আয় বেহেস্তে কে যাবি আয়………
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী
‘স্বর্গ’ মানেই এক সুরম্যনগরী, সার-সার দাঁড়িয়ে আছে গাছগাছালিতে মোড়া ঝকঝকে সুন্দর বাঙলোগুলি, তকতকে পথঘাট, সামনে দিয়ে কলকল রবে বইছে অলকানন্দা, চির-বসন্তের সেই রাজ্যে মো-মো করছে গাছভর্তি পারিজাত এর সুগন্ধ, মাঝে মাঝে রক্ত-রাঙা কিছু মন্দার ফুল ও ফুটে আছে নন্দন-কাননের এখানে ওখানে, শান্ত ‘সুরভী’ ঘুরে বেড়াচ্ছে সবুজ বাগিচায়। দুলে দুলে উঠে ‘কল্পতরু’ বলছে…..” সোনা চাই…. দানা চাই……..টাকা চাই…… মোবাইল…… ল্যাপটপ…… ট্যাবলেট চাই…… বল নিবে…..পরমায়ু নিবে গো…….” ।
রাজধানী, অমরাবতীতে সোনার সিংহাসনে বসে মেনকা আর ঊর্বসীর তালে তালে কোমর দোলানো দেখে মিঠি -মিঠি হাসছেন দেবরাজ। প্রধান ফটকে পাহারা দিচ্ছে তাঁরই বিশ্বস্ত ঐরাবত।
এখানে বসবাসকারীদের বয়স বাড়ে না। খিদে পাওয়ার আগেই সুস্বাদু সব খাবার চলে আসে।
না চাইতেই বিশুদ্ধ জল। এখানে কারুর মল-মূত্র ত্যাগ করতে হয় না। তাই ল্যাট্রিন-ইউরিন্যাল নেই।
দূর্গন্ধ তো দূরে থাক…… contamination এর ও কোনো প্রশ্ন নেই! কোকিল-কন্ঠি গন্ধর্বদের গান আর অপ্সরাদের নাচ দেখেই কেটে যায় সময়, এখানে।
এই “Eutopia- concept” টি শুধু মাত্র যে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থেই আছে, এমনটা নয়।
নাম ও ভাষাকে উপেক্ষা করলে, ইসলাম ধর্মেও একই ধারণার অবতারনা। হিন্দু’র স্বর্গই ইসলাম এর জান্নাত্?….. যেখানে আল্লাহ্ স্বয়ং সাক্ষাত দেন। ফার্সি ভাষায় এটাই ‘বেহেশত’।
নজরুল লিখছেন….” আয় বেহেশতে কে যাবি আয়…. প্রাণের বুলন্দ দরওয়াজায়….. আয়।” আখিরাতে ইমানদার নেককার বান্দাদের চির নিশ্চিত শান্তির জায়গা এই ‘জান্নাত’।
মহানবি হজরত মোহম্মদ বলছেনঃ
“আমি আমার পুণ্যবান বান্দাদের জন্য জান্নাতে এমন সব বস্তু তৈরি করে রেখেছি…. যা কোনো মানুষ চোখে দেখে নি, কানে শোনে নি, অন্তরে যা তারা কখনো কল্পনা ও করতে পারে নি”(মিশকাহ)।
কুরাণ জানাচ্ছেন, জান্নাতের ও ৮টি বিভাগ আছে।
সর্বশ্রেষ্ট বিভাগের নাম “জান্নাতুল ফিরদাউস”। এটি ছাড়াও আছে দারুল মাকাম্, দারুস সালাস্ ( শান্তির নীড়), দারুল নাঈম, জান্নাতুল আদম্ (অনন্ত সুখের স্থান)…… ইত্যাদি। জান্নাতে একটি গাছের ছায়া এতটাই লম্বা হয় যেখানে একজন ঘোড়ায় চড়েও স্বচ্ছন্দে ১০০ বছর ছুটতে পারে ! অর্থাৎ কিনা তার গায়ে রোদ এর আঁচটুকুও লাগে না।
জান্নাতিদের পানের জন্য মজুত থাকে সুস্বাদু পানি, সুমিষ্ট মধু, আদার স্বাদ যুক্ত শরাব। মেহমানদের দেওয়া হয় খেজুর, আঙুর, আনার, বরই, আনজীর এইসব ফল। থাকে, “শারাবান ত্বাহুর” ( পবিত্র পরিচ্ছন্ন পানীয়)। সারা জান্নাত জুড়ে আনন্দই আনন্দ….. আরাম, সাথে আমোদ-প্রমোদ।
“কুরাণ হাদিশ” এর মতে, জান্নাতে যাবার ৮ টি দরজা …….বাবুস সালাহ, বাবুস সাদাকাহা, বাবুল হজ্, বাবুল ইমান্ ইত্যাদি। যাঁরা জীবনে আল্লাহ্ কেই স্রষ্টা বলে মানবেন এবং মোহম্মদ কে আল্লা প্রেরিত রসুল মনে করবেন তাঁরাই এই পথের যাত্রী হতে পারবেন।
‘কিয়ামত’ এর হিসাবে, যাদের নেকির পাল্লা গুনাহর পাল্লা থেকে ভারী হবে তাঁরাই কেবল জান্নাত্ রাজ্যে প্রবেশ করবেন।
হিন্দুদের ক্ষেত্রে, স্বর্গে যাওয়ার দরজার সংখ্যা একটি কমে, ৭। ‘মহাভারত’ এর মহাতপা যজাতি এবং তাঁর নাতি অষ্টক মুনি’র কথোপকথনে জানা যায়………..
“তপস্য দানম্ চশমোদমস্য হ্রী আর্জবম্ সর্বভূতানুকম্পা।
স্বর্গস্য লোকস্য বদন্তি সন্তো দ্বারাণি সপ্তৈব মহতি পুংসাম্।।”
(১) নিত্য তপস্যা করা (২) সৎপাত্রে সাধ্যমতো দান করা (“দানমেকং কলৌযুগে”), (৩) ‘শম’ মানে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের উপর আধিপত্য, (৪) ‘দম’….. মানে কর্মেন্দ্রিয়ের উপরে আধিপত্য, (৫) ‘হ্রী’…. মানে কোনো বিষয়ে লজ্জা পাওয়ার আগ-মুহূর্তের বিবেকবোধ, (৬) ‘আর্জবম্’… এর অর্থ হৃদয়ের নিষ্পাপ সরলতা বা চালাকি না করা, সবশেষে (৭)’সর্বভূতানুকম্পা’….
….এর অর্থ হয় সব জীবের প্রতি করুনাঘন দৃষ্টিপাত।
স্বর্গের দরজা খুলতে হলে এই পথের অনুসারী হওয়া ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। এটাই বাস্তব। মহাভারত মানেই, অসম্ভব রকমের এক Realistic journey। অসংখ্য প্রকারের Ethical dilemma র মাঝেও Highest attenment ।
একটা কথা তাই বলতেই হয়, হিন্দু’র ‘স্বর্গ’ বলুন আর ইসলাম এর ‘জান্নাত’ বলুন……. এ আমাদের এক পবিত্র ধার্মিক বিশ্বাস। না কোনো হিন্দু দেখেছেন, না কোনো মুসলিম দেখেছেন।
যে যাঁর বিশ্বাসে অটল থাকতেই পারেন, আর এটা স্বাভাবিক ও। কিন্তু এই বিশ্বাসটাই যেন আমাদের জীবনের শেষ ধাপ না হয়….. আমরা যেন যে যার মতো করে রসুল মোহম্মদকে বা মহাভারতকে যথাযোগ্য মান্যতা দিয়ে দরজার অভিমুখে এক পা, এক পা করে এগোতে শিখি। নাই ই যদি এগোলাম তবে আর সাত বা আট এর হিসাব জেনে আখেরে কী লাভ টা হোলো আমাদের ?
পাশাপাশি আমরা উভয়েই যে যা’র নিষ্ঠা’র সাথে সমঝোতা না করেও কবি’র কথাটিকে যেন ভুলে না যাই….
” কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর…..
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেই সুরাসুর। “
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.