স্মৃতিচারণ অধ্যাপক জগদ্বন্ধু বিশ্বাস: মুর্শিদাবাদ জেলার এক অনন্য ব্যক্তিত্বের নাম
রবীন্দ্রনাথ রায়
“জন্মিলে মরিতে হবে
অমর কে কোথা কবে”
এই অতি বাস্তব সত্যটাকে মেনে নিলেও অধ্যাপক জগদ্বন্ধু বিশ্বাসের মৃত্যুটাকে কোনোভাবেই মন থেকে ঠিক মেনে নিতে পারছিনা। প্রতিনিয়তই মনে হচ্ছে, এই বুঝি উনি ফোন করে ডাকবেন। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে, মানুষটা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তাঁকে হারিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলা বাসীর অপূরণীয় ক্ষতি হল। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।
বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে তিনি দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি করে গেছেন বহু জনসেবামূলক কাজ। তাঁরই অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে ধোপঘাটিতে ডঃ আম্বেদকর মিশন। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন গরিব দরদী, সমাজসেবী, সহজ-সরল উদার মনের মানুষ, ঠিক তেমনি অন্যদিকে ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। আজীবনকাল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ গর্জে উঠেছে। গর্জে উঠেছে তাঁর হাতের কলম। সর্বমোট বাইশটি গ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি কয়েকটি গ্রন্থের সম্পাদনার কাজও করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, তাঁর জীবনের শেষ বলিষ্ঠ লেখা ‘চুনী কোটালের আত্মহত্যা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে উদার আকাশ প্রকাশন থেকে। প্রকাশক ফারুক আহমেদ। এমন একজন উদার মনের মানুষের শেষ গ্রন্থ প্রকাশ করতে পেরে উদার আকাশ প্রকাশনের প্রকাশক ফারুক আহমেদ সাহেবও গর্বিত।
গত বুধবার ১৫ জুন ২০২২। বেলা তখন এগারোটা কি সাড়ে এগারোটা হবে তখন। আমি সেসময় বহরমপুরের বাইরে। অংশুমানদা আমাকে ফোন করে জানালেন, জগদ্বন্ধু স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ভর্তি ছিলেন মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে। সংবাদটা শোনামাত্র আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না– কথাটা আমি ঠিক শুনলাম, না ভুল শুনলাম।
জগদ্বন্ধু (বিশ্বাস) স্যারের সঙ্গে ২০০২ সাল থেকে লেখার সুবাদে পরিচয় হলেও তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না আমার। মাঝেমধ্যে সময় পেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম তাঁর গোরাবাজারের বাড়িতে। কিছুক্ষণ বসে গল্পগুজব করতাম। জানতে চাইতাম সম্প্রতি তাঁর নতুন কোনও বই বেরোল কিনা। তিনিও আপ্লুত হয়ে প্রকাশিত বইগুলি বের করে দেখাতেন। জানাতেন তাঁর মনের সব চাপা যন্ত্রণার কথা। কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি মাঝেমধ্যে আমাকে রসিকতার ছলে খোঁচা মেরে বলতেন, ‘তুমিতো বামুনের ছেলে, শূদ্রদের যন্ত্রণা বুঝবে না।’ আমিও স্যারকে রসিকতা করেই বলতাম, এভাবে লজ্জা দেবেন না স্যার। জন্মসূত্রে আমি বামুন (ব্রাহ্মণ) হতে পারি, কিন্তু বামুনবাদী (ব্রাহ্মণ্যবাদী) না। কোনও জাতি-বর্ণ ভেদাভেদ নাই আমার কাছে। এবং সেটা আর কেউ না জানুক আপনি অন্তত ভালো করেই জানেন। আমার চোখে সবাই মানুষ।’ স্যার আর কোন কথা না বাড়িয়ে হো হো করে হাসতেন। উপলব্ধি করতাম তাঁর হাসির মধ্যে একটা স্নেহের আন্তরিকতা ফুটে উঠত। সেই সময়কালেও যদি স্যার আমাদের ছেড়ে চলে যেতেন, তাহলে আজকে তাঁর জন্য মানসিকভাবে যে কষ্টটা পাচ্ছি, সেটা হয়তো পেতে হতো না।
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের কথা। হঠাৎ একদিন তিনি ফোন করে আমাকে তাঁর বাড়িতে ডাকলেন। পরদিন সকালে গেলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমাকে বললেন, ‘রবীন, তুমি যে বই প্রকাশের কাজ করো সেটা তো কোনদিন আমাকে বলোনি। আমার চারটে বই তোমাকে ছাপিয়ে এনে দিতে হবে। চারটে বইয়ের জন্য কত খরচ পড়বে, আর তোমাকে পারিশ্রমিক কত দিতে হবে, সেই হিসাবটা আমাকে দাও।’ আমি স্যারকে বললাম, ‘স্যার, আপনার বই প্রকাশের কাজটা যে করব এটাই আমার কাছে অনেক বড় পাওনা, অনেক বেশি আনন্দের।আমার সৌভাগ্য।’ তিনি আর কথা বাড়ালেন না। ওই দিন রাত্রেই আমাকে ফোন করে বললেন, ‘রবীন, তুমি আমাকে চারটে বই ছাপিয়ে এনে দাও, আমি তোমাকে খুশি হয়ে পঁচিশ হাজার টাকা উপহার দেব। কথামতো বই চারটে হাতে পেয়ে তিনি যারপরনাই খুশি। দিন কয়েক বাদে আমাকে বললেন, ‘রবীন তোমাকে আমি যে টাকাটা দেব বলেছি সেটা তোমার মেয়েকে উপহার হিসেবে দেব। এতে তোমার কোন আপত্তি নেই তো?’ আমি বললাম, ‘আপত্তি থাকবে কেন? এতো বরং খুশির কথা।’ তাঁর বই প্রকাশের সুবাদে ধীরে ধীরে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা এবং আন্তরিকতা বেড়ে উঠল।
গত লকডাউনের সময় একদিন শুনলাম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে তিনি মনমোহিনী হাসপাতালে ভর্তি। খবরটা শুনেই ভেবেছিলাম হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যাব। কিন্তু তার আগেই হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি চলে এসেছেন। বাড়িতে এলে একদিন তাঁকে দেখতে গেলাম। কথা প্রসঙ্গে তিনি হতাশার সুরে বললেন, ”আমি ক্যান্সারের রুগী। তারওপর আবার আমার বুকে পেসমেকার বসানো আছে। শুনেছি, পেসমেকার বসানোর পর মানুষ বেশিদিন বাঁচে না। তারমধ্যে আবার আমার স্ট্রোক হয়ে গেল। আমি হয়তো আমার শেষ বই দু’খানা ‘চুনী কোটালের আত্মহত্যা’ এবং ‘স্মৃতির পাতা থেকে’ (৩য় খণ্ড) দেখে যেতে পারব না।” তিনি যে মৃত্যুর আতঙ্কে ভুগছেন সেটা সেদিন তাঁর কথাতেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। কিন্তু সত্যি সত্যি যে এত তাড়াতাড়ি তিনি হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। আশার কথা এই যে, তিনি তাঁর শেষ বই দু’খানি দেখে যেতে পেরেছেন। ‘চুনী কোটালের আত্মহত্যা’ এবং ‘স্মৃতির পাতা থেকে’ (তৃতীয় খন্ড) বই দু’খানি যেদিন তাঁর হাতে তুলে দিলাম সেদিন অন্তর থেকে তিনি কতখানি যে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিলেন এবং আনন্দিত হয়েছিলেন সেটা আমি প্রত্যক্ষ অনুভব করেছিলাম। বই দু’টোকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্যার আনন্দে আপ্লুত হয়ে একগাল হেসে আমাকে বললেন, ”’উদার আকাশ’এর প্রকাশক (ফারুক আহমেদ) ফারুককে এর মধ্যেই একদিন ফোন করে আমি তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাব।” এরপরই তাঁর কণ্ঠে আবার সেই হতাশার সুর, ‘এ দু’টোই আমার জীবনের শেষ বই। আর হয়তো আমার লেখা হবে না। তবে এই বই দুটো যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হবে সেদিন আমাকে অনুষ্ঠানের ওখানে কিছু বক্তব্য রাখতে হবে। কিন্তু সবাই আমাকে বক্তব্য দিতে নিষেধ করছে শারীরিক কারণের জন্য। তাই স্থির করেছি আমার বক্তব্যটা লিখিত আকারে একটা (আমার কথা) পুস্তিকা প্রকাশ করব। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে এটা ছেপে এনে দাও। কারণ হাতে সময় নেই। আর তিনদিন বাদ দিয়েই অনুষ্ঠান। অবশ্য তুমি পারবে আমি জানি। কারণ তুমি হলে আমার মুশকিল আসান।”
স্যার (অধ্যাপক জগদ্বন্ধু বিশ্বাস)-কে হারিয়ে আজ সব স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে মনের মধ্যে। তিনি ছিলেন আমাদের মুর্শিদাবাদ জেলার গর্ব। তাঁর কাছে আমাদের বহু শিক্ষা নেওয়ার ছিল। কিন্তু তা আর কোনদিনই পূরণ হবে না। তবু তিনি আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল একজন বলিষ্ঠ অনুপ্রেরণাকারী অভিভাবক হিসাবেই থেকে যাবেন।
তাঁর স্মৃতিচারণা করতে করতে শেষমেশ এটুকু না বললে হয়তো অপূর্ণই থেকে যাবে — মৃত্যু হলেও তুমি অমর। তুমি অমর তোমার কীর্তির মাঝে। তোমার কোন কিছুই লিখে প্রকাশ করার স্পর্ধা আমার নেই। শুধু এটুকুই জানি, অমর হয়েই তুমি বিরাজ করবে চিরকাল আমাদের সবাকার হৃদয়ে।