” রাজ-ধর্ম ” এবং
ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী।
রাজধর্ম। নিঃসন্দেহে কঠিন বিষয়। আর, এ লেখার অনুপ্রেরণা যদি বলেন, এক কথায় কোচবিহার বাসীদের কাছ থেকে পাওয়া। ভারত-ভূক্তির পরে কবেই উঠে গেছে রাজ-শাষণ! তবু সেই মৃদু-গন্ধ আজও বহমান এখানের প্রতিটি অলিন্দে। গোসানীমারীর পরিত্যক্ত সে দিনের রাজপাট এর প্রতি এদের কী দুর্বলতা ! অবাক লাগে, বাকিংহাম প্যালেসের আদলে গড়া কোচ রাজা’র বাড়ি টার প্রতি এদের নাড়ির সে কী টান ! দেশ এখন স্বাধীন হয়েছে। সারা বিশ্ব থেকে রাজশাষণ-তন্ত্র উঠে গেছে বললেই হয়। নির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশ চলছে। এখন রাজার প্রসঙ্গ তোলাটাই তো এক রকম অবান্তর, তাই না ? আমি বলি, “মুকুট টা তো পড়ে আছে, রাজাই শুধু নেই।”
রাজা নেই, রাজনীতি আছে। রাজা নেই, রাজধানী আছে। রাজ্য নেই, রাজ্য-সভা আছে। আসলে, সব ই আছে। রাজার রুপোর মসনদ টাই কেবল বদলে গেছে মেহগনি কাঠে। আর, নেই বলতে একটাই সে দিনের সেই ‘রাজ-ধর্ম’।
আচ্ছা, কেমন ছিল ভারতের রাজধর্ম ? সেটা বুঝতে পিছিয়ে যাই চলুন, ২ য় চন্দ্রগুপ্ত এর আমলে। জানা যায়, ৩৯৯ খৃঃ থেকে ৪১৪ খৃঃ এর কোনো এক সময়ে এখানে এসে ছিলেন চীনা বৌদ্ধ পরিব্রাজক, ফা-হিয়েন। তাঁর দীর্ঘ্য ১০ বছরের ভারত-ভ্রমন কাহিনী তে তিনি তৎকালীন পাটলীপুত্র নগরী (বর্তমান পাটনা)র একটি ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।
ঘটনাটি ঘটছিল পার্শ্ববর্তী দুই গ্রামবাসীর মধ্যে। একজন কিনেছে অপর জনের থেকে একখন্ড জমি। জমি চাষ করতে গিয়ে, ক্রেতার লাঙ্গলের ফাল এর আঘাতে হঠাৎই একদিন উঠে আসে সোনার মোহর ভরা একটি ধাতব কলস। লাঙ্গল জমিতে ফেলে, ক্রেতা ছুটে বিক্রেতার বাড়ি। বলে,” এই কলস পেয়েছি সদ্য কেনা আপনার জমি চষতে গিয়ে। মাটি কিনেছি বাপু, মোহর কিনি নি। এই রইলো এখানে, আমি চললাম।” বিক্রেতা বলে, ” এ কী করে হয়? জমি কিনেছ মানে, জমির উপরে বা ভিতরে থাকা সব ই তো তোমার। এ সব নিয়ে তোমায় পাপের বোঝা আমি বইবো কেন? অগত্যা উভয়ে রাজার কাছে গিয়ে যে যার মতো করে নালিশ জানালো। রাজা সব শুনে বাকরুদ্ধ।
ভেবেই পাচ্ছেন না, কী হওয়া উচিৎ এর যথার্থ বিচার। পাশ থেকে এক প্রজা বলে উঠলো, ” রাজামশাই, ওরা আপনার রাজকোষে জমা দিয়ে দিক। আপনি পরে, দুস্থদের দান করে দিবেন।”
রাজা বললেন, ” শুনে রাখ, পাপের ধনে কখনোই পুন্যি হয় না, বুঝলে! তাই এ আদেশ আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।”
ভাবুন, এই ছিল সেদিনের রাজধর্ম, এই ছিল আপনার-আমার পরম্পরা।
মনু জী তাঁর সংহিতা তে লিখেছেনঃ
” সমীক্ষ্য স ধৃত সম্যক্ সর্ব্বা রঞ্জয়তি প্রজাঃ।
অসমীক্ষ্য প্রণীতস্তু বিনাশয়তি সর্ব্বতঃ।। “
রাজ-দন্ড ধারণের অধিকারী (রাজা/শাষক) বিবেকবান হলে সে দেশের প্রজা (জন-সাধারণ) নিত্য সুখে, আনন্দে থাকে। কিন্তু, অ-বিবেকী, লোভী রাজা নিজের সাথে রাজ্যবাসী কেও রসাতলে নিয়ে যায়।
গুরুদেব তাঁর ‘কথা’ কাব্যগ্রন্থের এক জায়গায় দেখাচ্ছেন, পুরী’র অদূরে মাঘ মাসের শীতের সকালে কাশী রাজ মহিষী সখীদের সাথে ‘বরুণা’ নদীতে স্নান করতে গেছেন। স্নানের শেষে, প্রবল শীতে যৌবনে উন্মত্ত রাণী শরীর গরম করতে পাশের কয়েটি ঝুপড়িতে আগুন লাগানোর আদেশ দেন। ঠিক তার পরের দিন রাজা দরবারে বসেছেন। এমন সময়ে সর্বহারা, গৃহহীন প্রজার দল এসে সবিনয়ে এই করুণ কাহিনী রাজা কে জানায়। আবেগে আপ্লুত রাজা মুহূর্তে রাজমহিষী’র কক্ষে ঢুকে জানতে চান,
” মহিষী, এ কী ব্যবহার !
গৃহ জ্বালাইলে অভাগা প্রজার—
বলো কোন্ রাজধরমে ! “
রাজ আদেশে, সহচরীরা রাজ-রাণী’র শরীর থেকে মণী-মুক্তো খচিত সাজ পোষাক খুলে ……” ভিখারী নারীর চীরবাস আনি
দিল রাণীদেহে তুলিয়া।”
এবার, মহারাণীর প্রতি কী আজ্ঞা হোল কাশী রাজের ?
“…………মাগিবে দুয়ারে দুয়ারে
এক প্রহরের লীলায় তোমার
যে ক’টি কুটীর হোল ছারখার
মতদিনে পার সে ক’টি আবার
গড়ি দিতে হবে তোমারে।”
এই যে লোক-ব্যবহার, এর ই পোষাকী নাম
” রাজ-ধর্ম “…………
যা’র অনিবার্য প্রতিদান ” রাজ-আনুগত্য “।
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown light on many fronts.