মুর্শিদাবাদে মহরমের মাতম
লোকমান হোসেন পলা
ইমামবাড়া শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্ব অপরিসীম । তাদের অধিকাংশ ধর্মীয় কার্যকলাপ ছিল ইমামবাড়া কেন্দ্রিক।মুর্শিদাবাদের নবাবরা ছিলেন শিয়া মুসলিম । ফলে মুর্শিদাবাদেও নবাবদের পৃষ্টপোষকতায় বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি ইমামবাড়া গড়ে উঠেছিল নবাবী আমলে। মহরমের সময় ইমামবাড়া প্রাণ ফিরে পেত।এই সময় মহরমে অংশগ্রহণ করতে দেশ বিদেশের মানুষরা মুর্শিদাবাদ পাড়ি দিত,এবং সকলে এসে উঠত ইমামবাড়াতেই। মহরমে আগত এই সমস্ত অতিথিদের জন্য ইমামবাড়াতেই খোলা হত লঙ্গরখানা। সেখান থেকে বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করা হত।এছাড়াও মুর্শিদাবাদের বেরা, নাওরোজ, সহ শিয়া মুসলিমদের বহু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালিত হত সারা বছর ধরে।
বর্তমান ইমামবাড়া তৈরির পূর্বে নবাব সিরাজ নির্মিত একটি কাঠের ইমামবাড়া ছিল। হাজারদুয়ারীর সামনেই।যাইহোক,বাংলার মসনদে তখন নবাব ফেরাদুন জা ।সব কিছু বেশ ভালোই চলছিলো । কিন্তু হঠাৎ করেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। ১৮৪২ সালের কোন একদিন নবাব পরিবারের একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সন্ধ্যা বেলায় আয়োজিত আতসবাজির আগুনে নবাব সিরাজ নির্মিত ইমামবাড়াটির একটি অংশ পুড়ে গিয়ে ভেঙে পড়ল।এই ঘটনার ঠিক ৪বছর পর ১৮৪৬ সালের ২৩শে ডিসেম্বর মধ্যরাতে ইউরোপীয়ানদের পার্টি চলছিল ইমামবাড়ার পাশে।পার্টি চলাকালীন সেখান থেকে অসাবধানতা বশত আগুন এসে ইমামবাড়ার বাকি অংশে ধরে গেলে এবার সম্পূর্ণ ইমামবাড়াটি পুড়ে ধ্বংশ হয়ে গেল।সেই সাথেই নষ্ট হয়ে গেল ইমামবাড়াতে থাকা সমস্ত দলিল দস্তাবেজ সহ বহু মূল্যবান কাগজপত্র।
ইমামবাড়া ধ্বংশ হয়ে যাওয়ায় ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠান সম্পাদনে সমস্যা দেখা দিলে নবাব ফেরাদুন জাঁ ১৮৪৮সালে নতুন ইমামবাড়া নির্মাণের সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। এবং ইমামবাড়া নিমার্ণের পুরো দায়িত্ব দেওয়া হয় দেওয়ান নিজামত সৈয়দ সাদিক আলি খানকে।অবশেষে মাত্র ছয় সাত মাসের মধ্যে সাদিক আলি খান প্রায় ছয় লক্ষ টাকায় সম্পূর্ণ করেন ৬৮০ ফুট দৈর্ঘের বর্তমানের এই সূরম্য ইমামবাড়াটি।নবাব ফেরাদুন জাঁ এই নির্মাণকার্যে এতটাই খুশি হন যে নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত ছোট বড় প্রত্যেক মিস্ত্রিকে উপহার হিসেবে একটি করে বহুমূল্য শাল প্রদান করেন । ইমামবাড়ার মধ্যবর্তী অংশটিতেই মহরমের সমস্ত অনুষ্ঠান পালিত হত । ইমামবাড়ার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি মদিনা ।ইমামবাড়ার পূর্বদিকে রয়েছে নহবতখানা যেখানে মহরমের সময় কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে করুণ সুর বাজনার সাথে গাওয়া হত মার্শিয়া বা শোকগীত ।ইমামবাড়ার পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে মার্বেল বসানো বড় বড় হলঘর রয়েছে ।এখনে নানান ধর্মীয় মজলিশ বসত। এছাড়াও ইমামবাড়ার ভেতরে রয়েছে একটি বড় লঙ্গরখানাসহ একটি অতিথি নিবাস।
মুর্শিদাবাদের ইমামবাড়ায় নবাবী আমলের সেই জৌলুষ হয়ত আজ আর নেই । কিন্তু তবুও ইমামবাড়ার সৌন্দর্য আজও সবাইকে মুগ্ধ করে । এখনও প্রতিবছর মহরমের দশ দিন আগে থেকেই ইমামবাড়া সেজে উঠে । দেশ বিদেশের বহু মানুষের সমাগমে ইমামবাড়া ফিরে পায় পূর্বের সেই নবাবী আমেজ ।
ইমাম হোসেন মানবিক মূলবোধের জন্য কারবালা প্রান্তরে সপরিবারের শহীদ হয়েছিলেন৷ সেই স্মৃতির টানে বিশ্বের প্রতিটি জায়গার মত মুর্শিদাবাদেও পালিত হয় মহরম৷ বিশেষ করে হয় মহরমের রাতে যাকে ‘কাতল কি রাত’ বলা হয়৷ সেই রাতেই মুর্শিদাবাদের কোঠি ইমামবাড়ায় পালিত হয় ‘আগুনে মাতম’৷ এই মাতম দেখার জন্য মুর্শিদাবাদ-সহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার মানুষরা ভিড় করে৷ এদিন জলল্ত আগুনের উপর দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষরা হাঁটেন৷ গভীর রাতে এই আগুনে মাতম দেখার জন্য উপচে পড়ে ভিড়৷ কয়েকশো বছরের রীতি মেনে এই আগুনে মাতম অনুষ্ঠানটি করা হয়৷ এটি হয়ে যাওয়ার পর সারা রাত ধরে চলে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান৷ এরপরেই সকালবেলায় হাজারদুয়ারী বড় ইমামবাড়া থেকে পবিত্র ঘোড়া দুলদুল সহযোগে শোভাযাত্রা বের হয়৷ শুরু হয় জনজির দিতে মাতম৷ শরীরের বিভিন্ন অংশ ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে ক্ষত বিক্ষত করা হয়৷ হাজারদুয়ারি বড় ইমামবাড়া থেকে মাতম বেড়িয়ে গোটা লালবাগ শহর পরিক্রমা করে কারবালা পর্যন্ত যায়৷ এই ভাবেই শেষ হয় মুর্শিদাবাদের মহরম।