স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জন্য দায়ী আমি-আপনি
অমিত গোস্বামী
সালটা ২০১৫। মোদি সরকারের একবছর হয়েছে মাত্র। র্যাগিং নিয়ে খড়্গহস্ত হয়েছে সরকার। অ্যান্টি-র্যাগিং নজরদারি কমিটির চেয়ারম্যান আর কে রাঘবনের নেতৃত্বে এক কমিটি রিপোর্ট পেশ করল। দেশের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ (৩৮০) দ্বিতীয় স্থানে৷ উত্তরপ্রদেশের (৫৬৫) পরই৷ তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে যথাক্রমে মধ্যপ্রদেশ (৩১৩) ও ওডিশা (২৮৯)৷ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান এই ঘটনা ঠেকাতে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে এই রাজ্যগুলির মুখ্যসচিবকে চিঠি দেন। তাতে পর্যাপ্ত সাড়া না পেয়ে খোদ মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানি কেন্দ্রের তরফে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি দেন। কিন্তু রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ। তেমন গুরুত্ব কেউ দেয় নি। তার ওপরে বর্ণশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় যাদবপুরকে কে ঘাঁটাবে? তখন তুমুল ‘হোক কলরব’ আন্দোলন চলছে। সরকার সাফাই গাইল এখানে প্রচুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তৈরি হয়েছে, তাই র্যাগিংয়ের অভিযোগ বাড়তে শুরু করেছে৷ এর কারণ র্যাগিং প্রতিরোধে নজরদারি কমে গিয়েছে৷ অথচ তারা এটা তারা বলল না যে সবচেয়ে বেশি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে কর্ণাটকে। সেখানে র্যাগিং কেন শূণ্য? এর কারণ একটা ছিল। তা হল সুপ্রিম কোর্টের একটা নিদান। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে, র্যাগিং বন্ধ না হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ কিন্তু নেবে কে? রাজ্য প্রশাসনকেই তো নিতে হবে।
আজ ২০২৩ এ মুখ ফেরানো যাক অন্যান্য রাজ্যে। ২০১৫ সালে র্যাগিংয়ে শীর্ষ স্থানাধিকারী উত্তর প্রদেশে আজ র্যাগিং শব্দটা উচ্চারণ করতে ছাত্ররা ভয় পায়। যোগী আদিত্যনাথের সরকার অভিযোগ পেলেই আগে হাজতে নিয়ে আড়ং ধোলাই দেয়। ন্যাকামির কোন জায়গা নেই। দক্ষিনের চার রাজ্যে র্যাগিং শব্দটা এখন লোকে ভুলে গেছে। ওড়িশা মধ্যপ্রদেশে কমেছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। রাজস্থানে কিছু অভিযোগ এলেও ভারতে এখন র্যাগিং প্রায় নেই বললেই চলে। র্যাগিংয়ের পীঠস্থান আইআইটি-গুলিতে তাদের অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি এতটাই কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে যে র্যাগিং উঠে গেছে সেখান থেকে। পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং ও কারিগরি কলেজও বিস্তর। সব জায়গায় র্যাগিং হয় না। হয় না তার কারণও রাজনীতি। ছাত্র সংগঠনগুলি এখানে ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম রাখার জন্যে র্যাগিং করতে দেয় না। এমনিতেই ভর্তির সময় বিনিময়ের খেলা চলে । তারপরে র্যাগিং করলে বিস্ফোরন ঘটবে। তাহলে র্যাগিং হয় কোথায়? প্রচারে কুলীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু এজন্যে দায়ী কে?
আমি-আপনি সবাই দায়ী। সুশাসন যে পশ্চিমবঙ্গে নেই তা সবাই জানি। কাজেই প্রশাসন উদ্যোগ নেবেন সেটা আশা করা বোকামি। কিন্তু জানা সত্ত্বেও সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা-ছাত্ররা-আমরা কেউ কখনও কিছু বলেছি? টিভিতে আজ কলতলার আসর বসছে। সোশাল মিডিয়া ফেটে পড়ছে। কবিতা বেরোচ্ছে আমাদের কলম থেকে প্রতিবাদের। সংবাদ মাধ্যম যত ধরনের সম্ভব বিশ্লেষন করছে। টেকো দাড়ি ও নপুংসক আঁতেলরা এখনও অপেক্ষায়। রাণী কি বলেন! তারপরে পোঁ ধরবেন। কিন্তু আপনাদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হচ্ছে যে আপনি কি করছিলেন? রাজা তোর কাপড় উচ্চারণ না করে সুদূর মণিপুর নিয়ে কেঁদে ভাসালেন। আইন করে কিছু হয় না। তার প্রয়োগ করতে জানতে হয়। বলতেই পারেন যে আমরা কোথায় বলব? একসময় পরিবর্তণের মিছিলে আপনি হেঁটেছিলেন। এখন আপনারা সর্বংসহা। পঞ্চায়েতে ৫৫ জন মানুষের মৃত্যুর পরেও লজ্জাহীনভাবে খিচুড়ি বিরোধী জোটের একাসনে ফিসফ্রাই খাওয়ার ছবি পুলকিত চিত্তে দেখেন। তারপরে বলেন, এবার মোদি ভয় পেয়েছে। দেখুন, দায়ী আমরাই। আমরা এনআরসি নিয়ে যত বলেছি, সিএএ নিয়ে যত কা-কা-ছি-ছি করেছি, মুসলমানদের উন্নয়ণের কথা না ভেবে তাদের ভয় দেখিয়েছি, তার এক শতাংশ প্রতিবাদ করেছি শাসনহীনতার বিপক্ষে। কিছু হলেই বলছি ‘সামাজিক অবক্ষয়’ আর খুব সামান্য সংখ্যক প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে দমননীতি প্রয়োগে বলেছি – দ্যাখ শালা, কেমন লাগে!
কাজেই স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জন্য, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৫৫ জনের মৃত্যুমিছিলের জন্যে, চাকরি চুরি ও অন্যান্য চুরির জন্য আপনি আমি দায়ী। আমরা নিজেরা প্রতিবাদ না করে বল ঠেলে দিয়েছি বুদ্ধিজীবিদের কোর্টে। তারা যে উচ্ছিষ্টভোগী আপনি জানতেন না? মুসলমানদের সংস্রব এড়িয়ে চলা আপনি অসাম্প্রদায়িকতার পোস্টারবয় হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে গালিগালাজ করেন নি? ‘সেটিং’ তত্ত্ব নিয়ে সোচ্চার হন নি? প্রতিবাদ করা মানে বিরোধিতা করা নয়। যে কোন শাসক যদি দেখেন তার প্রজারা নীরব গর্ধভ তাহলে সে স্বেচ্ছাচারী হবেই। তাই রাজ্য শাসকের সমালোচনা আজ করা দ্বিচারিতা। এখন রাজ্য সরকারকে তার কাজ করতে দিন। আগামীকাল যদি বিরোধীরা ক্ষমতায় আসে দেখবেন এই শাসকদের বড় অংশ তাদের ভিড়ে মাথা গলিয়েছে। দেখেন নি গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে?
তাই এককথায় বলি স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জন্য শাসকদল বা বিরোধীরা কেউই দায়ী নন। দায়ী আমি। দায়ী আপনি।
About author :
Shree Amit Goswami
Socially responsible poet, a popular face in Both side of Bengal borders. Always writes about the social issues with deep intellect and impartial analysis.