চলে গেলেন আবদুর রব খান, এক মানবিক কণ্ঠস্বরের মৃত্যু

0
199
আবদুর রব খান
আবদুর রব খান
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:14 Minute, 7 Second

চলে গেলেন আবদুর রব খান, এক মানবিক কণ্ঠস্বরের মৃত্যু

তৈমুর খান

মিষ্টভাষী, সহৃদয় কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদক আবদুর রব খান অনন্তের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন। ২৬ শে ডিসেম্বর ২০২৩-এ আমরা আরও একজন অভিভাবককে হারালাম। আরও একটা মানবিক কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেল। ২০১৬ সালে মুর্শিদাবাদের সালারে রাহিলা সাংস্কৃতিক পরিষদের ‘রাহিলা পদক’ প্রদান অনুষ্ঠানে শেষ দেখা হয়েছিল। তার আগেও বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। হাসিখুশি মানুষটি এতই আন্তরিক ছিলেন যে কাছে গেলে সর্বদা আপনজন বলেই মনে হতো। ৯ এর দশকে প্রথম যখন লেখালেখি শুরু করি তখন থেকেই ‘রাহিলা’র সঙ্গে পরিচয়। মূলত কবিতাই লিখে গেছি সেখানে। একবার একটি বড় গল্প লিখে যখন প্রকাশ করার মাধ্যম পাচ্ছি না, তখন তা ‘রাহিলা’র ঈদ সংখ্যায় পাঠিয়ে দিলে তা তৎক্ষণাৎ খুব গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। সেই গল্পটিরই নাম ছিল ‘জীবনের অংশ’। ‘রাহিলা’ ছিল একটি রুচিপূর্ণ মার্জিত পত্রিকা। লেটার প্রেসে ছাপানো হলেও পত্রিকাটির সৌন্দর্য কখনো ক্ষুণ্ণ হতো না। ‘রাহিলা’র যতগুলো অনুষ্ঠানে গেছি, সেখানে দেখেছি অনুষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে একটা সুন্দর ছক থাকত। কবি-লেখকরা শুধু লেখা পাঠ করেই ক্ষান্ত হতেন না, চলত আলোচনা-সমালোচনা, মতামত বিনিময়। আপ্যায়নেরও কোনো ত্রুটি হতো না। সালারের বাবলা গ্রাম ছিল ভাষা আন্দোলনের শহিদ বিপ্লবী আবুল বরকতের জন্মভূমি। স্বাভাবিকভাবেই একটি শ্রদ্ধা জেগে উঠত। তাই ‘রাহিলা’র অনুষ্ঠান মানেই একটা ঐতিহাসিক তীর্থক্ষেত্রকে দর্শন ও অভিবাদন জানাবার প্রয়াস।

আবদুর রব খান যে ধারায় কবিতা চর্চা করেছেন তা নতুন কোনো ধারা নয়, রবীন্দ্র-নজরুলের প্রেম-প্রকৃতি ও সুর-সৌন্দর্যের অনুচেতনায় নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার। কবিতা মেধার শুধু নয়, হৃদয়েরও মানবিক উচ্ছ্বাসের প্রকাশ তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাই একদিকে শিশুতোষ জীবনের মর্মরিত আলোক সত্তা তাঁর কবিতায় প্রশ্রয় পেয়েছে, অপরদিকে মানবিক রসের প্রগাঢ় রূপায়ণ ঘটেছে। রোমান্টিক সত্তার সঙ্গে চিরপ্রেমিক সত্তা সংযুক্ত হয়েছে। যেখানেই মানবসংহার সংঘটিত হয়েছে, যেখানেই বিদ্বেষের বিষবাষ্প উঠেছে— কবি সেখানেই তাঁর প্রেমের অমৃতবাণী শুনিয়েছেন। ‘মানুষের থেকে কিছু বড় নয়’ এই বিশ্বাসই কবির কাছে চিরসত্য । তাই তাঁর কবিতা যখনই পড়ি, তখনই মনের মধ্যে এক সুরধ্বনির প্রবাহ উপলব্ধি করি। সুরের সাকিকে হৃদয়ের উৎস হতে উৎসারিত হতে দেখি। কবিতা যেন সকলেরই, সকল সময়েরই জীবন-নদীর তীব্র আবেগ, তাতে অবগাহন করা যায়, সাঁতার দেওয়া যায়, তৃষ্ণা নিবারণ করা যায় এবং ভালোবাসা যায়। ’পদক্ষেপ’,‘তোমাকে পাবার জন্য’,‘আকাশ মাটির কাছাকাছি’, ‘অবশেষে’ প্রভৃতি কাব্যগুলিতে সহজ সাবলীল এই সুরমাধুর্য ধরা পড়ে। একটি কবিতা উল্লেখ করি:

“স্নিগ্ধ আলোয় দেখেছি তোমায়
তুমি বড় সুন্দর
পূজার প্রতিমা তুমি যে আমার
ভরে দিলে অন্তর ।

গানেগানে ঐ পূজামণ্ডপ
মুখর হয়েছে আজি,
তব দরশনে হৃদয় আমার
সাজিয়েছে ফুলসাজি ।

ভুলে গেছি মা গো দুঃখ-বেদনা
দরশন করি’ চন্দ্রবদনা
অঞ্জলি লহ মোর।।

আরতির লাগি’ মুখপানে চায়
খালিহাতে মোরে দিও না বিদায়
তোমার আলোতে আলোকিত কর
আমার আঁধার ঘর ।।”

কবিতাটির নাম ‘আরতি’, যে আরতি শুধু নিজের জন্য নয়, দেশ, জাতি ও মানুষের জন্য। আঁধার দূর করার সেই আলোর আরতি।
লকডাউনের সময়কালে মানুষের দুর্গতি ও মৃত্যু দেখে কবি হাহাকার করে উঠেছেন। ব্যথিত হৃদয়ে কলম তুলে নিয়ে যে শব্দ সাজিয়েছেন তা যে একজন মানবদরদী কবির পক্ষেই সম্ভব তা বলাই বাহুল্য:

“পৃথিবী কাঁপিয়ে মৃত্যু মিছিল
নিয়ে এলো মহামারি।
লকডাউনেতে শান্ত হয়েছে দেশ—
চমকে উঠেছে, থমকে গিয়েছে
করোনার বাড়াবাড়ি।
মানুষই পারবে যুদ্ধ করিতে শেষ।
রাতের আকাশে ফুটিয়া উঠিছে তারা,
গাছপালা আজ সবুজ হয়েছে ঢের।
পাখপাখালির গানে ভরে উঠে পাড়া—
আমার বাগানে ফুল ফুটিয়াছে ফের।
শহরে এখন দূষণ মাত্রা
অনেক গিয়েছে নেমে—
খোলা প্রাঙ্গণে শ্বাস-প্রশ্বাস
বুক ভরে নিতে পারি,
বাতাসে ভাসে না ধূলিকণা আর
শব্দ গিয়েছে থেমে।
করোনা যুদ্ধে মানুষ জিতেছে,
হেরেছে হত্যাকারী।
সেবার মানুষ একসাথে গান গাই
আমরা করবো জয়, নিশ্চয়।”

কবিতার নাম ‘আমরা করবো জয়’ লিখেই মানুষের কবি আত্মবিশ্বাস জাগাতে চেয়েছিলেন। করোনাকালীন যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছিলেন এই কবিতায়। এই সময়কে যখন ভবিষ্যতে কেউ উপলব্ধি করতে চাইবে, তখন এই কবিতাই তার কাছে ইতিহাস হয়ে উঠবে। কবি তো সময়কে এড়িয়ে যেতে পারেন না, তাই সময়ের উচ্চারণ এই কবিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

জীবনের শেষদিকেও যে কবিতা লিখে তিনি মানবতাবাদেরই জয় ঘোষণা করেছিলেন তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্র তথা শাসক যখন দেশের মানুষকে উৎখাত করার পক্ষে, জাতি-ধর্ম বিভক্তিকরণে রাজনীতির বাতাবরণ তৈরি করেছেন, তখন মানবজাতির তথা মানুষের মহিমা কীর্তন করেই তিনি কবিতা লিখেছিলেন। এ ধরনেরই একটি কবিতা আমাদের সকলের বিবেক হয়ে উঠেছিল। আমাদের সকলের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল। কবিতাটির নাম ‘আমি চাই’। আসুন একবার পড়ে নিই:

“আমি চাই বন্ধ হোক এই নাশকতা,
আমি চাই আকাশছোঁয়া শুভ্রপাখি—
আমি চাই রক্তে মিশুক মানবতা,
আমি চাই মিলেমিশে সবাই থাকি।

আমি চাই জমির বুকে ফসলধারা
আমি চাই ক্ষুধা তাড়াক অন্নহারা।

আমি চাই নদীর মতো চলৎ গতি—
আমি চাই দামাল ছেলের বিজ্ঞমতি,
আমি চাই একটুখানি প্রাণের পরশ,
আমি চাই সকালবেলার মুক্ত হরষ।

আমি চাই অগ্রগতির চক্র ঘুরুক—
আমি চাই সবখানেতেই শান্তি ফিরুক।

আমি চাই জগৎ শির্ষে আমার এ দেশ
আমি চাই বলবে না কেউ এটা বিদেশ—
আমি চাই এই মাটিতেই বিলীন হতে,
আমি চাই এই মাটিতেই স্বর্গ পেতে।”

দেশকে, মানুষকে, জীবনকে ভালোবাসার থেকে আর বড় ঘোষণা কিছু নেই। এই কবিতাটি কবির জীবনচেতনারই সমূহ প্রকাশ। কতখানি বড় মাপের মানুষ ছিলেন, কতখানি হৃদয়বান ছিলেন তা এই কবিতাটিতেই বোঝা যায়। কবিতার শিল্পকলা নিয়ে তিনি পরীক্ষা করতে চাননি, তিনি চেয়েছিলেন শান্তিতে সহাবস্থান, জীবন-ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের গৌরবময় উপস্থিতি। ঘৃণা-বিদ্বেষ নয়, প্রেমই মানুষকে সব কিছুর সমাধান দিতে পারে— এই লক্ষ্যেই তিনি লিখে গেছেন এক একটি কবিতা। তাই তাঁর কবিতা জীবনচেতনায় যতখানি বড় হয়ে উঠেছে, শিল্পচেতনার বাঁক পরিবর্তনে ততখানি পথ অন্বেষণ করেনি। তাই তাঁর কবিতার দাবি মানবহৃদয়ের কাছে, সভ্যতার কাছে, প্রেমের কাছে, আমাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের কাছে।

আবদুর রব খান একজন দক্ষ গদ্যকার হিসেবেও সারস্বত পাঠকের কাছে সমীহ আদায় করে নিয়েছেন। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য-কলা-বিজ্ঞান এবং সাহিত্যিকদের নিয়েও তথ্যপূর্ণ মননশীল গদ্য লিখেছেন। দীর্ঘদিন ধরে এইসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণার ফসল ‘চিন্তা চেতনা’ নামক দু’খণ্ড প্রবন্ধ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই দু’খন্ড গ্রন্থে সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস-দর্শনের পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্র,নজরুল, লিয়াকত হোসেন, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, জসীমউদ্দীন, এস ওয়াজেদ আলী, ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ওমর খৈয়াম, বেগম রোকেয়া, দানবীর মহসিন, গোলাম মোস্তফা, এম আবদুর রহমান, সোহরাব হোসেন প্রমুখ সাহিত্যিক-কবি, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, সমাজ সংস্কারকদের নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। প্রতিটি আলোচনার মধ্যে তাঁর দরদী মনের ছাপ স্পষ্ট। তাঁদের ব্যক্তিত্ব, জাতীয়তাবাদ, সৃষ্টি, মানবিকচেতনা, শিল্পনৈপুণ্য তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনী তুলে ধরেছেন ‘মুক্তির সংগ্রামে ভারত’ গ্রন্থে।স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের গৌরব ও অবস্থান এই গ্রন্থ থেকেই জানা সম্ভব। ‘আলোকিত চেতনা’ গ্রন্থটিও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জ্বল।

‘লড়াই’,’বাবলার ফুল’, ‘জীবন মানে আমি’,’তিস্তার ঢেউ’ প্রভৃতি উপন্যাসগুলিতেও জীবনচেতনা এবং জীবন সংগ্রামেরই জয় ঘোষণা আছে। সেখানে প্রেম মূল বিষয় হলেও জীবনের গৌরবকে কবি এড়িয়ে যেতে পারেননি। বর্ণনার ভাষাতেও কাব্যিক সমন্বয় ঘটেছে।
ছোটদের জন্য লেখা ছড়া ও গল্পগুলিও খুব মজার, শিশু মনস্তত্ত্ব কোথাও লঙ্ঘিত হয়নি। শিশুপাঠ্য বইগুলির মধ্যে উল্লেখ্য ‘শিশুসওগাত’, ‘ছোটদের ছোট গল্প’, ‘ছবির গায়ে ছড়া’, ‘Blooming Bud’ প্রভৃতি। এসব ছাড়াও বেশ কিছু ভ্রমণ কাহিনিও লিখেছেন।

লেখক হিসেবে বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্বর্নাও পেয়েছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
‘সবুজ অবুঝ সাহিত্য পুরস্কার’,‘বক্তার নগর সাহিত্য পুরস্কার’,‘কলমপাঠক বৃত্ত সম্বর্ধনা’(ঢাকা ),‘সকাল ও সুবচন সম্বর্ধনা, (ঢাকা ) এবং ১৪০২ সালে ‘নতুনগতি নবাব হালসানা স্মৃতি পুরস্কার’ ইত্যাদি।

আবদুর রব খান জন্মেছিলেন মুর্শিদাবাদের সালার থানার সরমস্তপুর গ্রামে ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুলাই। কবির শেষ কর্মস্থল ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের পোলেরহাট হাইস্কুল।তাই ভাঙড়েই বসবাস করতেন। স্ত্রী হাসনুহেনা বেগমও ছিলেন একজন শিক্ষিকা ও সাহিত্যিক। দুজনে মিলেই সম্পাদনা করতেন ‘রাহিলা’ পত্রিকা। উল্লেখ্য রাহিলা ছিল কবির মায়ের নাম। মা-কে স্মরণীয় করে রাখতেই পত্রিকার নামকরণও করেন রাহিলা। রাহিলাকে কেন্দ্র করেই সালারের ‘কবিপল্লী’ যা রাহিলা সংস্কৃতি সংঘ একটি সাহিত্যের পিঠস্থানে পরিণত হয়।’তৈরি হয় ‘রাহিলা একাডেমি’। দাদা আবদুর রফিক খানও একজন নামকরা কবি। এই সংঘেরই প্রধান পরিচালক। কবি বা লেখকের মৃত্যু হয় না, মৃত্যুর পরই শুরু হয় তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন। আবদুর রব খানের ক্ষেত্রেও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না।

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here