স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ মেনেই ঈদ উৎসব বার্তা দিক সুস্থ সমাজ গড়ার
ফারুক আহমেদ
ঈদ শব্দটি আরবি। ‘আউদ’ ধাতু থেকে এসেছে, এর অর্থ হলো, পুনরাগমন যা বারবার ফিরে ফিরে আসে। বৎসরান্তে নির্দিষ্ট সময়ে বারংবার ফিরে আসে বলেই এই মিলন ও সম্প্রীতির উৎসবের নাম হয়েছে ঈদ। করোনা চারিদিকে তাই সমস্ত স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ মেনেই ঈদ উৎসব পালিত হোক সর্বত্র সচেতনতামূলক বার্তা দিয়েই। দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের নামাজ পড়তে হবে অল্প কিছু মানুষ জমায়েত হয়ে। ১৫ থেকে ২০ জন মিলে সবাই ঘরেই এবার ঈদের নামাজ আদায় করেতে এগিয়ে আসুন এবং সুস্থ সমাজ গড়ার কাজে হাত লাগান।
ঈদ-উল-ফিতর “রোজা ভাঙার দিবস” ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের একটি ‘ঈদ-উল-ফিতর’ আর দ্বিতীয়টি হলো ‘ঈদ-উল-আজহা’। ধর্মীয় পরিভাষায় একে ইয়াউমুল জায়েজ (অর্থ পুরস্কারের দিবস) হিসাবেও বর্ণনা করা হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনার পর মুসলমানেরা এই দিনটি ধর্মীয় কর্তব্য পালন সহ খুব আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকে। ঈদ মোবারক হলো মুসলিমদের একটি ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছাবাক্য, যেটি তারা ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আজহা’য় পরস্পরকে বলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে থাকেন। ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ বা উদযাপন। আর মোবারক শব্দের অর্থ কল্যাণময়। সুতরাং ঈদ মোবারকের অর্থ হলো ঈদ বা আনন্দ উদযাপন কল্যাণময় হোক। কিছু রাষ্ট্রে এই শুভেচ্ছা বিনিময় একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং কোন ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার অংশ নয়। তবে, এই শুভেচ্ছাবাক্যটি শুধুমাত্র এই দুই মুসলিম উৎসবের সময় ব্যবহৃত হয়। মুসলিম বিশ্বে ঈদ-উল-আজহা ও ঈদ-উল-ফিতর’এ শুভেচ্ছা জানানোর জন্য অন্যান্য অনেক শুভেচ্ছাবাক্য রয়েছে।
ঈদ-উল-ফিতর’-এ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) সাহাবীদের সাথে সাক্ষাতের সময় একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ (আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন)।
ঈদ সকলের মনে খুশি আনে। তাই খুশির উৎসব হলো ঈদ। খুশির জন্য চাই সকলের খোলামেলা মন। মুক্তমনের বহিঃপ্রকাশই ঈদ মিলন উৎসব সার্থক হয়। তাই ঈদের আনন্দ খুশি ছড়িয়ে পড়ে সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধির সীমানা আলগা করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে সকল সম্প্রদায়ের কাছে চিরন্তন সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, শাশ্বত প্রেম ও মহামিলনের খুশির বার্তা নিয়ে। ‘ফিতর’ অর্থে খুলে যাওয়া মুক্ত হওয়া বা পূর্ণতাপ্রাপ্ত, যা সমাপ্ত হওয়া বোঝায়। কেউ কেউ ফিতর অর্থে শেষের পর্বে খাওবার অর্থ বুঝে থাকেন। তাই ঈদ-উল-ফিতর সেই বিশেষ দিনটির নাম, যেদিন দীর্ঘ এক মাস রমজানের নিয়মানুগ কঠোর উপবাস ও এবাদত সব রকম অপরাধ থেকে দূরে থাকার বিধি-নিষেধ, অনুশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সাধনায় নিযুক্ত থেকে পুনরায় দৈনন্দিন আহারের নিযুক্ত হওয়ার অনুমতি। আসলে ঈদ-উল-ফিতর হলো আল্লাহর কাছ থেকে পাপমোচন করে নিজেকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনা। তাই মহানন্দে পালিত হয় খুশির উৎসব ঈদ-উল-ফিতর।
নবী করিম (সঃ) বলেছেন, ”নিশ্চয়ই প্রত্যেক জাতির ‘ঈদ’ অর্থে আনন্দোৎসব আছে। তাই আজকের দিন অর্থাৎ ঈদ-উল-ফিতর হলো আমাদের সকলেরই সেই খুশির ঈদ।”
ঈদ সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য প্রসন্নতার সুখবর এনে দেয়। ঈদের দিন সকল সামর্থ্যবান মুসলিমকেই মুক্ত হাতে ফেতরা, যাকাত, সাদকা ও দান খয়রাত করতে হয়। যার ফলে, আমাদের সমাজের প্রতিটি আর্তপীড়িত, অসহায়, বিপন্ন, সর্বহারা ও হতদরিদ্র মানুষেরাও এই খুশির ভাগ নিতে পারেন। এখানেই এই মিলন উৎসবের সতর্কনামা সকলের মধ্যেই সঞ্চারিত হয়। ঈদ হলো ত্যাগের, ধৈর্যের, ক্ষমার, ভালোবাসার, সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতীক।
সকলের মনে ন্যায় ও নীতিই সঞ্চারিত করার পক্ষে আদর্শ।
সকল মুসলিম রমজান মাসে রোজা রেখে ক্ষুধা ও তৃষ্ণাকে ভুলে গিয়ে কঠোর সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে নিজের দোষ ত্রুটি সংশোধন করে আত্মশুদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর হয়ে আল্লাহ’র নৈকট্য লাভ করতে পারেন।
নবী করিম (সঃ) বলেছেন, ”যে রোজা আমাদের আত্মশুদ্ধি করে না, সেই রোজা প্রকৃত রোজা নয়, তা নিছক উপবাস মাত্র যা গন্ধহীন ফুল কিংবা নিঃষ্প্রাণ দেহ মাত্র।” তাই খাদ্য ও পানীয় থেকে দূরে থাকার নাম রোজা নয়। প্রকৃত রোজা হলো অন্যায় ও অসৎ চিন্তা থেকে বিরত থাকা।
‘রমজান’ শব্দের অর্থ হলো অগ্নিদগ্ধ। যে মাসে রোজা পালনের মধ্য দিয়ে অনাহারের তীব্র দহনজ্বালা ও সহনশীলতার কঠিন পরীক্ষা, সেই মাসের গুণগত নাম হলো রমজান। রোজার উপবাস দ্বারা প্রশমিত হয় রোজদারের অসৎ চিন্তা ও কু-মনোবৃত্তি। সিয়াম সাধনায় মানুষের মনে বেড়ে যায় তাঁর আত্মিক, মানসিক ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি। তাই মাহে রমজানে মুসলিমদের মনে ও সমাজে নেমে আসে দয়া, মায়া, স্নেহ-প্রীতি, ভক্তি-করুণা ও সহনশীলতার মতো অজস্র সৎ চিন্তার বিচিত্র সমারোহ।
মুসলিম জাহানে রমজান মাস হলো রহমতের মাস, বরকতের মাস, গোনাহ (পাপ) মাফ হওয়ার মাস, আল্লাহ’র অসীম করুণায় নৈকট্যলাভের মাস, আত্মশুদ্ধির মাস, ধৈর্যের মাস, সাধনার মাস ও সকল দুঃস্থ-গরিব-অনাথ ও দীন-দুঃখীর সাহায্য করার মাস।
প্রকৃত সমাজ বিকাশে ও শিক্ষা প্রসারের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ারও মাস। তাই শাশ্বতকালের চিন্তন-সাম্য-মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রীতির বন্ধন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জাতীয় সংহতির জ্বলন্ত প্রতীক হলো মহামিলনের মহোৎসব ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ পালনে আসুন সবাই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মধুর আলিঙ্গনের মধ্যে খুঁজে পাই– বৈচিত্রের মধ্যে একতার মধুর ও অনাবিল ঐকতানের আনন্দ খুশির অত্যুজ্জ্বল সুবর্ণময় তিথি। ঈদ বয়ে আনুক বিশ্বের সকল মানুষের জন্য অফুরন্ত শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধি এবং গভীর ভালোবাসা। তাই আসুন, আমরা সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদকে দূরে ঠেলে ঈদ মিলনের মধ্য দিয়ে সম্প্রীতির বন্ধনে ও আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে প্রকৃত মানুষ রূপে নিজেদেরকে গড়ে তুলি। আর তা করতে পারলেই দেশ ও দশের সত্যিই মঙ্গল হবে। সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা ও মানুষের ক্ষতিসাধন থেকে সাধারণ মানুষদেরকে বুঝিয়ে সৎ পথে আনতে পারলেই সমাজ উপকৃত হবে। তখনই মহতি ঈদ পালনের উদ্দেশ্য সফল হবে বলে মনে করি। তাই এই সমাজকে শিক্ষা সচেতন করে তোলা জরুরি। ঈদ মিলনের ময়দানে জায়নামাজে দু’হাত তুলে শেষ দোয়ার শপথ নিতে হবে আমাদেরকে সকলের জন্য সুস্থ সমাজ গড়ার। মনের মধ্যে রাগ অভিমানকে কমিয়ে নিজেদের অধিকার নিজেদেরকেই অর্জন করতে হবে। কারণ কারও মৌলিক অধিকার কেউ পাইয়ে দিতে পারেনা, তা নিজ যোগ্যতায় ছিনিয়ে নিতে হয়। নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও কাটাকাটি না করে কে কি দিল আর দিল না এই ভেবে সময় নষ্ট করার থেকে যার যেটুকু ক্ষমতা আছে তাই দিয়ে নিজের অনগ্রসর সম্প্রদায়কে টেনে তুলতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত প্রতিভাদেরকে শিক্ষা আলোয় আলোকিত করতে হবে নিজেদেরকেই। তাহলে সমাজ ও দেশ এগিয়ে যাবে সামনে আরও সামনে। ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মুসলিম বলে কিছু হবে না, এমন ধারণা পোষণ করা পাপ। ইসলাম সৎপথে সঠিক লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগায় তাই পারতেই হবে। করোনা থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত বিধিনিষেধই মানতে হবে আমাদের আরও বেশি বেশি করে।
লেখক: সম্পাদক এবং প্রকাশক উদার আকাশ।