”না ইয়ে সাচ্….. না উও সাচ্”
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী
বেদান্ত নাম উপনিষদঃ প্রমাণম্”। ‘বেদান্ত’ এর অর্থ হয় দুটি (১) ঋক্, যজুঃ, সাম এবং অথর্ব এই চার টি বেদ প্রকট হওয়ার পরে রচিত (২) বেদের ‘অন্ত’ মানে শেষকথা বা নির্যাস ই হোল ‘বেদান্ত’……যার আর এক নাম ‘উপনিষদ্’।
বর্তমান বাজারে কম-বেশি শতাধিক উপনিষদ্ পাওয়া গেলেও, স্বীকৃত উপনিষদ্ এর সংখ্যা সাকুল্যে ১০ -১২টি। আদি শঙ্করাচার্য স্বয়ং যেগুলির ভাষ্য রচনা করে গেছেন। বৈদিক যাগ-যজ্ঞ উপনিষদ্ এর আমলে এসে কিছুটা হলেও বদলে গেল। নিল দার্শনিক চিন্তা ও আত্ম চেতনার রূপ।
অথর্ব বেদ এর অন্তর্গত ‘মান্ডুক্যোপনিষদ্’ এদের মধ্যে ক্ষুদ্রতম। এর মন্ত্র সংখ্যা মাত্র ১২ টি হলেও একে জ্ঞানের গভীর থেকে গভীরতম ভান্ডার বললেও অত্যূক্তি হয় না। এমনও লেখা আছে – “মুমুক্ষাণাম্ বিমুক্তয়ে মান্ডুক্যম্ একমেবাঅলম্”।
প্রকৃত মুক্তিকামী আত্মার কাছে যে একটি উপনিষদ এর জ্ঞানই যথেষ্ট সেই উপনিষদ্ এর ৭ম মন্ত্র টি নিয়ে আজ আমাদের আলোচনার আসর। তবে, মন্ত্রে যাওয়ার আগে ছোট্ট একটি গল্প বলি।
মহারাজা জনক একদিন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছেন তাঁর রাজ্যে বহিঃশত্রুর আক্রমন হোয়েছে। তাতে রাজত্ব হারিয়ে, নিজে পরাজিত হয়ে, রক্তাক্ত এবং ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পড়ে আছেন। শত্রুপক্ষের সৈন্যরা তাঁকে এবার দড়িতে বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুখে বলছে, ” রাজা বলে আমরা আপনাকে মেরে ফেলবো না কিন্তু আজ রাতেই এই রাজ্য ছেড়ে চির-বিদায় নিতে হবে। পথে চলতে চলতে যুদ্ধ-ক্লান্ত এবং অভুক্ত রাজার চোখে পড়লো এক লঙ্গরখানা। অগত্যা ওখানে নামমাত্র খিচুড়ি পেয়ে মুখে তুলতে যাবেন, এমন সময়ে একটি চিল ছোঁ মেরে পাতার থালাটি ফেলে দিল। রাজা ,” হা হা-কার করতে হুয়ে”। এমন দৃশ্য দেখে, মহারাজ ঘুমের মাঝে সজোরে চেঁচিয়ে উঠতেই এক পেয়াদা হন্তদন্ত হয়ে ছুট্টে এসে বললো….. কি হোল মহারাজ? এভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন কেন? জনক একটু হেসে বললেন,” না, তেমন কিছু হয় নি। আসলে, আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।” এদিকে, মহারাজার মনে তখন গম্ভীর এক চিন্তা স্থান করে নিয়েছে। তাই যে কেউ জানতে চাইলেই উনি এক খেয়ালে একটাই কথা বলে যাচ্ছেন…..” না ইয়ে সাচ্…… না উও সাচ্।”
“কোনটা ঠিক্….. ঘুমের মধ্যে যা দেখলাম সেটা ঠিক…… নাকি, এখন দরবারে বসে যা দেখছি সেটি ঠিক ?”
এইভাবে চলতে চলতে একদিন অষ্টাবক্র মুনির সাথে দেখা হোল তাঁর। সৌজন্য বিনিময় করেই অন্তর্যামী মুনি জানতে চাইলেনঃ ” ক্যা হুয়া রাজা?” রাজা’র সেই একই কথা…” না ইয়ে সাচ্ , না উও সাচ্?”
মুনি তখন বললেনঃ ” তো রাজা…. না ইয়ে সাচ্ না উও সাচ্…….. লেকিন্ তুম্ হি সাচ্।”….. এখন এখানে বসে যা দেখছেন তা সত্য নয়; আবার স্বপ্নাবস্থায় সেদিন রাতে যা দেখেছিলেন তাও সত্য ছিল না…… সত্য একটাই , সে আপনি নিজে।”
দেখুন, মানুষের মনের তিন টি বিশেষ অবস্থা
১) জাগ্রত অবস্থা ….. বেদান্তের ভাষাতে ‘বহিষ্প্রজ্ঞম্’
২) নিদ্রাবস্থা (REMS)…. বেদান্তের ভাষাতে ‘অন্তঃপ্রজ্ঞম্’
৩) গভীর ঘুম বা সুসুপ্তি দশা এটাকে বেদান্ত বলে ‘প্রজ্ঞানঘন’ অবস্থা।
৪র্থ আর একটি অবস্থা আছে যা’র নাম তূরীয় (Transcendence or Pure Consciousness) অবস্থা। তূরীয় স্থিতি পার্থিব সব পাপ-পুন্য, সুখ-দুঃখ বা সৎ-অসৎ এর পারে। একে ঠিকঠিক অনুভব হোয়ে গেলে মনের অন্য অবস্থাগুলো হঠাৎই উধাও হোয়ে যাবে না, এমনটাও নয়। সুবিশাল এই নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে যেদিন আপনি জেনে যাবেন তার বুকে অবিশ্রান্ত ঢেউ ওঠার বৈজ্ঞানিক কারণ, ঠিক তার পর মুহূর্তেই ঢেউ ওঠা যেমন বন্ধ হয়ে যাবে কী ? না। এও অনেকটা যেন সেরকমই। সবই থাকবে।
তাই, একে মনের ৪র্থ অবস্থা বলাটা খুব সঙ্গত কারনেই আমার ভুল…. এটাই reality। সত্যিকারের স্থিতি। এটাই আসল আর এটাই প্রকৃত। অথচ আমরা একে ভুলেই বেমালুম আছি।
বাকি “তিনটি মন” তো নিরন্তর অহঙ্কারের অধীন আর ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীলও।
‘জাগ্রত’ মনের অভিজ্ঞতা শুধুই কর্মের জগতে ব্যস্ত থাকা। ‘নিদ্রিত’ মন সে তার নিদ্রারূপী আর এক অলীক জগতে বিচরণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। ‘সুসুপ্তি’র রাজ্য শূন্য Sleep- blankness।
তূরীয়….. নীরব দর্শক রূপে সব পরিস্থিতির সাক্ষী।
একটা উদাহরণের সাহায্য নিয়ে আসুন, আরও একটু সহজ করে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি।
ধরি, স্টেশনে একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন এলো। বহুলোক নামলো, অনেকে আবার উঠলো। স্টেশন-মাস্টার তার জায়গাতে বসেই লক্ষ্য রাখলেন। কিছুক্ষণ পরে, একটি মালবাহী ট্রেন এলো গৌহাটি থেকে। কেউ উঠলো না। নামলোও না। কিন্তু স্টেশন-মাস্টার কে একই ভাবেই লক্ষ্য রাখতে হোল। তারপরে, ডিউটি আওয়ার শেষ না হওয়া পর্যন্ত, আর একটিও ট্রেন এলো না। কিন্তু তাঁকে চুপটি করে নিজের চেয়ারে বসে তীক্ষ্ণ নজর রাখতেই হোল শূন্য স্টেশনটার দিকে। তাই না ? স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে তো গেলেন না! তূরীয় অবস্থাটি ঠিক এই স্টেশন-মাস্টারমশাই এর মতো। “সোয়ম্ আত্মা চতুষ্পদঃ”।
মনে করুন, আপনার আঙুলে এক ভরি ওজনের সোনার আংটি আছে, গলায় তিন ভরি’র হার ঝুলছে, বাহুতে রয়েছে সোনার ব্রেশলেট। আংটির কাজ অবশ্যই হার দিয়ে হবে না… ঠিক যেমন হার এর কাজ ব্রেশলেট দিয়েও নয়। কিন্তু আংটি কে গলিয়ে দিন…. আংটি হারিয়ে যাবে; সোনা থেকে যাবে। হার বা ব্রেশলেট এর ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা… সোনা কখনোই হারিয়ে যাবে না। গয়নাগুলির ব্যবহারিক ক্ষেত্র পুরো আলাদা হোলেও সোনা যে এদের reality …. সোনা বাদে তো এরা অন্য কিছু নয়! হঠাৎ তীব্র অভাবে পড়া শেঠজী’র সেই গণেশ বিক্রি করতে যাওয়ার গল্প আপনাদের অনেকের ই হয়তো জানা। শেঠজী তার সোনার গণেশকে বিক্রি করার পরে ‘চুহা’ টি কেও বিক্রি করতে চেয়ে দোকানদার এর কাছে দাম জানতে চেয়েছিল। যেই শুনেছেন একই রেট …. ক্ষেপে গিয়ে বলছেন..” এ ক্যায়া করতে হো,আপ? গণেশজীকা যা রেট চুহা কা ভী ওহি একই রেট !” দোকানদার বললো, আরে শেঠজী, এ আপকে লিয়েগণেশ ঔর চুহা মেরে লিয়ে তো স্রিফ সোনা হি হ্যায়”।
এবার দেখি, উপনিষদ এর ঋষি কী বলছেন।
সত্যদ্রষ্টা ঋষি লিখছেনঃ
“নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিষ্প্রজ্ঞং ন উভয়তঃ প্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং ন অপ্রজ্ঞম্। অদৃশ্যম্ অব্যবহার্যম্ অগ্রাহ্যম্ অলক্ষণম্ অচিন্ত্যম্ অব্যপদেশ্যম্ একাত্মপ্রত্যয়সারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবম্ অদ্বৈতং চতুর্থং মন্যতে। স আত্মা। স বিজ্ঞেয়ঃ।”
‘ন অন্তপ্রজ্ঞং’.. মানে নিদ্রিত নয়, ‘ন বহিষ্প্রজ্ঞং’
মানে জাগ্রত নয়, এই দুই এর মধ্যবর্তী কোনো সত্তা ও নয়; আবার সুসুপ্তির অন্তর্গত ও নয়। ‘ন প্রজ্ঞং’ মানে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর গোছেরও কিছু নয়। আবার বলছেন “ন অপ্রজ্ঞং” অর্থাৎ ঈশ্বর বাদে অন্যকিছুখা এমনটাও নয়। ইনি দেখার বস্তু নয়,ব্যবহার করার ও নয় (Untranslatable), অগ্রাহ্যম্ যা পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের বোধগম্য নয়, অলক্ষণম্ Cannot be inferred..
কোনো বিশেষ চিহ্ণ দ্বারা চেনা যায় না, অচিন্ত্যম্যি… নি আমাদের বোধের বাইরে, অব্যপদেশ্যম্…… মানে যাঁর কোনো নামকরণ করা সম্ভব নয়। তাহলে তিনি কেমন? উত্তরঃ ‘ এক (One) আত্ম (I) প্রত্যয় (sense) সারং (ultimate)। প্রপঞ্চোপশমং .পঞ্চ-তন্মাত্রার অতীত, শান্তি-মংগলময় এবং অভিন্ন (non – dual) এক তত্ব। আর, “চতুর্থম্ মন্যন্তে”….. বলতে, অজ্ঞানীরা একেই চতুর্থ কিছু বলে ভাবেন (আসলে, ইনিই সব, ইনি সর্বব্যাপী…… কোনো কিছুই ইনি বাদ দিয়ে নয়…. ঠিক যেমন আংটি বলুন, হার বলুন, আর ব্রেশলেট বলুন….. সোনা বাদে নয়। সেই তিনিই আত্মন্ বা তূরীয় আত্মা। “আত্মেবেদ সর্বম্”। একমাত্র সেই আমিই আমার জ্ঞাতব্য। এবার মনে করে দেখুন, ঋষি অষ্টাবক্র ঠিক একথাটা ই বলেছিলেন জনক মহারাজকে…..” তো রাজা! না ইয়ে সাচ্, না উয়ো সাচ্…… লেকিন্ তুম হি সাচ্”।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ গৌড় পাদাচার্য্য এর ‘কারিকা’ এবং সর্বপ্রিয়ানন্দজী’র বক্তব্য।
Additional Source: BBC Bangla
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.