অমরকণ্টক ভূতেদের ভৌতিক সংকট
সুমন মুন্সী, কলকাতা
ভূতেদের সাথে আমার সেই ছেলেবেলা থেকে একটা মধুর সম্পর্ক । সাধারণত বাচ্ছাকে ভূতের গল্প বলে ভয় দেখানো হতো, আর আমি বায়না করতাম, “ভূতের গল্প বলো তো দিদা “। শুনে বুড়ী হেসে বলতো তুই অবাক করলি দাদুভাই, সবাই যাতে ভয় পায়, তুই সেটা নিয়ে খেলিস। আর সবাই যা সাহসের সাথে করে তুই ভয় পাস্ ।
আসলেই তাই,, দেশের বাড়ি গেলে, মানে বাদকুল্লা, কৃষ্ণনগরের আগের স্টেশন; রোজ গ্রামের শ্মশান গিয়ে বসে থাকতাম, কোনো ভয় ছিল না।
তা সেই আমি একবার বেশ বেকায়দায় পরেছিলাম। ভূতের নানাবিধ রূপ, আচার ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে রীতিমত গবেষণা করতাম। মামদো , বেম্মোদত্ত্বি, শঙ্খচুন্নি, পেত্নী, স্কন্দকাটা, একানোড়ে আরো কত বিভিন্ন ভূত।
আসুন সেই গল্প একবার শোনা যাক ভূতচতুর্দশীর রাত আর কি কি হয় চৌদ্দ দফায় ভেবে দেখেছেন কি এভাবে কখনও?\ এই চৌদ্দের বেড়াজাল কত গভীর আচ্ছা…আমাদের জীবনে বা সংস্কৃতিতে বারবার চোদ্দ সংখ্যাটিকেই কেন মাইলস্টোন বা মাপকাঠি হিসেবে ধার্য করা হয়েছে? কিছু বিশেষ চৌদ্দ দফার বিবরণ দিলাম এখানে, নীলাদ্রি নামের এক বন্ধু হোয়াটস্যাপ করে বলেছিলো:
১. রামচন্দ্রের বিনা দোষে চোদ্দ বছর বনবাস।
২. অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চোদ্দ বছর তাও প্রকারভেদে সশ্রম হতে পারে।
৩. চোদ্দ জন পিতৃপুরুষ কে তর্পণ ও পিন্ড দান ।
৪. ভূত চতুর্দশীর চোদ্দ প্রদীপ ও চোদ্দ শাক ভক্ষণ । ভেষজ গুন সম্পন্ন ধন্নন্তরী পদ্ধতি ।
৬. কুকুর বিড়াল কামড়ালে চোদ্দ দিন তাকে পর্যবেক্ষণ আর আগে ছিল জলাতঙ্কের জন্য আন্টিরেবিস চোদ্দ টি ইনজেকশন।
৮. চতুর্দশীর চাঁদের সঙ্গে তুলনীয় রমনীর সৌন্দর্যএবং রূপের ফাঁদে পড়লে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তি একথা রসিক জন বলে থাকেন ।
৯. ঝগড়ার সময় বিপক্ষের চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার।
১০. আর এখন করোনার সৌজন্যে জীবনটাই চোদ্দ তে সীমিত হয়ে গেছে…. চোদ্দ দিন কোয়ারেন্টাইন!
ঘটনাটা ঘটেছিলো ছত্তিশগড় মধ্যপ্রদেশ সীমান্ত এলাকায়। অনেক প্ল্যান হলো ৮-১০ বন্ধুর দল যাবে , কিন্তু কোজাগরী পূর্ণিমা শেষে দেখা গেলো ৪ জনের ছুটি নেই, বাকি চারজন কোজাগরী আসতে আসতে পকেটের রসদ ফুরিয়ে গেলো,যেতে পারবে না। আমি মানে বাঘা বোস আর সঞ্জয় গাইন যাবোই এবং যথারীতি উঠে বসলাম ১২ তারিখ আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেস এ চেপে হাওড়া থেকে বিলাসপুর ।
বিলাসপুরে ব্র্যাকফাস্ট করে, আবার লোকাল ধরে গিয়ে নামলাম, পেন্ড্রা রোড। অমরকণ্টক যেতে হলে জীপ্ ধরতে হবে এখন থেকে ।৭০ টাকা পার হেড ১২জন বসবে। আজ যেকোনো কারণেই লোক কম জীপ্ মানে, বোলেরো যখন ছাড়লো তখন ৩:৪৫ বিকেল । যেতে ১ ঘন্টা লাগবে মানে পাহাড়ী জায়গায় সন্ধ্যে নেমে যাবে ।
পথে যেতে যেতে সঞ্জয় দা বললো “বোস একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস, তোর নাম বাঘা আর আমার পদবি গাইন, মানে সেই গুপী বাঘা কেস। তার ওপর ভূতচতুর্দশী”। বলেই গাড়ী কাঁপিয়ে হেসে উঠেছিল। ড্রাইভার ঘাবড়ে গিয়ে সাডেন ব্রেক চেপে দিলো।
যদিও সঞ্জয়দা ঠাট্টা করে বললেন, আমার কিন্তু ভালো লাগছিলো না। প্রথম সঞ্জয়দার চটি ছিড়লো হাওড়া স্টেশনে, কপাল ভালো মুচি মেরামত করে দিল। তারপর আমার ল্যামির জার্মান পেন গেলো হারিয়ে । পেন হারালে বাঘা খুব ভয় পায়, কোনো না কোনো ভাবে মৃত্যু খবর আসবে ।
ভালোয় ভালোয় আশ্রমে পৌঁছালে বাঁচি ।
যাই হোক চৌদ্দ রকম গেরো কাটিয়ে হাজির হলাম পরকী , অনুপপুর রাজেন্দ্রাগ্রাম হয়ে অমরকণ্টক যেতে পেন্ড্রা রোড থেকে যে রাস্তা অনুপপুর অমরকণ্টক রোডে এসে মিশছে, সেই মোড় তার নাম পরকী। একবার গাড়ি বন্ধ আর একবার টাইয়ার পাংচার পেরিয়ে, যখন পরকী নামলাম, তখন ৫:৪৫ সন্ধ্যে । এর মধ্যে অন্ধকার ঘুটঘুট্টি। শুধু লাখানের চায়ের দোকান টিমটিম করে চলছে ।
সালটা ২০০১ তারিখ ১৪ই নভেম্বর বুধবার ভূতচতুর্দশীর রাত। লাখান দেখে হেসে বললো, “বাঘা বাবু আপলোগ ইতনা রাত কো?টিরেন লেট্ থা কেয়া?” ।
“লাখান দুটো চায়ে, ব্রেড ওমলেট ওর দো কারকে সামোসে দেনা দো জাগে”, বললাম আমি । খুব খিদে পেয়েছিলো ।
“বাবু চায়ে ওর বিস্কিট হোগা আওয়ার কুচ নাহী “, বললো লাখান।
অনেকবার এই আশ্রমে এসে থেকেছি মোটামুটি এলাকার সবাই পত্রাকার বাবু বলেই চেনে । আখবার কে আদমী মিনিস্টার উনিসটার সব জানতে হায় বাবুকো ।
“লেকিন আপ রহগে কাঁহা?”, প্রশ্ন করলো লাখান ।
“কিউ আশ্রম পে”, আমি বললাম ।
উত্তরে আমি যা শুনলাম, পিলে গেলো চমকে । আশ্রমে খুন হয়েছে আর অনুপপুর থেকে বড়বাবু চারজন কে গেরেপ্তার করে নিয়ে গেছে। ডক্টর রায়, যিনি মেন্ ট্রাস্টি তিনি গেছেন সবার বেল করতে। ফিরতে রাত হবে। মেন্ গেট কে চাবি হায় রায় সাহেব ডেকে গায়ে, কোই আয়ে তো বাহার শিউ মন্দির পে বৈঠনে কো বলা।
মহা গেড়ো, বধ্য হয়ে চাবি নিয়ে দু বোতল জল আর চার প্যাকেট গ্লুকোজ বিস্কুট নিয়ে ২৫০-৩০০ মিটার হেঁটে টিলার ওপর যখন আশ্রমে পৌছালাম তখন সাতটা বাজে।
এতক্ষন সঞ্জয়দা কিছু বলেনি, কারণ লাখানের দোকানের পিছনে বাড়ী সেখানে বড় কাজ সারতে গেছিলো। বাইরে সাহস দেখালেও ভীতুর ডিম্ গাইন সাহেব । কন্সালটেন্সি করেন বিদেশের সাথে, এখানে বক্সাইট আর ডোলোমাইট প্রচুর সাথে শাল কাঠ। এই সবের একটা বারো অর্ডারের জন্য আমার সাথে ঝুলে পড়েছেন ।
আমি নিজেই তালা খুলে মন্দির চত্বরে গিয়ে জিনিস সহ বসলাম দেখে বললো “বাকিদের কি হলো”।
সংক্ষেপে ঘটনা বলার সময় শিয়াল ডেকে উঠলো, আশ্রমের একটা হরিণ আছে সেটা যেন কেঁদে উঠলো। আকাশের তারা গুলো হঠাৎ যেন তেজ হারিয়ে আরো টিমটিমে হয়ে গেলো ।
এমন সময় বিষাণ শিং যাকে সবাই ভীষণ শিং বলে আর তার বৌ আসছে, এমন অনুমান হলো। অন্ধকারে ভীষণের হাতের লাঠি আর কাঁধের কম্বল দেখে চিনলো বাঘা। না হলে এই অন্ধকারে নিজের হাত পা চেনা দায় ।
কাছে এসে ভীষণ নমস্কার করলো। পাশে থেকে বৌ একহাত ঘোমটার আড়াল থেকে মাথা ঝুকে পেন্নাম করলো। বউটা বোবা, কিন্তু খুব ভালো আর রান্না দারুন করে।
“কিরে রায় বাবু আসবে তো?”, জিজ্ঞাসা করলাম।
ভীষণ মাথা ঝুকিয়ে হ্যাঁ বলে বৌকে নিয়ে ওর ডেরার দিকে গেলো । আর হাতের ইশারায় বসতে বলে গেলো। ভীষণ খুব কম কথা বলে বরাবর ।
কিছুক্ষন বাদে মোটা মোটা হাত রুটি আর আলুর সবজি দিয়ে গেলো বৌটা। মাথা নেড়ে খেতে বললো ।
সঞ্জয়দা বললো, “ভাই রাক্ষুসে খিদে এখন যা পাবো তাই খাবো” । সঞ্জয়দা কে খেতে দেখে আমিও খেতে লাগলাম । খাওয়া শেষে ভীষণ শিং থালা নিয়ে গেলো ।
যাওয়ার আগে বলে গেলো, “বাবু মন্দির ছোড়কে কাহি নাহি জাইয়ে খাতড়া হায়, ঘরকা চাবি সব থানে পে হায়। কাল মিলেগা আজ মন্দির পে রুকিয়ে ” ।
লে হালুয়া ভূতচতুর্দশীর দিন শিবের মন্দিরের চাতালে রাত কাটানো মোটেই রোমান্টিক ব্যাপার নয় ।
ঘন্টা খানেক বাদে একজন কে আসতে দেখা গেলো, সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটছে । অনুমানে রায় বাবু মনে হচ্ছে। একটা পেঁচা আর শিয়াল ডেকে উঠলো। নাইটজার পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেলো।
“অরে বাঘা বাবু অত্যন্ত, সরি, হটাৎ অঘটন ঘটে সাৰ ভণ্ডুল “, বললেন রায় সাহেব ।
“যাক ধরে প্রাণ এলো, বাঁচালেন”, বললাম আমি ।
“আপনাদের জন্যই তো এলাম না হলে লাখানের বৌ ওদের ওখানে খাইয়ে থেকে যেতে বললো ।
রায় বাবু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে। অনেক উপকার করেন বলে গ্রামের সবাই ভালোবাসে ওনাকে ।
“চলুন আমার ঘরটা লক করেনি, ওখানেই রাত কাটানো যাক”, বললেন রায় সাহেব কিন্তু গলাটা ধরা ধরা ভাব।
বাঘা ভাবলো, সারাদিনের ধকলে এমন শোনাচ্ছে ।
গাইন বললো, “ভাই মাটিতে হলেও একটু শুতে হবে আর পারছিনা” ।
রায় বললেন কোনো চিন্তা নেই আমার ডাবল বেড আর একটা আয়েশী চেয়ার, মানে যাকে তোমরা ইজি চেয়ার বোলো । তোমরা খাটে শোবে, আমি চেয়ার এ শোবো ।
বাগান পেরিয়ে মূল আশ্রমের পিছনে একটু জংলা জায়গায় ঘরটা । তালা খুলে ভিতরে ঢুকলাম, লোডশেডিং তাই আলোও নেই ।
কোনো রকমে জিনিস রেখে বসলাম ।
অন্ধকারে রায় বললেন, “আপনারা বসুন দেখি কিছু খাবার পাওয়া যায় কিনা”।
আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে বলাতে , বললেন “তাহলে শুয়ে পড়ুন মেন্ গেটের চাবি দিন তালা দিয়ে আসি। নাহলে সকালে গরু বাগান সাফ করে দেবে “।
“চাবি মন্দির চাতালেই তালাসহ ফেলে এসেছি “, লজ্জার স্বরে বললাম ।
সঞ্জয়দা ভূতে ভয় পায়। শুনে হেসে বললেন,”ভূতেদের অবস্থা আরো খারাপ, গাছ কমে গিয়ে রেশন করে ডালে ঝুলতে পায় আর মানুষ ভূত নিয়ে কমেডি বই করে তাদের হাসির পাত্র করে ফেলেছে। ভূতচতুর্দশী কেউ ১৪শাক খেলো না, ভাবা যায়। দেখা আর, না দেখার মাঝে অনেক কিছুই কল্পনা “|
“সঞ্জয় বাবু শুয়ে পড়ুন দরজা ভেজিয়ে যাচ্ছি কেউ আসবে না”, বললেন রায় ।
এই বলে রায় হাঁটা দিলেন ।
কিন্তু সঞ্জয়দা বললেন, “খিল আটকে দিচ্ছি রায় বাবু আসলে খুলে দেব”। অগত্যা দরজা বন্ধ করে শুতে না শুতেই ঘুম ।
মাঝ রাতে দেখলাম রায় ইজি চেয়ারে শুয়ে, ভাবলাম গাইন দরজা খুলে দিয়েছে । একটু লজ্জাও হলো নিজেকে কুম্ভকর্ণ ভেবে ।
সকালে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কেউ চিৎকার করছে , “বাবুজি বাবুজি”
ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখি লাখান সাথে ইন্সপেক্টর দুই সিপাই ।
আমায় দেখে জয় সিয়ারাম বলে হাত জোর করলো ।
“কি ব্যাপার লাখান”, জিজ্ঞাসা করলাম ।
লাখান বললো কাল অনুপপুর ঘাঁটিতে বাইক আকসিডেন্টে রায় বাবু মারা গেছেন।
চমকে বললাম, “সে কি করে হয় রাত ১০ পর্যন্ত তিনি আমাদের কাছে ছিলেন “।
এরপর যা শুনলাম, সংক্ষেপে তা হলো, ভীষণ আর ওর বৌ খুন হয় ওর ভাইয়ের হাতে জমি বিবাদের জেরে। আর ভাই আর ভীষণের এক বন্ধু একে ওপর কে শেষ করে ফেলে চারদিন আগে । রায় সেই বিষয়েই থানায় গেছিলেন। ফেরার পথে ৭টা নাগাদ এক্সিডেন্ট হয়, পথেই লরি পিষে দিয়েছিলো ।
শুনেই সঞ্জয়দা অজ্ঞান ।
কিছু পরে যখন জ্ঞান এলো বললো “মাঝরাতে রায় এসে নামধরে ডাকলো, দরজা খুলে দিতে বললো শুয়ে পড়ুন আমি চেয়ারে আছি। তারপর আর কিছু মনে নেই ঘুমিয়ে গেছি ” ।
ইন্সপেক্টর তিওয়ারি বললেন, “সি ইওর সেলফ”।
বলে মন্দির চত্বরে নিয়ে যেতে দেখি দুটো মৃতদেহ আতঙ্কে চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, মুখ বিকৃত ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না চেহারা ।
আমিও বললাম “ভীষণ আর ওর বৌ রাত্রে খাবার দিলো তারা কি করে মরবে , রায় কে আমি মাঝ রাতে চেয়ারে দেখেছি।
“দেখুন এদের চেনেন?”, বলে ইন্সপেক্টর অবাক কেউ নেই।
থাকবে কি করে, ও দুটো যে সঞ্জয় আর আমার দেহ। বাবলা গাছের ডাল ভেঙে পরে মাথা থেঁতলে গেছে কাল রাত্রে। এই ভাবেই ডাল ভেঙে আজও রায় বাবু নতুন নতুন ভূত সংগ্রহ করে ভূতচতুর্দশীর রাত্রে। রায় কি বলেছিলো মনে নেই “ভূতচতুর্দশীতে কেউ ১৪শাক খেলো না, ভাবা যায়। দেখা আর না দেখার মাঝে অনেক কিছুই কল্পনা “।
সেই থেকে অমরকণ্টক অঞ্চলের মানুষ ভূতচতুর্দশীর রাত্রে ওই অঞ্চল এড়িয়ে যায় । আজও সঞ্জয় আর বাঘা নাকি একটাও গাছ পায়নি। তাই বাসস্থান খুঁজছে। রাত্রে একা গাড়ি গেলেই ওই মোড়ে দুজন নাকি লিফ্ট চায়। শুধু শুধু মানুষ ভয় পায় না। আজও অনেক লোক ভূতচতুর্দশী কে মানে আর রাত্রে ঘরের বাইরে যায় না।