রহস্যে ভরা ভায়ের ফোঁটা
ড. রঘুপতি সারেঙ্গী।
” ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা আর কী আমি চাই !”
বোনেদের মুখের এ কথা আজ কতোখানি সত্য তারাই ভালো বলতে পারবে। কিন্তু এটা সত্য, ভাই-বোন এর এই সম্পর্ক নিত্য….. ছিল, আছে, আর থাকবেও।
ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির এক অঙ্গ ভাইফোঁটা। দুই বাংলা, অসম, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, হরিয়াণা, গুজরাট, রাজস্থান এইসব অঙ্গরাজ্য সহ পাশের দেশ নেপালে ও ভুটানে এই অনুষ্ঠান অত্যন্ত আবেগ ও নিষ্ঠার সাথে পালিত হয়। নেপালে এর নাম “ভাই-লগন”। পোড়ানো চালের তৈরি গুঁড়ো তে দই-মধু ইত্যাদি পবিত্র উপাদান মিশিয়ে ফোঁটার সামগ্রী তৈরি করা হয়। বাঙলার বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণতঃ শিশিরের জলে চন্দন ফেঁটে, ধূপ- দীপ জ্বেলে, ধান-দূর্বা ও আতপ চাল থালায় নিয়ে আরতি করে, মঙ্গল-কামনা সহ বাম হাতের কড়ি আঙ্গুলে বোনেরা ভাইদের কপালে অক্ষয়- ফোঁটা দেয়। সাথে থাকে ভুরিভোজের আয়োজন।
তা হলেও এটা ঠিক, ভারতবাসীর কাছে কোনো অনুষ্ঠান এর গ্রহণযোগ্যতা দু’টি জিনিসের উপর নির্ভরশীল………..অনুষ্ঠানটির প্রাচীনত্ব এবং তা প্রকৃতপক্ষে বেদ-বিহিত কি না।
ঐতিহাসিক বিচারে, ভাই-ফোঁটা’র আনুমানিক বয়স খ্রীঃ পূঃ ৫২৭ মানে, মোটামুটি ২৫০০ বছর । পণ্ডিত সর্বানন্দসূরী তার তাল-পাতার পুঁথি, “দীপোৎসবকল্প”এ লিখেছেন, রাজা নন্দীবর্ধন ছিলেন মহাবীর জিন এর অনন্য ভক্ত ও পার্ষদ। মহাবীর দেহ রাখলে, রাজা মানসিকভাবে চরম বিদ্ধস্ত হয়ে আমরণ অনশণ শুরু করেন। সবার সব চেষ্টা বিফল হলে, রাজার নিজের বোন অনসূয়া’র চেষ্টাতেই তা শেষমেস ফলপ্রসু হয়। বোন এর আবেগ এর কাছে রাজা হার মানেন। বোনের হাতে তৈরি নাড়ু ও ফল খেয়ে রাজা মশাই’র অনশণ ভাঙে। দিনটি ছিল কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বাদশী তিথি।
সেই দিনটি কে স্মরণীয় রাখতেই নাকি বাৎসরিক এই আয়োজন।
পৌরাণিক প্রাচীনত্ব বলতে জানা যায়, সূর্যদেব এবং ঊষা’র পুত্র যম, কন্যা যমুনা। আবেগ-আপ্লুত যমুনার দেওয়া ফোঁটা ই নাকি যমরাজ এর অমরত্বের আসল মন্ত্র । দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুর কে বধ করে বলরাম-পত্নী, ভগিনী সুভদ্রার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। কপালে শ্বেত- চন্দনের ফোঁটা দিয়ে, ধূপ-দীপ-মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন সেদিন সেই বোন। দিনটি ছিল এমনই এক শুক্লা দ্বাদশী। বৈষ্ণবীয় ভাবনা তে সেটাই নাকি ভাই-ফোঁটা’র সূত্রপাত।
কোনো কোনো পুরাণে আবার এমনও লেখা আছে, পরাক্রমশালী দৈত্য-রাজ বলি একবার বিষ্ণুকে যুদ্ধে হারিয়ে পাতালে বন্দী করে রেখেছিল। এমন অবস্থায় সহধর্মিনী লক্ষ্মীদেবী বুদ্ধি করে, বলিকে ভাই পাতিয়ে, ভাই-ফোঁটার মাধ্যমে তার হৃদয় গলিয়ে বিষ্ণুকে পাতাল লোক থেকে মুক্ত করতে সমর্থ হন। এই বিশ্বাসে, আজও নদিয়ার কল্যাণী অঞ্চলে, স্থানীয় মদনমোহন এর চৌকাঠে প্রথমে চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে তবেই বোনেরা ভাইদের কপালে ফোঁটা দেয়।
এবার, আসুন তাকাই একবার ঋক্ বেদ এর দিকে। ঋগ্বেদ তাঁর ১০ম মণ্ডলের ১০ নং সূক্তে বিবস্বান (সূর্য) এর জমজ পুত্র-কন্যা, যম এবং যমী ( যমুনা)’র কথোপকথন থেকে “ভাই-ফোঁঠা” র আড়ালে সেই ৮-১২ হাজার বছর পূর্বের এই অতি বৈজ্ঞানিক তথ্যটি জানা যায়। যমী যম কে বলছেনঃ
” ও চিৎসখায়ং সখ্যা ববৃত্যাং তিরঃ পুরূ চিদর্ণবং জগন্বান্।
পিতুর্নপাতমা দধীত বেধা অধি ক্ষমি প্রতরং দিধ্যানঃ।।”
বিস্তীর্ণ সমুদ্র মধ্যবর্তী এই নির্জন দ্বীপে এসে কামতাড়িত হয়ে আজ আমি তোমার অভিলাষা। সারা গর্ভাবস্থায় তুমি আমার ই সহচর ছিলে কিনা ! তোমার ঔরসে আমার গর্ভে আমাদের পিতার এক সুন্দর নপ্তা (নাতি) জন্মাবে।
যম এই পাপক্রীড়া তে তীব্র অসম্মতি জানিয়ে বলছেনঃ
” ন তে সখা সখ্যং বষ্ট্যেতৎসলক্ষ্মা যদ্বিষুরূপা ভবাতি।
মহস্পুত্রাসো অসুরস্য বীরা দিবো ধর্তার উর্বিয়া পরি খ্যন্।।”
তোমার গর্ভ-সহচর তোমার কাছে এ কামনা করে না। সহোদরা ভগিনী মাত্রেই সর্বদাই অগম্যা। আর এই স্থান নির্জন হোলেও স্বর্গধারণকারী বীর পুত্রগনের দৃষ্টির গোচরে ।”
আজকের চিকিৎসা-বিজ্ঞান ও ‘INCEST’ কে কখনোই অনুমতি দেয় না। তাহলে কী এই চরম সত্যটি চঞ্চল মনকে বছরে একটিবার স্মরণ করাতেই ভাই-বোন এর মধ্যে এই কৌশলী পবিত্রতার মোড়ক….. যা’র পোষাকি নাম “ভাই-ফোঁটা” বা “যম-দ্বিতীয়া” ?
সনাতন ধর্মের মাধুর্য্যই এইখানে, প্রবল বিতর্কিত অর্থের শ্লোকের মাধ্যমে জীবনের জটিল তথ্য ও তত্ব কে সহজ ভাবে আচারের অনুসঙ্গে বেঁধে দেয় । হাজার বছর ধরে পালিত সেই আচারই হয়ে ওঠে জীবনের মূল মন্ত্র। তাই ভাই ফোঁটা শুধু এক আচার নয় গভীর জিনতত্ত্বের অমোঘ নির্দেশও বটে ।
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.