Read Time:9 Minute, 51 Second
নবরূপে রায় ভিলা…।।
অশোক মজুমদার
দার্জিলিঙের রায় ভিলা থেকে ম্যাল এক আশ্চর্য রাস্তা। পনি রোড নামে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে নিবেদিতা মাঝেমধ্যেই ম্যালে চলে যেতেন। আমাকে ১.৪ কিলোমিটার ব্যাপী সেই রাস্তাটির সন্ধান দিলেন স্বামী নিত্যসত্যানন্দ। অপূর্ব এই হেরিটেজ রাস্তা। ঠিক ম্যালের মাঝখান দিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি নেমে গেছে। তারপর আপনার মনে হবে যেন আপনি কলকাতার রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। মিনিট ২০ হাঁটার পর বাঁদিকে কিছুটা গিয়ে ওপরের রাস্তাটা ধরবেন। না বুঝতে পারলে স্থানীয় মানুষের সহায়তা নেবেন। আবহাওয়া ভাল থাকলে দেখবেন ডানদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আপনার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। কোন বাড়ি ঘর নেই, সঙ্গে ক্যামেরা নিতে ভুলবেন না। অবশ্য ক্যামেরা না থাকলে ক্ষতি নেই, মোবাইল তো রয়েছে। এ রাস্তায় হাঁটা মানে ছবি তোলা। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই রায় ভিলা পৌঁছে যাবেন।
ইংরেজ আমলে বড় কোরে পনি রোড ধরে ঘোড়ায় চড়ে যাত্রীদের ঘোরানো হত। রায় ভিলা কিংবা ম্যালে যাওয়ার এটাই ছিল প্রধান রাস্তা। আর এখন যে রাস্তা দিয়ে আপনারা রায় ভিলা দর্শন করেন নিচের সেই পাকা রাস্তাটি তৈরি হয়েছে ১৯৫৮ সালে। বাঁধানো ছবিতে দেখলাম, ১৯৫৪ সালে জওহরলাল নেহরু ইন্দিরাকে নিয়ে এই রাস্তা দিয়েই হেঁটে রায় ভিলায় উঠছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিঙের মুখ্য আধিকারিককে এই হেরিটেজ রাস্তা সংস্কারের নির্দেশ দিয়ে এক জাতীয় কর্তব্য পালন করেছেন।
এই শৈলশহরটিকে খুব ভালবাসতেন নিবেদিতা। ১৯০৩ – ১১সালের মধ্যে এখানে সাতবার এসেছিলেন তিনি। স্বামী বিবেকানন্দ দার্জিলিঙে এসেছিলেন চারবার। নিবেদিতা অসুস্থ হয়ে শেষবার দার্জিলিঙে এসেছিলেন ১৯১১সালে। ১৫দিন এই বাড়িতেই ছিলেন। ঐ বছরের ১৩ই অক্টোবর এই বাড়িতেই তিনি মারা যান। তার শেষযাত্রায় ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার, সুবোধ চন্দ্র মহলানবীশ, ডঃ বিপিন বিহারী সরকার প্রমুখ। এই জায়গাটা থেকে যারা তাঁর স্মৃতি মুছে ফেলতে চাইছে তাদেরই মদত দিচ্ছে বিজেপি।
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় রায় ভিলা দখল করে গুরুংরা বানিয়েছিল জিএনএলএফের অস্ত্রভাণ্ডার, এখানে চলত তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির। পরবর্তীকালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের হাত থেকে নানা কৌশলে এই বাড়ি উদ্ধার করে রামকৃষ্ণ মিশনের হাতে তুলে দেন। এই সামান্য সাংবাদিক দিদির এই অসামান্য প্রশাসনিক কৌশলের এক সাক্ষী। দিদি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় বাড়িটা ছিল জিটিএ-র দখলে। জিটিএ প্রধান বিমল গুরুং বাড়িটা মোটেই ফেরৎ দিতে চায়নি। সে নানা টালবাহানা করছিল। ২০১৩র ১৬ই মে দিদি গুরুংকে দিয়ে এই বাড়ি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য একটা চুক্তি করান। গুরুং কিছু বোঝার আগেই দার্জিলিঙের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনকে তিনি একটি সাদা কাগজে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির খসড়া তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সই করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জিটিএ-র পক্ষে বিমল গুরুং এবং রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের সম্পাদক স্বামী সুহিতানন্দ। চুক্তির পরপরই এক কোটি টাকা মিশনকে দিয়ে তিনি বাড়িটার সংস্কারের কাজ শুরু করতে বলেন। গোটা ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে আমরা সাংবাদিক ও আমলারা কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমায় নির্দেশ দেওয়া হল এই চিঠির ছবি তুলে নবান্নে পাঠিয়ে দিতে। ব্যাপারটা মিডিয়ায় চলে আসার পর গুরুং এর আর অন্য কিছু বলার রাস্তাই রইল না।
একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ সবকিছু নিয়ে রাজনীতি করেন। বিজেপি তেমনই একটা দল। বিবেকানন্দ, নিবেদিতার স্মৃতিবিজড়িত দার্জিলিঙের ঐতিহাসিক বাড়ি রায় ভিলাকে নিয়ে তেমনই রাজনীতি করে চলেছে বিজেপি। বঙ্গভঙ্গের সময় নিবেদিতা দার্জিলিঙে ছিলেন। তখন তিনি অসুস্থ, সেই অবস্থাতেই দার্জিলিঙের হিন্দু পাবলিক লাইব্রেরিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। নিবেদিতার সঙ্গে সেদিন হলের সব মানুষ ডানহাত তুলে ধরলেন। সবার হাতে বাঁধা হল রাখী। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে নিবেদিতা বলেছিলেন, ‘জীবনের একমাত্র প্রতিশব্দ হল স্বাধীনতা।’ নিবেদিতার স্মৃতিবিজড়িত সেই শৈলশহরকে গুরুং এর মত কিছু গুণ্ডার হাতে তুলে দিতে চাইছেন বিজেপি সরকার। শিকাগো বক্তৃতার ১২৫তম বছরে যারা বিবেকানন্দের নাম করে গলা ফাটাচ্ছে সেই বিজেপিই কিন্তু পাহাড়ে তাঁর প্রিয় ভগিনী নিবেদিতার স্মৃতি যারা ধ্বংস করতে চাইছে তাদের মদত দিচ্ছে। এদের মদতেই গুরুং এখনও আত্মগোপন করে আছেন। বাম আমলে কংগ্রেসও একই কাজ করেছিল। জিএনএলএফের তাণ্ডবের দিনে সিপিএম ইঁদুরের গর্তে লুকিয়েছিল। তারা পাহাড়ে বস্তুত ঘিসিং এর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। আমি তখন সাদা বাড়ি কালো গ্রিল মানে সরকার বাড়ির চিত্রসাংবাদিক। দিনের পর দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দার্জিলিঙে থাকতে থাকতে দেখেছি সিপিএমের এই দেউলিয়া রাজনীতি।
নিবেদিতার স্মৃতিবিজরিত এই বাড়ি পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের জন্য দিদি যা করেছেন তা আমাদের ঐতিহাসিক স্মারকগুলির সংরক্ষণের কাজে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। পুননির্মিত রায় ভিলার দ্বারোদঘাটন হয় ২০১৪র ২২শে জানুয়ারি। স্বামী নিত্যসত্যানন্দের পরিচালনায় এখন সংস্কারসহ এই বাড়ির নানা কর্মকাণ্ড সুষ্ঠভাবেই চলছে। কিছুদিন আগেই দিদি রায় ভিলার জন্য আরও ১০কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। এই সংস্কারের কাজে শুরু থেকে পাশে থেকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের দেশের জন্য নিবেদিতার অবদানকেই সন্মান জানালেন। পাহাড়ের ওঠার সময় দেখি রাস্তার দুপাশে মানুষ সাদা ফুল নিয়ে দাড়িয়ে থাকেন। মুখের হাসিতে তারা দিদিকে স্বাগত জানান। এ সবই কিন্তু পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য দিদি যা করেছেন তার জন্য। পাহাড়ের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগুলির সংরক্ষণ রাজ্যের উন্নয়ন কর্মসূচির অঙ্গ। নেতাজী এক জায়গায় লিখেছিলেন, ভারতবর্ষকে আমি ভালবেসেছি বিবেকানন্দ পড়ে, আর বিবেকানন্দকে আমি চিনেছি, নিবেদিতার লেখায়। রায় ভিলার সংস্কার ও সংরক্ষণের মাধ্যমে এই মহীয়সী নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অশোক মজুমদার
সংগ্রাহক : ফারুক আহামেদ
Advertisements