“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্”
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী।
আজও মনে পড়ে, সেই কোন্ ছোটোবেলায় শুনতাম,
” পড়িতে পড়িতে খেলিতে চায়
সে জন কখনো বিদ্যা না পায়। “
আর আজ, এই অতিক্রান্ত মধ্য-বয়সে এসে, স্বামীজি’র মুখে, সেই বাংলার ইংরেজি অনুবাদ শুনতে হচ্ছে……..
“The difference between a great man and a common man lies in the degree of their concentration.”
‘Concentration’ এর বিশুদ্ধ বঙ্গানুবাদ বলতে যে একাগ্রতা, সে আমরা সবাই জানি। আর এই একাগ্রতা কে বাড়াতে বিশ্বজুড়ে চলছে ধ্যান এর অনুশীলন। দাবা থেকে কুম্ফু…. আরব থেকে আমেরিকা সব খানেই। দুনিয়া জুড়ে চল-ভাষ এর এই অনৈতিক প্রয়োগই মা-বাবাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে একাগ্রতার উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা। দিনে দিনে মান্যতা পাচ্ছে ‘যোগাভ্যাস’। “योग: कर्मसू कौशलम্”।
” অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় “… চঞ্চল মনে লাগাম দেওয়ার অভ্যাস করার নাম ‘যোগ’। এমন করতে করতে সে মন যখন ধ্যেয় বস্তুতে লাগতে শুরু করলো….. সেটাই তখন ‘ধারণা’। মন যখন ধ্যেয় বস্তুতে এমন ভাবে সাঁটিয়ে গেল যে টানলেও আর সরে না….সেই অবস্থার নাম ‘সমাধি’। এটাই ভগবান বুদ্ধের ‘নির্বাণ’। আর, এটাই মহাবীর এর ‘মহানিষ্ক্রমণ্’।
পতঞ্জলী’র “অষ্টাঙ্গিক যোগ” এর এই শেষ তিন ধাপ এর কোনোও প্রয়োজনই ছিল না মানুষের মন যদি অশান্ত না হোত। কিন্তু কৃষ্ণ-সখা, অপ্সরা-বিজয়ী, গান্ডিব-ধারী অর্জুনের মুখেও যখন শুনি, ” চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাদি বলবদ্দৃঢ়ম্। তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্।।”….. তখনই আসলে, হতাশা আসে। মানুষের মন যদি সত্যিই তার বিষয়ের ভোগ চেয়ে, বাতাসের চেয়েও সদা-চঞ্চল হতে থাকে তবে সেই মনকে আটকানো যায় কী ? আবার গীতার পাতায় এমনও পাবেন, ” স্থিতধীঃ মুনিঃ উচ্যতে “।
তবে এটা ঠিক, কপালে তিলক কেটে, মাথায় টিকি ঝুলিয়ে আর যাই হোক্ ‘মুনি’ অন্ততঃ হওয়া যায় না ……যতক্ষণ মানুষ স্থিত-প্রজ্ঞ না হয়। মনে পড়ছে, Modern psychology’র অন্যতম প্রবক্তা, Prof Seligman কে এক সাংবাদিক-বন্ধু একদিন জিজ্ঞেশ করেছিলেন……..
” What is the happiest moment in your Life, Sir?” অধ্যাপকের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল, “When I remain completely absorbed in my work”.
এমন মুহূর্তকে উনি পরিভাষিত করেছেন…. ‘FLOW’। লক্ষ্য করুন, এমন মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছি আমরা সবাই, কোনো না কোনোদিন..…যে টুকূ সময়ের জন্য আপনি আপনার পরিবার-পরিজন, বিশ্ব-সংসার, এমন কি নিজের অস্তিত্ব টুকুও ভুলে নিজের মধ্যেই নিজে ডুবে ছিলেন, তা সে কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘন্টার জন্য। একবার, এক বিজ্ঞানীর ফ্ল্যাট বদল হোল। আলমারি-খাট, লেপ-তোষক, বাসনপত্র, বই সব নিয়ে স্ত্রী পাশের নতুন ফ্ল্যাটে উঠেই সাজাতে ব্যস্ত। মহাশয় গুটি-কতক ফাইল হাতে নিয়ে, পুরনো ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে আসবেন। ঘন্টা গড়িয়ে যাচ্ছে, আসছেন না। কিছুক্ষণ পরে, ফাইল হাতে উদভ্রান্ত সেই বিজ্ঞানী রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বাচ্চা-মেয়ে কে আঙুল দেখিয়ে বললেন,
” আচ্ছা, এই ফ্ল্যাটের লোকজন কাছাকাছি কোন ফ্ল্যাটে গেল, তুমি বলতে পার ?” মেয়েটি বললো, ” হ্যাঁ বাবা, এসো আমার সাথে। এজন্যই তো মা আমায় পাঠিয়েছে”। আসলে, একেই বলে ” আপনে মন্ মে ডুব কর্, বাজা সুরাগে জিন্দেগি”।
গানিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রফেসর,সেলিগ্ ম্যান’র Concentration এর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে যুগান্তকারী Positive- Psychology’র Pioneer হয়ে উঠলেন United State এর আর এক মনোবিজ্ঞানী, Mehaly Csikszentmihaly (মিহায় থিকজেনমিহায়)।
ওনার অভিমতঃ
১) আমাদের প্রত্যেকেরই বোধ-বুদ্ধি (Cognitive capacity) নির্দিষ্ট, যা আধুনিক কম্পিউটারের ভাষাতে…” 7 bits per Second ”।
২) একটি অভিজ্ঞতা থেকে অন্য একটি অভিজ্ঞতা কে সুচারুভাবে পৃথক করতে মানুষের মন 1/18 সেকেন্ড সময় নেয়।
৩) একজনের কথা কে মনযোগ দিয়ে শুনতে 60 bits/ Sec লাগে। যে কারণে, একই সময়ে শোনা দুজন মানুষের বক্তব্য কোনো একজনের পক্ষে বুঝতে অসুবিধা হয়; আর তিনজনের হোলে বোঝা অসম্ভব হয়ে পড়ে। দেখেন না, টিভির “তর্ক-বিতর্ক” অনুষ্ঠানের মূল্যবান বক্তারা যখন বক্তব্য বাদ দিয়ে স্বর এর প্রতিযোগিতায় নেবে পড়েন , তখন কী সুন্দর বোধগম্য হয় এঁদের বক্তব্য !
৪) কোনো একটি idea তে Fully absorbed হতে মন এর 126 bits/ Sec লাগে…..অর্থাৎ এই 126 bit এর কাছাকাছি সবচেয়ে বেশি কতগুলি bit আপনি আপনার focus এ দিচ্ছেন… এরই ওপরে নির্ভর করে আপনার depth of Concentration, আপনার স্বপ্নের সেই ‘Flow’ তৈরি হবে কী না।
এই flow বা একাগ্রতার চরম মুহুর্তে মানুষের সামনে তার Focus টুকু ছাড়া আর কোনো অনুভূতিই থাকে না, নিজের অস্তিত্বের ও নয়। স্বাভাবিকভাবে, তার মনে তখন কাম, ক্রোধ, লোভ আদি ভোগের বাসনা জাগার প্রশ্ন ই নেই। এমন ক্ষণ যতো বেশি দীর্ঘ্য হয় ততোই মঙ্গল..……….তা জীবনের যে ক্ষেত্র ই হোক।
কথামৃতে গিরিশ ঘোষ বলছেন, ভোর রাতে বেলুড়ে যখন নরেন্দ্রনাথ নিশ্চল ধ্যানে বসতেন তাঁর গোটা মুখমন্ডল কোলকাতার মশাতে কালো হয়ে যেতো। তাঁকে চেনা যেতো না। তবু, নিশ্চল দুই ঘন্টা একই ভাবে থেকে, ধীরে ধীরে, পদ্মের পাপড়ির মতো চোখ দু’টি মেলতেন। মশাগুলো ও কী তখন ধ্যান করতো ? অবশ্যই না। বরং এটা বলা যায়, সেকেন্ডে ১২৬ বিট দিয়ে মশার দল তাঁকে কামড়াতো। কিন্তু, এমনই ছিল স্বামীজির একাগ্রতা! নৈলে, জীবন-মুক্ত এই মানুষটি কোন্ সে ক্ষমতার বলে Encyclopaedia Britannica’র আধ-লরি বই কয়েক দিনে পড়ে ফেলেন, ভাবা যায় ?
এই চরম সত্য কে বুঝাতেই বুঝি আদি শঙ্করাচার্য লিখছেনঃ
” সৎসঙ্গত্বে নিঃসঙ্গত্বম্ নিঃসঙ্গত্বে নির্মোহত্বম্।
নির্মোহত্বে নিশ্চলতত্বম্ নিশ্চলত্বে জীবন্মুক্তিঃ। “
সৎ-মানুষের সঙ্গে সৎ-আলোচনায় সময় কাটালে একসময়ে আত্ম- উপলব্ধির প্রয়োজনেই মানুষ সংসার-পরিজন থেকে নিজেকেই নিজে গুটিয়ে নেয়। এভাবেই সে মোহ-মুক্ত হয়। জীবন থেকে মোহ ও বাসনা গেলে তবেই চিত্ত থেকে চাঞ্চল্য দূর হয়। অন্তিমে, জীবিত থাকতেই সে মুক্ত-পুরুষ হতে পারে। শ্রীমদ্ ভগবৎ গীতা’র ‘সাংখ্যযোগ’ এ অর্জুন যখন সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন…….
” স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা?” শ্রী ভগবান উত্তরে একের পর এক শ্লোক বলতে বলতে একসময়ে বলছেন
” নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা। ন চাভাবয়তঃ শান্তিঃ অশান্তস্য কুতঃ সুখম্।।”
যা’র চিত্ত শান্ত-সমাহিত নয় সে ব্যক্তি কখনোই সু-মেধার অধিকারী হতে পারে না। সুমেধা না থাকলে শান্তি মিলা অসম্ভব। আর, মনে যা’র শান্তি নেই তার আবার সুখ কোথায়?
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.