এক অন্য সাধুর গল্প
ড: রঘুপতি সরেঙ্গি
এ গল্প লেখা নয়, নিজের অভিজ্ঞাতার থেকে দেখা ও শোনা এক ঘটনা । কিছুকাল আগের বিষয়, তবু ঘটনার পাত্র পাত্রীদের নাম পরিবর্তন করা হলো।
সাত সাতটি ছেলে-ছেলে বৌ, নাতি-নাতনি আর স্ত্রী নিয়ে ভরা সংসার। ভাটিবাড়ি’র গঙ্গাধর দেব-বর্মন, রাজ্য সরকারী চাকুরে । শোনা যায়, প্রথম সন্তান তাঁর নাকি মেয়ে হয়েছিল, বাঁচেনি। তারপর একে একে চার ছেলে হওয়ায় একটি মেয়ের টানেই নাকি তাঁর দ্বিতীয় সংসার।
দ্বিতীয়ার ও প্রথম তিন ছেলে। চতুর্থবারে মেয়ের জন্ম দিতে গিয়েই মা ও শিশুর মৃত্যু। ঈশ্বর তো মানুষের সব স্বাদ পূরণ করেন না…. এক্ষেত্রেও হয়তো বা তেমনটাই হোয়েছে।
সে যাই হোক, সফল অভিভাবক গঙ্গাধর বাবুর সব ছেলেই এখন প্রতিষ্ঠিত। সরকারি কর্মসূত্রে গ্রামের বাইরে হোলেও ভাটিবাড়ির সোঁদা-মাটির গন্ধ তাদের শরীরে লেগেই আছে। শনিবার একটা এলেই হোল।
যে কোনো দু-একজন তো বউ-বাচ্চা সহ আসবেই আসবে। ভরা বর্ষাতে কোঁচা দিয়ে মাছ মারা, জল কমলে বঁড়সি পাতা, বেগুন-লঙ্কা লাগানো, কুমড়োর জালি ঠিক করা, ঘরের বেড়া সোজা করা, নারিকেল -গাছ সাফ করা…. আরও কত কাজ, বাপ-ছেলে মিলে। সোমবার সকাল ৮টার পর থেকে শনিবার সকাল ৯ টা পর্যন্ত খাতায়-কলমে বুড়ো-বুড়ির সংসার হোলেও আনাগোনার শেষ নেই। পাড়ার কারো তিনি ঠাকুর্দা তো কারুর আবার জ্যাঠা। আশি বছর বয়সেও যেমন সচল, তেমনি সক্রিয়। পাড়াতে কারুর ঘরে মনসা পুজো হোক আর সরস্বতী’র প্রতিমা কিনতে যেতে হোক ‘ঠাকুর্দা’ সব খানেতেই।
ঠাকুর্দা ই যে পাড়ার “গৌরী সেন”, কি না ! আমুদে মানুষ শুধু নয়, দিল টাও যে খুব বড়ো তাঁর।
একবার পূর্ণিমার ওনার চোখে পড়লো, পাড়ার আট-দশ বছর বয়সি বন্ধুরা সব সন্ধ্যাবেলায় পিতলের থালা-বাটি বাজিয়ে, হরিবাসরে বসে…….
“হরে রাম, হরে কৃষ্ণ” করে নাচানাচি করছে।
আর যায় কোথা ! পরের দিন বিকেল গড়াতেই ডাক পড়লো। মুহূর্তেই হাজির ছয় শাগরেদ। টোটো করে সোজা বাজারে গিয়ে কেনা হোলো ছয় জোড়া মন্দিরা, সাথে জুটলো একটি করে ‘আমির্তি’।
পরের দিন থেকে, সন্ধ্যা হওয়া মাত্রই প্রতিদিন গ্রামে বসলো পূর্ণিমার আসর । নব্য ভক্তদের উদোম হরিনাম এর সাথে ছয়-জোড়া মন্দিরার আওয়াজে বাড়ির বড়রাও একে একে পাড়ি জমাতে শুরু করলেন সেখানে। দিনে দিনে এ জিনিস চোখে পড়ায়, গঙ্গাধর বাবুর দায়িত্ব বাড়লো। একদিন সকালে নিজেই গিয়ে ঐ দোকান থেকে দুটি ঢোলোক ও এনে দিলেন। মাস্টার ছাড়া বাজানো যায় না বলে, হারমোনিয়াম টাই কেনা বাকি রয়ে গেল !
নিজে কখনো কপালে তিলক দিতেন না, গলায় তাঁর মালা ও ঝুলতে দেখে নি কেউ। সবাইকে সাথে নিয়ে সবই চলছে আনন্দে। হঠাৎই একদিন বড়-ছেলে কে ডেকে, দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে, দেখাতে বসলেন তাঁর চার টি পাশবুকে জমানো অংকের হিসাব এবং কোন কাজে কত তার ব্যায় হবে। কেউ কিছু ঠিক্ বুঝে ওঠার আগে এসব দেখে ছেলের চোখ দু’টো অঝোরে ঝরতে লাগলো।
রাত টুকু মা-বাবার সাথে কাটিয়ে সকালে, ছেলে গেল মোটর-বাইকে তার কাজের জায়গায়। মনটা কেমন যেন আজ…. ঠিক বলে বুঝানোর মতো নয়।
ঠিক পরের দিন সকালে আবারও লোক হাজির বড়-ছেলের বাসায়। এবার আর বাবা ডাকেন নি, ডেকেছেন তাদের মা। হন্তদন্ত হয়ে সব ভাইদের ফোনাফুনি করে পাড়াতে ঢুকার অনেক আগেই কানে আসছে, মন্দিরা-ঢোলোক এর সাথে কচিকাঁচা-স্বরে ….” বলহরি……..…….হরি বোল, বলহরি,হরি বোল”।
সামনের উঠোনে তখন গাঁদা-টগর আর বেলা ফুলে ঢাঁকা পিতৃদেবের মুখটুকু ও দেখতে পাওয়া ভার। অসংখ্য গ্রামবাসীর মাঝে কেঁদে আছাড়-কাছাড় খাচ্ছে তার ছ’ছটি মেয়ে…. পিতৃমাতৃ-হীন যে ছ’জনকে তিনি গোপনে নিজেই পিতা হয়ে সাজ-পোশাক ও দান- সামগ্রী সহ বিয়ে দিয়েছিলেন। পাশেই, ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাথা নীচু করে মাটিতেই বসে ফুঁপিয়ে চলেছে তাঁর ১৪ জন নাতি- নাতনি সহ ছ’জন জামাই ।
Dr. Raghupati Sharangi, a renowned homeopath and humanitarian who lives for the people’s cause. He is also a member of the Editor panel of IBG NEWS. His multi-sector study and knowledge have shown lights on many fronts.