গোলাম রাশিদ:দেশভাগের সময় মানুষ ‘দেশহীন’ হয়েছিল। ছিন্নমূল মানুষের হাহাকারের সাক্ষী ছিল ইতিহাস। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি-আতঙ্ক সেই ঘটনার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। তবে দেশভাগ কেন হয়েছিল? চারিদিকে এ কোন অন্ধকারের আতঙ্ক? স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ ছুঁয়ে দেখলেন গোলাম রাশিদ
নিজেদের চিরপরিচিত বাস্তুভিটে ছেড়ে চলে যাচ্ছে সবাই। সোনা ঠাকুর অনেক কষ্টে ঘেমে-নেয়ে অর্জুন গাছের ছালবাকল কেটে লিখল, ‘জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্তানে চলিয়া গিয়াছি, ইতি সোনা।’ পাগলা জ্যাঠামশাই মণীন্দ্রনাথ, যিনি ‘গ্যাৎচোরেৎশালা’ বলতেন রেগে গেলে, তিনি নিরুদ্দেশ, চলে গেছেন একটি ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ (অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়)। তাঁকে ছাড়াই সোনাদের চলে যেতে হচ্ছে ‘হিন্দুস্তানে’। সেটাই এখন তাদের দেশ। বুক ভেঙে যায়। দেশভাগ হয়। তৈরি হয় কাঁটাতারের ক্ষত।
এখান থেকে আমরা চলে যেতে পারি সেলুলয়েডের আঙিনায়। ছিন্নমূল মানুষ ধূ ধূ চর পেরিয়ে ‘নিজের দ্যাশ’-এর জন্য হাঁটছে। তাদের মুখে ভাষা নেই। আসলে ‘তাদের কোনও দ্যাশ নাই’। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা এসেছিল ২০০ বছরের সাম্রাজ্যবাদী শাসন অবসানের পর। সেই মুক্তি ‘দেশ’-এর সংজ্ঞা বদলিয়ে দিয়েছিল। যেখানে তুমি বড় হয়ে উঠেছ– পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটেছ, চিনে নিতে পার মাটির ঘ্রাণ, যেখানে তুমি অন্ধের মতো চোখ বুজেও চলাফেরা করতে পার, সেটা তোমার দেশ নয়। তাই সবাই যখন ‘হিন্দুদের দেশ’ ছেড়ে, মানে বর্ধমান ছেড়ে মুসলমানের দেশে চলে যায়, তখন গাঁয়ের মেয়েটি বুঝতে পারে না ব্যাপারখানা। যারা পাশাপশি বাস করে এসেছে এতদিন, তাদের মধ্যে হিন্দুরাই নাকি শুধু এই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক। মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ। তাই হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’র মা বলে ওঠে, ‘আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলাদা একটা দ্যাশ হয়েছে–…আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটা আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটা আমার লয়।’ এই কথাটা বোধহয় রাজনীতিবিদ আবুল হাশিমও বুঝতে পারছিলেন না। তাই বর্ধমান ছেড়ে না যেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমাতে হয়। অথচ তিনি দেশভাগ চাননি। যুক্তবঙ্গ চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশকে ভালোবাসাটাই ‘নাগরিকত্বের’ মাপকাঠি নয়, বুঝিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্র।
এবার দেশভাগের পরিণাম, দাঙ্গা, ধর্ষণ, হ*দয়বিদারক ট্রেনযাত্রার ‘খুশবন্তি’ ও ‘সাদাত হাসান মান্টোনীয়’ বিবরণ থেকে চলে আসুন মুর্শিদাবাদের ডোমকলের শিবনগরে মিলন মণ্ডলের বাড়ি, কিংবা ময়নাগুড়ির শ্যাম রায়, অন্নদা রায়ের আঙিনায়। নাম বলইে ধর্ম চলে আসে। অতএব বালুরঘাট থেকে বসিরহাট তাকিয়ে দেখুন, আতঙ্ক কীভাবে ট্রমা তৈরি করেছে মানুষের মধ্যে, কি হিন্দু, কি মুসলিম। মৃত্যুর আতঙ্ক বোধহয় এতটা গ্রাস করে না মানুষকে, যতটা গিলে নিয়েছে ভোটার তালিকায় ভুল নাম থাকার সন্দেহ কিংবা ডিজিটাল রেশন কার্ডের উদ্বিগ্নতায়। যারা কয়েকদিন আগেও ধর্ম-বিদ্বেষ ছড়াত, তারা এখন সব ভুলে নাম সংশোধনের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছে, যেমনটা দেখা গিয়েছিল নোটবন্দির সময়, যেমনটা দেখা গিয়েছিল একাত্তরের শরণার্থীদের খাবার দেবার সময়, যেমনটা দেখা গিয়েছিল ওপার বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের হাহাকার মিছিলের সময়। স্থান-কাল-পাত্র বদলিয়ে দিলে বোধহয় একে ঘটনার বিনির্মাণ ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। তাহলে এখন কী হবে? এই কিছুদিন আগেও একশ্রেণির মানুষ রোহিঙ্গাদের নিয়ে তিতিবিরক্ত হত। আজ যদি সারা দেশে এনআরসি হয়, তাহলে ভারত কি আরেকটি মায়ানমার বা সিরিয়া হয়ে উঠবে না? বঙ্গোপসাগরের তীরে কোনও নিশ্চল আয়লান কুর্দি পড়ে থাকবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
স্পষ্ট অনুমান করা যায়, এনআরসি সংঘ পরিবারের একটি বড়সড় খেলা। যে খেলার মূল উদ্দেশ্য হল, নাগরিক হিসেবে মুসলিমদের সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। তবে এর কাউন্টার ন্যারেটিভও রয়েছে। অসমে মুসলিম তাড়াতে গিয়ে বেশিরভাগ হিন্দু বাদ চলে গেল চূড়ান্ত তালিকা থেকে। আত্মহত্যা করলেন বেশকিছু মানুষ, দুই ধর্মেরই।
এজন্যই এনআরসি এখন আর কোনও সরকারি খাতা নয়– যেখানে নাগরিকদের নাম লিপিবদ্ধ থাকবে। এই তিন বর্ণের ইংরেজি অ্যাব্রিভিয়েশনটি এখন আতঙ্কের অপর নাম। এনআরসি ইটভাটার শ্রমিককে আত্মহত্যাতে উসকানি দেয়। উত্তরবঙ্গের হিন্দু পরিবারের সদস্যকে আতঙ্কিত করে– ভাবিয়ে তোলে– আমার জমির পুরনো দলিল-পরচা খুঁজে পাচ্ছি না– আমি কি এনআরসিতে থাকব? দুশ্চিন্তা একসময় তাঁকে নিয়ে যায় মৃতু্যর দিকে। এই মৃতু্যদূতের নাম এনআরসি। যার জমি নেই– কিংবা যে পাগল কোন গাঁয়ের তা কেউ জানে না– তার নাগরিকত্ব কীভাবে ঠিক করবে এই এনআরসি? অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে হারিয়ে যাওয়া পাগল ঠাকুরের দেশ কোনটি? দেশভাগ করেই যদি দেশ ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল– তবে আবার এই অপদস্থতা, এই চরম হয়রানি কেন?
ভূত বা জ্বিন দেখা নিয়ে গ্রাম-গঞ্জে অনেক গল্পের চল থাকে। কারও মামাতো বোনের শাশুড়ি দেখেছে। কিংবা বন্ধুর ভাইপোর খালা অন্ধকারে তেনাদের দেখেছিলেন। এনআরসি বিষয়টি ছিল অনেকটাই এমনই। এটি ভারতবর্ষের অসমে (আমাদের কাছে ‘সৎ রাজ্য’, অপর) হতে পারে, কিন্তু সেই বিপদ নিশ্চয়ই আমাদের দরজায় ধাক্কা দেবে না। সেখানে বাঙালি আছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা-চরিত্র করব, প্রতিবাদ করে দায়িত্ব সারব। সবই যেন শোনা, উড়ো। অতএব, ভয় নেই। এটা একটি রাজনৈতিক দল অসমের এনআরসির আগে মানুষকে বুঝিয়েছিলও। প্রচার ও প্রপাগান্ডার মাধ্যমে বার বার বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, অসমে যাঁরা নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়বেন, তাঁরা বিশেষ একটি ধর্মের মানুষ। আপনারা নিশ্চিন্তে তামাক সেবন করুন। এই বরাভয় অনেকটা মরুভূমিতে উটপাখির মাথা গুঁজে পড়ে থাকবার মতো যে, আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিংবা ‘ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে’র মতো ব্যাপার। মাথায় কিঞ্চিৎ সার-পদার্থ থাকলে মানুষ তখন বিভ্রান্ত হতেন না। তবে হয়েছেন, এবং পরিণামে শেষ পর্যন্ত ‘অনাগরিক’ হয়ে গিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয়, যাদের বেশি সংখ্যায় বাদ যাওয়ার কথা ছিল তারা মাত্র ৩০ শতাংশ বাদ গেছে। যাদেরকে আশ্বস্ত করে মাথায় হাত বুলিয়ে ভোট নেওয়া হয়েছিল, তারা বাদ গিয়েছে বেশিরভাগ। তাহলে ফলাফলটা কী দাঁড়াল? ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন!
এই বাংলায় এনআরসি প্রক্রিয়া আরম্ভ হবে এমন কোনও বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়নি। তবে রাজ্যের একশ্রেণির রাজনীতিবিদ তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে বার বার এনআরসি নিয়ে হুমকি দিচ্ছেন। রাজ্য থেকে দু-কোটি মানুষকে এনআরসি করে তাড়াব, এমন হুমকিও শোনা গেছে। স্বভাবতই এর ফলে বাংলাজুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যের খেটে-খাওয়া মানুষ, দরিদ্র মানুষ, নিরক্ষর মানুষ এই ধরনের হুঁশিয়ারিতে ভয় পেয়েছে। রাজ্যে এনআরসি করতে হলে রাজ্যের অনুমতি নিতে হবে, আদালতের নির্দেশ লাগবে। অথচ, নিছক গুজবের কারণে আজ বাংলার মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছে। আর এই গুজব ছড়াতে যেমন একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতারা সাহায্য করছেন তাঁদের আলটপকা মন্তব্যের মাধ্যমে, তেমনই সোশ্যাল মিডিয়ায় একশ্রেণির অসচেতন, দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ পোস্ট শেয়ার করে আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন। এর ফল ভোগ করছে গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষই।
বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এটা নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা মাইকিং করে জনগণের কাছে আসল তথ্যটি প্রচার করছে। সরকারি ক্ষেত্রেও কিছু জায়গায় প্রচার লক্ষ করা গেছে। তবে এটুকু যথেষ্ট নয়। পাড়ায় পাড়ায়, দরকার হলে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মানুষকে বোঝাতে হবে সবকিছু। কিন্তু, তার বদলে রাজনৈতিক নেতারা ঘৃণ্য মনোভাব ছড়াচ্ছেন। দেশভাগের সময়ে শ্যামাপ্রসাদ, জিন্নাহ, প্যাটেলরা যেমন ‘যেনতেন-প্রকারেণ’ ক্ষমতা দখলকেই মনজিল বানিয়েছিলেন, তেমনি এই পরিস্থিতিতেও কুরসি বাঁচাতেই ব্যস্ত রাজনৈতিক নেতারা। তাঁদের এক-একটি বাক্য যে কীভাবে সাধারণ নাগরিকদের মনে আতঙ্কের চোরাস্রোত বইয়ে দিচ্ছে, তার খোঁজ তাঁরা রাখছেন না। তাহলে দেশভাগের কী সুফল মিলল?
এনআরসি তো সেই দৃশ্যের কথাই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে। যে দেশভাগ আমাদের জন্মের আগেই হয়ে গেছে, সেই লাইন যেন আরেকবার দেখতে হবে। যে লাইন একসময় এপার ও ওপারের সীমান্তজুড়ে ছিল, যে লাইন ছিল দণ্ডকারণ্যের দিকে– আন্দামানের দিকে। আর এই নয়া ‘দেশহারা’দের লাইন তো অন্ধকারের দিকে। যে দেশে নেতা-মন্ত্রীরা ডিগ্রির সার্টিফিকেট দেখাতে পারেন না, সে দেশের মানুষ কী করে পূর্বপুরুষের দলিল খুঁজে বের করবে? সেই অর্জুন গাছটি যেমন জানত পদ্মার ওপারে সোনা ঠাকুররা থাকত, থাকত তার প্রিয় ফতিমা, যে হয়তো এখনও অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। তেমনি এপারের এই পুকুরঘাট, তুলসিমঞ্চ কিংবা দালানের ধসে-পড়া দেওয়াল ও খড়খড়ির জানালা জানে এখানকার কোনও হিন্দু বা মুসলিম প্রকৃত নাগরিক কিনা। কিন্তু রাষ্ট্র কি এদেরকে সাক্ষী হিসেবে মেনে নেবে? যে সিস্টেমে ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপারের কাছে তাঁর বিদ্যায়তনিক মূল্যায়নের জন্য সিভি চেয়ে পাঠানো হয়, সে শাসনযন্ত্র অবশ্যই এটা মেনে নেবে না। তাই এই অনাগরিকত্ব ও অবিশ্বাসের দেশজুড়ে শুধুই অন্ধকার। ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ।’ আলো আসতে আর কতক্ষণ— তা জানতে সেই অন্ধকারের উদ্দেশে প্রশ্ন করা যেতে পারে– রা’ত কত হইল? উত্তর অবশ্য মেলে না!
Collected By Faruque Ahamed