রামের সাথে রামকৃষ্ণের জয়ধ্বনি না দিলে বিজেপির পক্ষে বাংলা দখল কখনোই সম্ভব নয়
“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর,
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়,”
হীরক মুখোপাধ্যায় (২ সেপ্টেম্বর ‘২০):- যে রাজনৈতিক দিগ্গজ বা বুদ্ধিজীবী যে কথাই বলুকনা কেনো, রামের সাথে রামকৃষ্ণের জয়ধ্বনি না দিলে বিজেপির পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ দখল কখনোই সম্ভব নয়।
এই কথা যে শুধু আমি বলছি তাই নয়, ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’-র পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ শাখার অতিবুদ্ধিমান রাজনৈতিক নেতারাও বোঝেন। আর বোঝেন বলেই, গত লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-কে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন-এর সদর দপ্তর ‘বেলুড় মঠ’-এ পাঠিয়ে যে ‘মাস্টার স্ট্রোক’ দিয়েছিলেন; তারই ফল ১৮ জন সাংসদ।
এইটুকু পড়ে রাজ্য বিজেপি ঘনিষ্ঠ অনেক কর্মী ও নেতৃবৃন্দ অভিযোগ তুলতে পারেন, বিবাহের আগে থেকেই নরেন্দ্র মোদী রামকৃষ্ণদেবের অনুরাগী, তিনি একসময় রামকৃষ্ণ মঠে ব্রহ্মচারী হওয়ার জন্যও বিস্তর ছোটাছুটি করেছিলেন। তাই নরেন্দ্র মোদী-র বেলুড় মঠে যাওয়া নিতান্তই ওঁনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এর সাথে বিজেপি-র পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ শাখার কোনো নেতার কোনো সংশ্রব নেই।
যাঁরা এই কথা ভাবছেন, তাঁদের অবগতির জন্য বলি; একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে নিজের থেকে দলের হিত সর্বাগ্রে স্থান পায়। তাই তাঁর বেলুড় মঠে যাওয়া পুরোটাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর সাথে ধর্মীয় আবেগের কোনো স্থান নেই।
একটু ভাবলেই বিষয়টা আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। নরেন্দ্র মোদী তো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী রূপে ক্ষমতার অলিন্দে ছিলেন। ধর্মীয় চিন্তা থেকে আগমন হলে আগে আসেননি কেনো !
মোদী ভক্তরা বলতেই পারেন, একসময় যে সংগঠন তাঁকে স্থান দেননি দেশের সর্বাধিনায়ক রূপে তিনি সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, এই ভাবনার মধ্যে দম্ভ, অহঙ্কার মিলেমিশে থাকলেও ধর্মীয় দৈনতার কোনো স্থান ছিলনা। এটা নরেন্দ্র মোদীও যেমন জানেন, ঠিক তেমনই জানেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন-এর বিচক্ষণ সন্ন্যাসগণ।
তাই তাঁরা নরেন্দ্র মোদী-কে প্রধানমন্ত্রী রূপে সম্মান প্রদর্শন করলেও ঘরের ছেলে বলে গ্রহণ করেননি।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের এতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থাকলেও সব সংগঠনকে ছেড়ে রামের সাথে রামকৃষ্ণ-র জয়ধ্বনি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে কেনো ?
আসুন ইতিহাসের আলোকে একটু চর্চা করা যাক। কে এই রামচন্দ্র ওরফে রাম ?
নারায়ণের দশাবতারের এক অবতার রাম। রামের নিবাস ছিল অযোধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রামকে অবতারের সম্মান দিলেও গোবলয়ের বাসিন্দাদের মতো কোনোদিনই রামকে দেবতা জ্ঞান করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে জয় শ্রী রাম ধ্বনি দেননি, দিতে অভ্যস্তও নয়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত রামনবমীর একটা ছুটিকে ঘিরেই পশ্চিমবঙ্গে রাম নিয়ে যতো মাতামাতি ছিল। তা বলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যে কোনোদিন রামকে অশ্রদ্ধা করেছেন তেমন কোনো ঘটনা নেই। আজ থেকে কিছুদিন আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের একাংশের মানুষ রাম নাম দিয়ে গণণা শুরু করতেন। বোঝার সুবিধার জন্য বলি- রাম, দুই, তিন, চার বলে গণণা করতেন। এখানকার মানুষ রামকে ভালোবেসে শ্রদ্ধাকরে তাঁর নামে সন্তানাদির নাম রেখেছেন। রামের বিশালতা বোঝাতে রামদা, রামছাগল ইত্যাদিও আখ্যায়িত করেছেন, কিন্তু এখনো পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রত্যেক ঘরে যেভাবে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ওরফে নিমাই বা প্রণবানন্দের ছবি আছে তার ধারে কাছে নেই রামের ছবি। অর্থাৎ সেই অর্থে এখনো পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় মূলস্রোতে রাম ঢুকতে পারেনি।
এই পর্যন্ত পড়ে অনেকেই কৌতূহলী হতে পারেন পশ্চিমবঙ্গে চৈতন্য ও প্রণবানন্দের মতো ব্যক্তি যখন রয়েছে তখন সবাইকে ছেড়ে রামকৃষ্ণ-র জয়ধ্বনি কেনো দেবে বিজেপি ?
সঠিক প্রশ্ন। এর সম্ভাব্য উত্তর অনেকটা এরকম, ব্যক্তি পাণ্ডিত্যে রামকৃষ্ণ-র তুলনায় হয়তো সহস্র যোজন এগিয়ে নিমাই ওরফে চৈতন্য ওরফে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। কিন্তু ওঁনার তিরোধানের পর একে তো গৌড়িয় বৈষ্ণবরা নিজেদের সেভাবে সংগঠিত করতে পারেননি, তাঁর উপর বর্তমান শিক্ষা থেকে কোটি যোজন দূরে শুধুমাত্র ধর্মীয় আবেগ নিয়ে অবস্থান করছেন বৈষ্ণবগণ। তাই বিজেপির প্রয়োজনের তুলনায় এদের যোগদান কখনোই উল্লেখযোগ্য হবেনা।
অন্যদিকে প্রণবানন্দ যেভাবে ধর্মস্থানগুলোকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করে ধর্মপ্রাণ মানুষদের অর্থ, সম্মান ও প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন তার ধারেকাছে অন্য কোনো সংস্থা না থাকলেও রাজ্যের প্রথমসারির ব্যক্তিদের নিজেদের তাঁবুতে আনতে এখনো এঁরা সেভাবে পারঙ্গম হয়ে ওঠেনি।
এই মুহুর্তে পশ্চিমবঙ্গের বুকে যতগুলো হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের মধ্যে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন-এর সাথেই রাজ্যের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী মানুষের নিবীড় যোগাযোগ রয়েছে।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন-এর সাধুদের গড়পড়তা শিক্ষাগত যোগ্যতার ধারেকাছে নেই অন্য কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাধু-সন্ন্যাসীরা।
সুতরাং রাজ্যের বুদ্ধিজীবী মহলের কাছে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছতে গেলে রাম এর সাথে রামকৃষ্ণ-র জয়ধ্বনি দেওয়া ছাড়া রাজ্য বিজেপি-র হাতে দ্বিতীয় আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।
যদিও বিজেপি-র পশ্চিমবঙ্গ বিজয়ের সহজসাধ্য রাস্তায় ইতিমধ্যে কাঁটা বিছতে শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।
পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত লোকসভা নির্বাচনের আগে, নরেন্দ্র মোদী বেলুড় মঠ যাওয়ার পর পরেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বেলুড় মঠ পরিদর্শনে গিয়ে ওখানকার পদাধিকারীকদের বলে আসেন, “আমি আপনাদের ঘরের মেয়ে। যখনই কোনো প্রয়োজন হবে আমাকে ডাকবেন। কিছু করতে পারি চাই না পারি নিজের হাতে আপনাদের বাসন মেজে দিয়ে যাব।”
কিন্তু ‘বেলুড় মঠ’-এর তীক্ষ্মমেধা সন্ন্যাসরা খুব ভালোই জানেন, মমতার কাছে বেলুড় মঠ বা ফুরফুরা শরিফের আলাদা কোনো সম্মান নেই, উনি শুধু ভোট চেনেন। আর ঠিক সেই কারণে আজ মমতা যুগপতভাবে বেলুড় মঠ ও ফুরফুরা শরিফের কর্ণধারদের কাছে অনেকটাই পরিত্যাজ্য।
এই মুহুর্তে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা ভারতীয় জনতা পার্টি-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নেতৃত্বর অনেকেই নির্বোধের মতো ভাবছেন, কেন্দ্রীয় পুলিস বাহিনী আনলেই রাজ্যের ২৯৪ টা আসনের বেশিরভাগ আসনেই পদ্মফুল ফুটবে।
না, অতো সহজ নয়। দুর্যোধন যদি বলে থাকেন, “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী”, তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসও ওই একই কথা বলবে।
উপরন্তু গত লোকসভা নির্বাচনের পর একদিকে বিভিন্ন কার্যকারণ বশতঃ নরেন্দ্র মোদী-র আকাশচুম্বি ইজ্জতও আজ অস্তাচলগামী। অন্যদিকে, রাজ্য বিজেপি-র সাংগঠনিক ব্যর্থতা বলে বোঝাবার নয়।
এরা এখনো পর্যন্ত রাজ্যের প্রত্যেকটা বাড়ি ঘুরে মানুষের সমস্যার কথা যেমন শোনেনি, তেমনই দলীয় চাহিদার কথাটাও বলে উঠতে পারেনি।
পশ্চিমবঙ্গের মাথামোটা বিজেপি নেতারা পররাজ্যে বিজেপি জয় পেলে যতটা আত্মহারা হয়ে লাড্ডু বিতরণ করেন, রাজ্যের একজন বিজেপি কর্মী মারা গেলে সেই তুলনায় কোনো কর্তব্যই প্রতিপালন করেননা।
প্রদেশ বিজেপি নেতৃত্ব ও তাঁদের বশংবদ জেলা নেতৃত্ব ভেবে রেখেছেন মাথার উপর মোদী আছেন, পাশে বিজয়বর্গীয় আছেন, সাথে দিলীপ ঘোষ আছেন, আর সাইড লাইনের বাইরে ‘পোষ্য’ মুকুল রায় আছে এবার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে ঠেকাবে কে ?
না সমীকরণ এখানেই শেষ নয়, বরং জটিল সমীকরণ এখান থেকেই শুরু।
একে তো এই মুহুর্তে আগের মতো আর মোদী ম্যাজিক দেশের কোথাও চলছেনা। ইউটিউবে মোদীর অনুষ্ঠানে যে হারে ডিসলাইকের বহর বাড়ছে তা যথেষ্টই আতঙ্কের বিষয়। তার উপর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করিয়ে মোদী সেইসময় যতটা সাড়া ফেলেছিলেন, ‘গালওয়ান’ কাণ্ড ও তার পরে চিনের আগ্রাসন নিয়ে মোদী ততটাই নীরব। অতিবড়ো মোদী ভক্তরাও এই বিষয়টা মনে মনে মেনে নিতে পারছেননা।
তার উপর গত লোকসভা নির্বাচনে মুকুল রায় যেমন তাঁর খেলা দেখিয়েছেন, এবার যদি কোনো কারণে সেই খেলা বন্ধ করেন, তাহলে বিজেপি কী পারবে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে ?
এই মুহুর্ত পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি এটাও স্থির করতে পারেনি, কে হবে দলীয় স্তরে মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার ?
সুতরাং মানুষ কী দেখে, কাকে দেখে, কোন আদর্শকে সামনে রেখে রাজ্যে আবার পরিবর্তন আনবে ?
এমনিতেই সমগ্র ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের তকমা পেয়ে বসে আছে ভারতীয় জনতা পার্টি।
ঠিক এই রকম অবস্থায় সর্বধর্ম সমন্বয়কারী কোনো সংস্থার হাত না ধরলে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি কী কস্মিনকালেও বিধানসভা নির্বাচন নামক রাজনৈতিক বৈতরণী পেড়িয়ে মসনদে বসতে পারবে ?
না বিজেপি ও তাদের সবজান্তা, অতিবোদ্ধা নেতারা এখন থেকে আদাজল খেয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়লেও রাজ্যে গণহারে পদ্মফুল ফোটাতে পারবেননা।
কিন্তু যে মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি রাম-এর সাথে রামকৃষ্ণ-র জয়ধ্বনি দেওয়া শুরু করবে, ঠিক সেই সময় থেকে যুদ্ধ জয় শুধু সময়ের অপেক্ষায় পরিণত হতে পারে।
যে পদ্ধতি মেনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জ্যোতি বসুর পাদবন্দনা করে মসনদে এসেছেন। ঠিক একই পদ্ধতিতে বিজেপি যতক্ষণ পর্যন্ত রামের সাথে একই সঙ্গে রামকৃষ্ণ-র জয়ধ্বনি দেবে ততক্ষণ ভারতীয় জনতা পার্টি-র পশ্চিমবঙ্গ জয়ের চিন্তা করাটাও এক অলীক কল্পনা মাত্র।
তাই রাজনৈতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসতে গেলে রামের সাথে রামকৃষ্ণ-র জয়ধ্বনি দেওয়া ছাড়া বিজেপি-র আর দ্বিতীয় রাস্তা নেই।
***লেখাটা দিয়ে লেখক অনুরোধ করলেন দাদা একটু সেনসেটিভ বিষয় , দেখে ছাপবেন । প্রচন্ড ভয় পেলাম , প্রায় খাটের তলায় পালাবো কিনা ভাবছিলাম , এমন সময় ঠাকুরদা আজাদ হিন্দ বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ক্ষিতিশ মুন্সীর ছবিতে চোখ পরে গেলো এবং প্রায় সাথে সাথে প্রাণের ঠাকুর রবিঠাকুরের লাইন গুলো মনে পরে গেলো । ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন অফ কনস্টিটিউশন অফ ইন্ডিয়া কে ভরসা করে আপনাদের জন্য নিয়ে এলাম ।***
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করে নি শতধা, নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ;
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত৷”
***