।
সেদিনের ব্যাপারটি মোটেই হালকা-পোলকা ছিল না। বরং অত্যন্ত জটিল। আর জানি, বিষয়ের গভীরে গিয়ে ঠিক্ ঠিক্ ভাবে বুঝাতে পারাটাও কঠিন শুধু নয়… একরকম দুঃসাধ্য।
আমি যে কঠিন সমস্যার সরল সমাধান খুঁজতে বসেছি আজ আপনাদের নিয়ে, বিদেশ ঘুরে সেই ১৮৯৭ সালে স্বয়ং
স্বামীজী’র মনেও এই একই প্রশ্ন জেগেছিল।
স্বামীজী লিখছেন…”
The wonderful question of Caste….have been stating in all of my life…..it’s P’s and Q’s…… mixed almost all parts of the communities…..have to be bewilded in my own mind to grasp even very significance of it. The more I study the more I bewildered.
….Now I can feel”
কথাটি কে বলছেন ? বিশ্বের অন্যতম প্রজ্ঞাবান, শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল
ব্যক্তিত্ব, স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং।
আর আমরা বোধের গভীরে না গিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে মরি ভায়ে-ভায়ে। মরে গিয়েও গালি খান স্মৃতি শাস্ত্রের শ্রেষ্ট প্রবক্তা মহামুনী মনু মহাশয়।
আবহমান ধরে চলে আসা ঋক্ বেদ এর ১০ মন্ডলের ৯০তম সূক্তের ১২দশ ঋচা ই এর উৎস।
এখানে আছেঃ
” ব্রাহ্মণো অস্য মুখম্ আসীৎ বাহু রাজণ্যঃ কৃতঃ।
ঊরূ তদস্য তদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রঃ
অজায়তঃ।।”
অর্থ পরমব্রহ্মের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, জঙ্ঘা-দেশ থেকে বৈশ্য এবং পদ-দেশ থেকে শূদ্রের উৎপত্তি।
শূদ্রকূল এটাকে অসম্মানজনক বেদোক্তি মনে করেন। ভুল বুঝাবুঝির সূত্রপাত টা ঠিক এখানেই।
আসলে আমরা নিজেরাই সম্ভবতঃ ভুলে গেছি …. অখন্ড ভারতের পরিধিটা। বর্তমান ভারতবর্ষেই জাতি’র সঠিক সংখ্যা বলা সত্যি অসম্ভব। সরকারী হলফনামায় কখনো যদি ১০,২৫৬ হয় তো পরেরবারে দাঁড়ায় ১২,০২৯ এ।
তাহলে, এই “জাতের নামে বজ্জাতি”… কেন, সঠিক তথ্যটাই যার জানা নেই ?
এবারে বিষয়েই ফিরে আসা যাক্।
বাইবেল এ Soul (আত্মা) আছে শুধু মানুষের। ইহুদী সম্প্রদায়ও এটাকেই মান্যতা দেন। বাকি ‘কাফের’দের বাঁচার অধিকার হয়তো বা এখানে নেই। সনাতন দর্শণ মানে সর্বভূতেই আত্ম-দর্শণ
তা সে …… ছাগল-গোরু- কৃমি-কীট থেকে গাছ-পালা এমন কি ইট-কাঠ পাথরেও।
স্মৃতি-শাস্ত্র স্বীকার করে হিরণ্যগর্ভ পরম-ব্রহ্ম থেকে সবারই উৎপত্তি।
বুঝার সুবিধার জন্য, শান্ত-সুদ্ধ- চৈতণ্যময় এক সত্ত্বা (হিরণ্যগর্ভ) র
কথা বলা হয়েছে। এই পরম পুরুষ তো সাধারণ আর পাঁচটা মানুষের মতো নয়… যা’র মাথার দাম বেশি, পায়ের দাম কম।
এই বিরাট “সৎ-চিৎ-আনন্দময় পুরুষ” এর বিভিন্ন অঙ্গের মূল্য কী আলাদা হওয়ার কথা ? বঙ্গোপসাগরের যে প্রান্ত থেকেই এক আঁজলা জল তুলে মুখে দেন….. সে তো সেই নোনতাই লাগবে, না কী ?
মনু মহাশয় তাই এই দশ হাজার আর বারো হাজারের ফাঁদে পা না দিয়ে সরাসরি সামাজিক দায়িত্বের নিরিখে সারা মানুষকূলকে ৪ টি উপকূল এ বিভক্ত করে দিলেন।
যাঁর সঞ্চিত অর্থ থাকবে না, যিনি সুদ্ধ থেকে ত্যাগ ও পঠন-পাঠনে সারাটি জীবন সমর্পিত থাকবেন তিনি ব্রাহ্মণ। যিনি ত্যাগের আদর্শে থেকে দেশের জন্য পেশি-শক্তি শুধু নয়, প্রয়োজনে প্রাণ সমর্পন করবেন তিনি ক্ষত্রিয়।
যিনি ব্যবসা- বানিজ্য, চাষবাস ও পশুপালনের মাধ্যমে জীবের ক্ষুধা নিবৃত্তি করে দেশের সমৃদ্ধি বাড়াবেন তিনি বৈশ্য। আর যাঁরা সব ধরনের হাতের কাজ (crafts) করবেন, দক্ষতার সাথে সমাজের জন্য কাজ করবেন তাঁরা শূদ্র।
এদের ত্যাগের প্রয়োজন নেই। নিষ্ঠা থাকলেই চলতো।বিবাহ বা খাদ্যাখাদ্য বিষয়ে নিয়মের অনুশাষণ কিছুটা হোলেও লঘু ছিল এদের জন্য। কারন, স্থিতিতে
শিশু হয়ে Theory of relativity এখন বোঝা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে হবে।
লক্ষণীয় এটাই, সনাতন ভারত এদের কখনোই অস্বীকার করে নি।
এদের জন্মকেও আলাদা দেখায় নি। উৎস সেই একই পরমপুরুষ।
গীতাও জানাচ্ছে,” চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং”….… কিন্তু কী ভাবে ?
উত্তর….” গুণ-কর্ম বিভাগশঃ।”
….. সেই একই সত্য, একই দর্শণ।
ব্রাহ্মণরা যেহেতু ত্যাগ এর আদর্শে
উৎস্বর্গীত থেকে প্রজ্ঞায় প্রতিষ্ঠিত থাকতেন, তাই নির্ধন হয়েও সম্মানের সর্বোচ্চে থাকতেন। এখনও ঠিক সেটাই আছে।
Quantum-Physics এর ওপরে কাজ করে নোবেলজয়ী Richard Fineman ২৮ বছর থেকেই অধ্যাপনা করতেন। তিনি তাঁর জীবনী তে লিখছেন, ” আমি এক পরিচিত ইহুদি পরিবারে গেছিলাম। বিদায় বেলা এগিয়ে দিতে এসে, ৭৮ বছর বয়স্কা মা বলছেন, ” আজ আমি বড়ো ভাগ্যবান। সকালে বাড়িতে এসেছিলেন দেশের মিলিটারি জেনারেল আর এখন এলেন তার চেয়েও মহান এক অধ্যাপক”।
দেখুন, একটা দেশের জেনারেল এর চেয়েও Richard (ব্রাহ্মণ?) এর সম্মান বেশি বৈ কম নয়…..
শুধু প্রজ্ঞার কারনে। আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করুন, এখনও ঠিক এটাই আপনি করেন কী না।
মনু বর্ণকে বাদ দিয়ে গোত্র এবং জাতিকে নিয়েই বিচার করেছেন বেশি। তাঁর কাছে ‘জাতি’ বলতে ‘Trade-guild’…… যা পরে Heredity হয়ে দাঁড়ায়। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই, -একজন Smith এর ছেলে যা অতি সহজেই করতে পারে বা একজন ক্ষত্রিয়-নন্দন যে শৌর্য্য দেখাতে পারে তা একজন ব্রাহ্মণ
বা শূদ্রের কাছে সাধারনতঃ আশা করা যায় না। তার মানে এই নয়, সে কখনোই পারবে না। পারবে, নিশ্চই পারবে, যদি তীব্র বাসনা থাকে।
মনে রাখা জরুরী, এই চতুরাশ্রম ব্যবস্থা তারই জীবনে প্রযোজ্য যে অধ্যাত্মিক পথে এগোতে চায়।
আজকের দিনে IIT বা IIM এ admission হয়েই ছেলে-মেয়েরা
salary-slab নিয়ে ভাবতে বসে।
এইদেখে, আমার এক বিশেষ ঘনিষ্ট মহারাজ তো একদিন একটি
IIT ‘র প্রি্সিপ্যাল কে হাসতে হাসতে বলেই ফেললেন,” আমরা ব্রাহ্মণ বাচ্চা গুলোকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি, আর আপনি এদেরকে সব শূদ্র বানিয়ে দিচ্ছেন” ! দেখুন ব্রাহ্মণ আর শূদ্রের বৈদিক concept।
যে ঋগ্বেদ এর একটি সূক্ত নিয়ে এত চেঁচামেঁচি সেই ঋগ্বেদ এর ই আর এক জায়গায় লেখা আছে,
“কারুঅয়ম্”…. মানে,…. আমি সঙ্গীত-চর্চা করি; ” তাতো বিশৎ”
….. বাবা চিকিৎসা করেন; “মাতঃ
উখাল প্রক্সিণী”….. মা পাথরের চাকিতে শষ্য-বীজ ভানে।
ব্রাহ্মণ-বৈশ্য-শূদ্রের কী সুন্দর সহাবস্থান ! বিরোধ কোথায় ?
মনু-স্মৃতিতে ৫ ম একটি বর্ণের উল্লেখ আছে ….. “সামান্য”… অর্থাৎ চলিত বাংলায় ‘চন্ডাল’…. ভক্ষ্য-অভক্ষ্য যা খুশি খায়, য’টা খুশি বিবাহ করে, যে কোনো জাতের পুরুষের সজ্জা-সঙ্গিনী হতেও তার বাধা নেই।
আসন্ন মূল্যবোধের স্খলন এর কথা ভেবে মহামুনী মনু এই ব্যবস্থাও রেখেছেন …… আড়াই হাজার বছর আগে, ভাবা যায় ?
বাধ্য হয়েই হয়তো, এই space টুকু রেখেছেন কিন্তু এটা ম্লেচ্ছ পরম্পরা হিসাবেই স্বীকৃত।
সনাতন-সংস্কৃতিতে কোনোদিনই
ভৌতিক বাদের কোন স্থান ছিল না, এখনও নেই। চন্ডালকে সংস্কৃত করে ব্রাহ্মণ ভাবনায় উপনিত করাই আমাদের ঐতিহ্য। কোন কিছু পাওয়ার জন্যে চন্ডালে পরিনত হওয়া পশ্চিমী-সংস্কৃতি হলেও আমাদের যে নয়, তা হলফ করে বলাই যায়।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ এর কাছে যে ভাগ্নে হৃদে থাকতো সে পাঠক মাত্রেই আপনাদের জানা। মন তখনও কাঁচা…..স্থিরতা নেই,শূদ্রের মতো।
ঠাকুর একদিন ভাবলেন,
এ ব্যাটার মন বসাতে একটু অন্য পথের আশ্রয় নেওয়া যাক”। এই ভেবে, এক মুহূর্তের জন্য “জ্যোতি-
দর্শন” করালেন। যেই না দেখা অমনি হৃদে চেঁচিয়ে বললো,” মামা, মামা! কাল থেকে জগদ্বাসীকে জানান দিতে লেগে পড়ি চল।”
ঠাকুর বললেন, ” ঢ়ের হয়েচে, এখন তুই আমার সেবা কর।”
হৃদে মানলো না। বাকী টা তো ইতিহাস। আসলে, “ঋষি কে বাদ দিয়ে ঋষি-বাদের উপাসনা” করলে যা পাওয়া যায় ঠিক সেটাই আজের মানুষ পাচ্ছে। আরও পেতে দিন। পাওয়ার শেষটাও যে তাকেই খুঁজে পেতে হবে…. কারন
সে যে কেবলই “মানুষ” ! ব্রাহ্মণত্বে উত্তীর্ণ হতে হবে তাকেই, আর তা তার একক প্রচেষ্টায়।