সুস্থ সমাজ গড়ার অগ্নিশপথ ফারুক আহমেদ সম্পাদিত উদার আকাশ উদ্বোধন করলেন মোস্তাক হোসেন
তরুণ মুখোপাধ্যায়
সুস্থ সমাজ গড়ার অগ্নিশপথ নিয়ে ১৮ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ভাব ও ভাষা সমৃদ্ধ প্রগতিশীল সাহিত্য পত্রিকা উদার আকাশ। ঈদ-শারদ উৎসব সংখ্যা ১৪২৬ বিশেষ বিষয় সহবস্থান ও সমন্বয় ‘উদার আকাশ’ উদ্বোধন করলেন মোস্তাক হোসেন।
উদার আকাশ কেবল পত্রিকা নয়, আত্মমর্যাদার অভিজ্ঞন।
উদার আকাশ কেবল স্লোগান নয়, সুস্থ সমাজ গড়ার অঙ্গীকার।
উদার আকাশ দিচ্ছে ডাক, ঘরে ঘরে সাহিত্য-চেতনা পৌঁছে যাক।
উদার আকাশ ঈদ-শারদ উৎসব সংখ্যা ১৪২৬, বিশেষ বিষয়, সহাবস্থান ও সমন্বয় সংখ্যাটি উদ্বোধন করলেন পতাকা শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধার মোস্তাক হোসেন। শনিবার পতাকা হাউসে উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাটি মোস্তাক হোসেন-এর হাতে তুলে দিলেন। এদিন উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশনের পক্ষ থেকে মোস্তাক হোসেন-এর হাতে “দানবীর পুরস্কার” তুলে দেওয়া হয়। সমাজ কল্যাণে অফুরন্ত অবদানের জন্য মোস্তাক হোসেন পথিকৃৎ। তাঁকে সম্মাননা প্রদান করতে পেরে উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশন সম্মানিত।
কলেজজীবন থেকেই সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ তরুণ সম্পাদক ফারুক
আহমেদ। ধারাবাহিকভাবে তিনি নিভৃতে তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করে যাচ্ছেন কয়েক দশক ধরে।
ফারুক আহমেদ, মৌসুমী বিশ্বাস ও রাইসা নূর সম্পাদিত উদার আকাশ পত্রিকার ‘ঈদ-শারদ উৎসব সংখ্যা ১৪২৬’ এই সংখ্যার বিশেষ বিষয় রাখা হয়েছে ‘সহাবস্থান ও সমন্বয়’।
বাঙালির দুই মুখ্য সম্প্রদায়ের দুই প্রধান উৎসব ঈদ ও শারোদৎসবকে সামনে রেখে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও মিলনের জয়গান গাওয়াই উদার আকাশের মূল লক্ষ্য।
সম্পাদকীয়তে ফারুক আহমেদ মুখ্যত দুটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন। দেশভাগের পর এপার বাংলার সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থা খুবই করুন ছিল। সেই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে নানা রকমের কায়িক শ্রম ও ছোট ছোট ব্যবসার মাধ্যমে কেউ কেউ একটু আধটু আর্থিকভাবে সক্ষম হয়। কিন্তু শিক্ষাদীক্ষায় তাঁদের অবস্থান ছিল একেবারে তলানিতে। সেই অবস্থার বদল শুরু হয় আটের দশকে এবং এই পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা নেয় কিছু মিশন স্কুল। এক্ষেত্রে সম্পাদক যথার্থই বলেছেন এই মিশন আন্দোলনে শিল্পপতি মোস্তাক হোসেনের সোনালী পৃষ্ঠপোষকতায় নব জাগরণ ঘটিয়েছে। তাঁর এই ছত্রছায়ায় জাতি-ধর্ম- বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলেই উপকৃত হয়েছেন এবং নিয়মিত হচ্ছেন। তিনি এই মহান বাঙালি শিক্ষাব্রতী ও শিল্পপতি মোস্তাক হোসেনকে “ভারতরত্ন” দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছেন, সেটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেশ পিছিয়ে থাকা সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারের তরফে বিশেষ ফাণ্ডের ব্যবস্থা করা হোক। এরই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্তনিগম থেকে গ্যারেন্টারমুক্ত লোন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন এই সমাজে গ্যারেন্টার পাওয়া খুবই কঠিন কাজ। এবং কেবল এ কারণের জন্য বহু অভাবী মেধাবী উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পত্রিকার মাধ্যমে শুধু সাহিত্যচর্চা নয় সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রকাশের উজ্জ্বল উদাহরণ লালমিয়া মোল্লার ‘আসুন সদর আলির পাশে দাঁড়াই’। খুবই অসহায় এই সাহিত্যিক এবং তাঁর পঙ্গু স্ত্রীর প্রতি সাহায্যের মানবিক আবেদন রেখেছেন লালমিয়া মোল্লা এবং সম্পাদক উভয়েই।
উল্লেখ্য, এই বিশেষ সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয়েছে দানবীর মাননীয় মোস্তাক হোসেন মহাশয়কে।
প্রতিটি সংখ্যার মতো এই সংখ্যায়ও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ-নিবন্ধ স্থান পেয়েছে। “সহাবস্থান ও সমন্বয়” বিষয়ে মহামূল্যবান প্রচ্ছদ নিবন্ধ লিখেছেন স্বনামধন্য প্রাবন্ধিক শেখ একরামূল হক।
সম্প্রতি দেশের দুর্দশা নিয়ে বিশিষ্ট ৪৯ জন বুদ্ধিজীবীর উদ্বেগ এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় সংঘ পবিবার ঘনিষ্ঠ ৬২ জন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর তরজা নিয়ে এক সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান নিবন্ধ লিখেছেন অশোক মজুমদার।
প্রয়াত সাহিত্যিক সোহারাব হোসেনের ‘মাঠ জাদু জানে’ উপন্যাস নিয়ে দারুন আলোচনা করেছেন গবেষিকা তুহিনা বেগম।
‘পাতিসরে রবীন্দ্রনাথ’ নিবন্ধে মোহাম্মদ শামশুল আলম বিস্তারিতভাবে কবিগুরুর প্রেক্ষিত তুলে ধরেছেন।
রাজনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক মইনুল হাসান দেশভাগ পরবর্তী আমাদের রাজ্যে সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিয়ে তথ্য ও তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতা মিশিয়ে মননশীল নিবন্ধ উপহার দিয়েছেন। এই আলোচনায় অন্যদের দোষত্রুটি নিয়ে বিশ্লেষণ আছে কিন্তু আত্মসমালোচনার কথাও জোর দিয়ে বলেছেন মইনুল হাসান।
সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ নিয়ে চর্চার ধারা বেশ কম। সেই প্রেক্ষিতে আবেদা সুলতানার ‘গৌরকিশোর ঘোষের ছোট গল্পে রাজনীতি’ নিবন্ধ সেই অভাবপূরণে সহায়ক হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
পূর্ণিমা রায়ের ‘করম পূজা’ এবং বহ্নিশিখা রায় প্রধানের ‘স্মৃতি আঁকড়ে চট্টগ্রামের লৌকিক ব্রত আশ্বিন কুমারী’ বাঙালি সমাজের ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর লৌকিক বিষয়ের অজানা অচেনা দিকগুলি জানতে এবং দূর করতে সহায়ক হবে।
মনুষ্যত্বের ফেরিওয়ালা বিষয়ে কলম ধরেছেন দেবপ্রিয়া গুহ নিয়োগী।
শিশুতোষ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম-এর উপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ উপহার দিয়েছেন সৈয়দ মহঃ সাইফুল্লাহ্।
কবি চন্দ্রাবতীর সুলুকসন্ধান করেছেন মো: রেজাউল করিম।
পুলিশ আধিকারিক মোহঃ নিজাম শামাম ও ইন্দ্রজিৎ বসুকে নিয়ে বিশেষ আলোকপাত সমৃদ্ধ করবে মনের আকাশ।
আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিবন্ধ লিখেছেন নারায়ণ সূত্রধর, রাফিকুল ইসলাম, কালাম শেখ, মৌসুমী বিশ্বাস ও আসলিম সেখ প্রমুখ।
প্রতিষ্ঠিত দুই বাংলার কবি সুবোধ সরকার, তৈমুর খান, গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী বিশ্বাস, সুপর্ণা সেনগুপ্ত, সু্ব্রতা ঘোষ রায়, ফাল্গুনী দে, সোনালী কর, ওয়াহিদা খন্দকার, গোপা চক্রবর্তী, ঝর্ণা মুখোপাধ্যায়, সৌরভ আহমেদ সাকিব, মোনালিসা রেহমান, কুশল মৈত্র, লোকমান হোসেন পলা, মৃগাঙ্ক গুহ, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সুদীপ সাহা, সুশান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, অশোক পাল, প্রদীপ মজুমদার, আবদুস শুকুর খান, প্রবীর ঘোষ রায়, শেখ সাদী মারজান, হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়, এমি জান্নাত, অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, আরফিনা, তাজিমুর রহমান সহ অনেক প্রতিভাবান কবির কবিতা প্রকাশিত হয়েছে এই সংখ্যায।
প্রতিষ্ঠিত গল্পকারের মধ্যে মোশারফ হোসেন, হারাধন চৌধুরী, সিদ্ধার্থ সিংহ, সৈয়দ রেজাউল করিম, সুখেন্দু বিকাশ মৈত্র, রাজকুমার সেখের পাশাপাশি তরুণ কবি ও গল্পকারের কবিতা ও গল্প এই পত্রিকাকে করে তুলেছে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর।
আকাশ প্রেমিক ফারুক আহমেদ।
চল্লিশের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, ৩৬ হাজার লাইন কবিতা না লিখে যদি একটাও গাছ পুঁততেন, যথাযথ কাজ হতো। কেননা গাছ আমাদের ফল-ফুল-ছায়া এবং আশ্রয় দেয়। প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুস্থ রাখে। বাঁচার প্রেরণা দেয়, শক্তি দেয়। তো এই ৩৬ সংখ্যাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাসঙ্গিকভাবে একথা মনে এলো ফারুক আহমেদের প্রসঙ্গে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ভাঙড় অঞ্চলের নাটাপুকুর গ্রামে তার জন্ম ১৯৮৩-র ৭ মার্চ। অর্থাৎ এখন সে ৩৬ বছরের তরতাজা যুবক।
না, যৌবনই শেষ কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ যে “সবুজের অভিযান” চেয়েছিলেন, অর্ধচেতনদের জাগাতে বলেছিলেন, প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দিতে বলেছিলেন — ফারুক আহমেদ যেন সেই চিরযুবা। অক্লান্ত কর্মী। আর নিষ্ঠাবান সাহিত্য সেবক। ডা: মো: আবেদ আলি ও ফজিলা বেগমের সে কনিষ্ঠ পুত্র। গ্রামের স্কুলে পাঠ শেষ করে ঘটকপুকুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে ভাঙড় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে পাশ করে। এরপর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ইংরেজিতে স্নাতক হয়। গ্রন্থাগার বিজ্ঞান নিয়েও পড়ে। উচ্চতর শিক্ষালাভে ফারুক প্রথমে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে ও পরে ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. পাশ করে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়েই সে গবেষণার জন্য বেছে নেয়। গবেষণার বিষয় — ‘অনগ্রসরদের সামাজিক সমস্যা ও উত্তরণ।’
স্নাতক পাঠ নিতে নিতেই ফারুক বাংলা সাহিত্য পাঠে আগ্রহী হয়। স্থানীয় ‘নজরুল-সুকান্ত পাঠাগার’-এ সে প্রচুর বই পড়ার সুযোগ পায়।
ফারুক এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে কর্মরত।
এহো বাহ্য। ফারুক আহমেদ-র অন্যতম পরিচয়, একটি উন্নতমানের সাহিত্য পত্রিকার সে সম্পাদক। চমৎকার ও ব্যঞ্জনাধর্মী সেই পত্রিকার নাম — উদার আকাশ। অসাম্প্রদায়িক মনের রুচিশীল পত্রিকা। যেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম-সমাজ সমান গুরুত্ব পায়। কোনও বিদ্বেষ নেই। রাজনীতির নানা তথ্য থাকলেও, কখনও উস্কানিমূলক লেখা থাকে না। সকলের জন্য এখানে উদার আমন্ত্রণ। যেন এক মুক্ত আকাশের নিচে মুক্তমনাদের নিয়ে মহামিলন। এখানে যারা লিখেছেন, লেখেন, তাঁরা কেউ কেউ পুরস্কৃত হয়েছেন। যেমন, আফসার আমেদ পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার। শেখ মকবুল ইসলাম জগন্নাথ নিয়ে গবেষণার জন্য পেয়েছেন ডি. লিট। আর ‘উদার আকাশ’ এই ২০১৯-এ তার নিরন্তর চর্চার জন্য পশ্চিমবঙ্গ ছোট পত্রিকা সমন্বয় সমিতির বিচারে প্রথম হওয়ার পুরস্কার পেয়েছে। ঈদ-শারোদৎসব সংখ্যার জন্য তার এই সম্মান লাভ। এর আগে ২০১২-তে পেয়েছিল ‘নতুন গতি’ পুরস্কার। অল ইন্ডিয়া ইমাম-মুয়াজ্জিন অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন (মুর্শিদাবাদ জেলা) ২০১৬-তে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক হিসেবে ফারুক আহমেদকে সম্মাননা জানায়। ২০১৭-তে ফারুক পেয়েছে ‘কথামালা ভারত-বাংলাদেশ-মৈত্রী’ সম্মাননা। নিখিল ভারত শিশু সাহিত্য সংসদও তাকে ‘চর্যাপদ’ পুরস্কারে সম্মান জানায়। এছাড়াও বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছে ফারুক আহমেদ।
পত্রিকা সম্পাদনা ও সাহিত্য সাধনায় ফারুক আহমেদ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রেরণা ও পরামর্শ পেয়েছে। মহাশ্বেতা দেবী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আবুল বাশার প্রমুখ তার শুভানুধ্যায়ী। মোস্তাক হোসেনের সানুরাগ সান্নিধ্য সে পেয়েছে।
সম্পাদক ফারুক আহমেদ নিজেকে আড়াল রেখে ভালো লেখা আর লেখককে প্রাধান্য দিতে চায়। এটা তার বড় গুণ। যদিও নিজে সে কবি, ছড়াকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক। আছে একাধিক গ্রন্থ। জীবিকার দায় মিটিয়ে সাহিত্য সেবায় সে নিষ্ঠাবান। এর পাশে সামাজিক নানা কাজে ও আন্দোলনেও সে জড়িত থাকে। প্রণব মুখার্জি, অমর্ত্য সেন কিংবা মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদও তার পাথেয়।
পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি ফারুক প্রকাশনার কাজেও যুক্ত। একাধিক ভালো বই সে প্রকাশ করেছে। খ্যাতনামা, স্বল্পখ্যাত বহু লেখক সেই তালিকায় আছেন। দূরদর্শন বা অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমেও তার কথা প্রচারিত হয়। ২০১৯-এই কলকাতায় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উৎসব হতে চলেছে তারই উদ্যোগে। তার কর্মকাণ্ড এখানেই শেষ নয়।
আজকের পৃথিবীতে পরিবেশ বিপন্ন। বৃক্ষরোপণ উৎসব একদা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতীতে আজও সাড়ম্বরে তা পালিত হয়। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের উদ্যোগে সেই বৃক্ষরোপণ উৎসবে সামিল হয়েছে অফিস কো-অর্ডিনেটর ফারুক আহমেদও। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা, উন্নতিতেও ফারুক আহমেদ সোচ্চার। এর পাশে তার কবি সত্তাকে সযত্নে সে লালন করে চলেছে। তার ‘দেশপ্রেমিক’ কবিতার প্রথম স্তবক পড়া যাক —
নাফার চোখের দিকে তাকাও
অফুরন্ত সৃষ্টি খেলা করে ও চোখে
ওকে মেরো না, ওকে বাঁচতে দাও
ওর কাছ থেকে চেয়ে নাও
মিত্রতা-ভালোবাসা-মনুষ্যত্ব-মানুষ
অবাঞ্ছিত ভেবে ঘৃণা করো না।
কিংবা ২১শে ফেব্রুয়ারি স্মরণে ফারুক আহমেদ লেখে —
প্রাণের বাংলা ভাষা
তোমার জন্য বিস্তীর্ণ আকাশ
দিগন্তব্যাপী খোলা মাঠ
হাতে হাত
প্রাণের বাংলা ভাষাতেই জানাই
ভালবাসি তোমায়…
আরেকটি কবিতা ‘আমার না-পাওয়া প্রেম তানিয়া’। ভাষা প্রেমেই লেখে,
তানিয়া মনে পড়ে ২১ ফেব্রুয়ারি
ভাষার জন্য তোমার জন্য
এ বুকে আজও আকাশ রাখা।
এই ফারুকই বলতে পারে, ‘ভালবাসার জন্য বাঁচো, বাঁচার মত বাঁচো।’
‘একটা না-কবিতা’য় পড়ি, স্ত্রী ও কন্যার প্রতি গভীর প্রেম, স্নেহ। যেখানে কবির অনুভব —
অনন্ত ভালবাসা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে
ভালবাসার একটা চুম্বন
অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে
অপেক্ষালয় হয়েছে।
‘এক আকাশ প্রেম’ নিয়ে ফারুক আহমেদ এগিয়ে চলুক। চরৈবেতি।।
আর এক লেখক লালমিয়া মোল্লার কলমে উঠে এসেছে।
সাহিত্য আকাশে এক আশ্চর্য উড়ানের নাম ফারুক আহমেদ।
গ্রাম বাংলার বিরল প্রতিভাদের মধ্যে অন্যতম ফারুক আহমেদ। মাটিতে জন্ম নিয়ে ধীরে-ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে ইচ্ছে শক্তির জোরে একদিন আকাশ-ছোঁয়া ফারুক আহমেদের। অত্যন্ত কাছে থেকে সেই বেড়ে-ওঠা প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, আর সেই গল্প শোনাবার অভিলাষ নিয়েই আজ কলম ধরলাম।
১৯৮৩ সালের ৭ মার্চ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অবিভক্ত ভাঙড় (বর্তমান কাশীপুর) থানার পোলেরহাট অঞ্চলের নাটাপুকুর গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় জন্ম হয় ফারুক আহমেদের। গ্রামের মানুষের সাধারণ চিকিৎসক ডা: মো: আবেদ আলি ও ফজিলা বেগমের তিন সন্তানের কনিষ্ঠটির একদিন বিশ্ববরেণ্য অমর্ত্য সেনকে ছুঁয়ে দেখা ও ভারতের রাষ্ট্রপতি-ভবনে উপস্থিত হয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে তাঁর লেখা বই ও সম্পাদিত পত্রিকা তুলে দেওয়ার মাঝের কাহিনী কম রোমাঞ্চকর নয়।
১৯৯৯ সাল। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী একটি ছেলের নামের বানান গরমিলের বিষয়ে রেজিষ্ট্রেশন দপ্তরের সঙ্গে মতবিরোধের ঘটনা বাংলার একটি লিডিং দৈনিকে লেখালেখি হলো এবং ছেলেটি সে-লড়াইতে জিতে গেল। সেই ছেলেটিই অতি সুদর্শন, জেদি-পড়ুয়া, সদাহাস্যমুখ এবং স্কুলের শিক্ষকদের ও স্থানীয় এলাকার অতি আদরের প্রাণচঞ্চল কিশোর আজকের ফারুক আহমেদ।
নাটাপুকুরের গ্রামের স্কুলের প্রাথমিক পাঠ শেষ করে ভাঙড় থানারই (তৎকালীন অবিভক্ত) ঘটকপুকুরে নতুন বাসস্থানের সুত্রে ঘটকপুকুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া কিশোর মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন প্রথম বিভাগে। ২০০১ সালে ভাঙড় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে আবারও প্রথম বিভাগ। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ২০০৪ সালে ইংরেজিতে স্নাতক। বিদ্যা ও জ্ঞানার্জনের নেশা তাঁকে থামতে দেয় না। এম এস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতক হন তিনি প্রথম বিভাগে। তারপর ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অনগ্রসরদের সামাজিক সমস্যা ও উত্তরণ’ বিষয়ে গবেষণায় ব্যস্ত ফারুক আহমেদ।
২০০৪ সালে বিএ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ফলাফল প্রকাশের পূর্বেই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। বিষয়টি বেশ ঘটনাবহুল। আমরা তখন ঘটকপুকুর নজরুল-সুকান্ত পাঠাগারকে কেন্দ্র করে একটা আড্ডা জমাই। মধ্যমনি ওই গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক রফিকুল ইসলাম। তাঁর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে আমি ‘সূর্যমুখী’ নামে একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলি। আমাদের সেই আড্ডার সর্ব কনিষ্ঠ সদস্যের নাম ফারুক আহমেদ। একটা গ্রন্থাগারের একসঙ্গে প্রচুর বই তাঁর হাতের নাগালে পেয়ে আর গ্রন্থাগারিক রফিকুল ইসলামের আদরে তিনি সব সময় ওখানে পড়েই থাকেন। এই সময় তাঁর হাতে আসে বহু প্রবন্ধগ্রন্থ, উপন্যাস ও কবিতার বই। বিপুল উৎসাহে ওই সব বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে ফারুক লেখকদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ফোন করেন এবং সাক্ষাৎ করার আমন্ত্রণ পান।
এরপর ২০০২ সাল। তরুণ ফারুক আহমেদ প্রথম পত্রিকা প্রকাশ করতে চাইলে তার নামকরণ করেন ‘উদার আকাশ’। এই সময় তাঁর প্রতিদিনের সঙ্গী আমি। দিনের একটা ভাগ কলেজ, কলকাতা হলে আর একটা ভাগ আমার কাছে তিনি। ভীষণ প্রাণচঞ্চল কিশোর। এই ভাঙড়ে তো ওই কলকাতায়। যেখানে আবৃত্তি বা প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা সেখানেই ফারুক। আর ফারুক মানেই পুরস্কার।
এই সময় তাঁর সারাক্ষণের আর এক সঙ্গী ছিল প্রবল অর্থসঙ্কট।
২০০৪ সালের ২৯ জুলাই ফারুক আহমেদকে চাকরি দিলেন তাঁর স্বপ্নের শিক্ষা প্রসার তথা শিল্পক্ষেত্র বসন্তপুর, মুর্শিদাবাদে। ফারুক আহমেদকে করে দিলেন বসন্তপুর এডুকেশন সোসাইটির “অফিস সেক্রেটারি।” দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ১১ বছর এখানে কাজ করার পর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা বিভাগের সহ-নির্দেশক হিসাবে যোগদান করেন।
এই সময়কালের মধ্যে ২০০৭ সালের ২৯ জুলাই মৌসুমী বিশ্বাসের সঙ্গে বিবাহ দেন। বর্তমানে তাঁদের সাড়ে পাঁচ বছরের এক ফুটফুটে কন্যা-সন্তান রাইসা নূর।
২০০২ সালে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে প্রথম পত্রিকা প্রকাশ ‘উদার আকাশ’। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে এমন ব্যাঙের ছাতার মতো বহু পত্রিকার জন্মের পর সুতিকা-গৃহেই মৃত্যু হয়। মূলত: অর্থাভাবে। কিন্তু এমন ব্যতিক্রম খুব কমই দেখা যায়। এত অর্থাভাবেও কেবল উদ্যমের জোরেই ‘উদার আকাশ’ আজ ডাগর-ডোগর ১৮ বছরের ঝকঝকে এক তরুণ। ‘উদার আকাশ’ এখন আন্তর্জাতিক। দুই বাংলা তথা বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি লেখক ও পাঠক-কুলের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধ। ২০০৬ সালে ‘উদার আকাশ’-এ প্রকাশিত উপন্যাস-এর জন্য প্রখ্যাত সাহিত্যিক আফসার আমেদ বঙ্কিম পুরস্কার লাভ করেন। এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের জন্য ২০১০ সালে কলকাতার মর্যাদাপূর্ণ টাউন হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে খাজিম আহমেদ ও আমিনুল ইসলাম ‘বর্ণপরিচয়’ পুরস্কার লাভ করেন। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, ড. শেখ মকবুল ইসলামের জগন্নাথ দেবতার-এর উপর একটি গবেষণাপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় “উদার আকাশ” পত্রিকায় এবং পরে তিনি ওই গবেষণার জন্য ডি লিট পান। অধ্যাপক ড. শেখ মকবুল ইসলামের আরও কয়েকটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে “উদার আকাশ।”
২০১১-২০১২ ও ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ ছোটো পত্রিকা সমন্বয় সমিতি “উদার আকাশ” পত্রিকাকে শ্রেষ্ঠ ঈদ-শারদ উৎসব সংখ্যা নির্বাচিত করে। ২০১২ সালে লিটল ম্যাগাজিন বিভাগে “উদার আকাশ” “নতুন গতি পুরস্কার” পায়। অল ইন্ডিয়া ইমাম-মুয়াজ্জিন এণ্ড সোশাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন-এর মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ফারুক আহমেদকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বারাসাত রবীন্দ্রভবনে কথামালা আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উৎসব ২০১৭-র অনুষ্ঠানে ফারুক আহমেদকে ‘কথামালা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করা হয়। অল ইন্ডিয়া এস সি এণ্ড এস টি রেলওয়ে এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন তাঁদের নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এনুয়াল জেনারেল মিটিং-এ ফারুক আহমেদকে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ২০১৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। নিখিল ভারত শিশুসাহিত্য সংসদ কবি ফারুক আহমেদকে ২০১৭ সালে “চর্যাপদ” পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করে। এছাড়াও ফারুক আহমেদ আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।
বাংলার স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ ফারুককে স্নেহের বাঁধনে বেঁধেছেন। তাঁর প্রতিটি বিশেষ সংখ্যা সস্নেহে উদ্বোধন করেছেন ও মূল্যবান পরামর্শ দান করেছেন মহাশ্বেতা দেবী, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আবুল বাশার, জয় গোস্বামী, কবীর সুমন, মোস্তাক হোসেন, সুনন্দ সান্যাল প্রমুখ।
তাঁকে স্নেহের বাঁধনে বেঁধেছেন সাহিত্যের আর এক পৃষ্ঠপোষক ও উদ্যোগপতি মোস্তাক হোসেন।
সাহিত্যের পৌরোহিত্য করার সাথে-সাথে একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে সমকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া নানান অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেমন জোরালো কলম ধরেছেন তেমনি জোরালো কন্ঠস্বরে প্রতিবাদও করেছেন ফারুক আহমেদ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের মিছিলে পা মিলিয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে ভাঙড় এলাকার কাশিপুর থানার অন্তর্গত শোনপুরে জলসা করার সময় শাসকদলের কর্মী দ্বারা আক্রান্ত হন ফুরফুরা শরীফের বড় পীর ইব্রাহিম সিদ্দিকী সহ আরও কয়েকজন। ফারুক আহমেদ-এর নেতৃত্বে ও আরও কয়েকটি সংগঠন মিলে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। এই ডেপুটেশনের পর আলাদা সাক্ষাৎ করে ফারুক আহমেদ তাঁর হাতে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ও প্রকাশনার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ তুলে দেন। ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনী এবং দিলীপ বেঙ্গসরকার-এর হাতেও “উদার আকাশ প্রকাশন”-এর গ্রন্থ তুলে দিয়ে তাঁদেরকে সম্মানিত করেছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর হাতেও “উদার আকাশ” পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা “উদার ভারত নির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ” তুলে দিয়েছেন। রাজ্যের অনেক মন্ত্রী ও নেতারা তাঁর প্রকাশনায় কলম ধরেছেন। উদার আকাশ পত্রিকা ও প্রকাশনের গ্রন্থও প্রকাশ করেছেন।
২০১৬ সালে বিখ্যাত তাজ হোটেলে ফারুকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন-এর।
এরপর ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অমর্ত্য সেন প্রকাশ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের উপর গবেষণা মূলক একটি রিপোর্ট। ড. অমর্ত্য সেন-এর প্রতিষ্ঠিত প্রতিচি ট্রাস্ট, গাইডেন্স গিল্ড এবং স্ন্যাপ সংগঠনের উদ্যোগে কলকাতার গোর্কি সদনে (বই আকারে) ওই রিপোর্ট প্রকাশের অনুষ্ঠানে আয়োজকদের মধ্যে ফারুক আহমেদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ফারুক আহমেদের সবচাইতে বড়ো গুণ, তিনি নিজে লেখার চাইতে অপরকে লেখাতে বেশি ভালবাসেন। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে অনেক প্রতিভা কুঁড়ে-ঘরের অন্ধকারে বসে নিরবে সাহিত্য-সাধনায় মগ্ম আছেন। শহরের নামজাদা পত্র-পত্রিকাগুলিতে তাঁদের স্থান হয় না। বলা ভালো পাত্তা মেলে না। ফারুক আহমেদ তাঁদের লেখাকে ‘উদার আকাশ’-এর পাতায় মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরছেন নিরন্তর। অন্যদিকে কারও-কারও ভালো লেখার হাত, কিন্তু লিখতে চান না। এঁদের বারংবার অনুরোধ করে সুন্দর লেখা বের করে আনার মতো পূণ্যের কাজ ফারুক আহমেদ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।
এই চিন্তা-ভাবনা থেকেই তাঁর প্রকাশনার জগতে পা-রাখা। এ-বিষয়ে তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছায় জন্ম হয়েছে “উদার আকাশ” প্রকাশনার। এখানেও ইতিমধ্যেই মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন তিনি। দুই বাংলার লেখকদের ৭৭টি বই এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রকাশনায়। প্রতিটি বইয়ের বিষয়, ছাপার মান, কাগজ ইত্যাদি যে-কোনও বড়ো প্রকাশনার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রকাশনার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো ‘পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমান অন্তবিহীন সমস্যা’ – খাজিম আহমেদ, ‘জীবনশিল্পী রোকেয়া’ – মীরাতুন নাহার, ‘ইসলামের ভুবন’ এবং ‘মোদীর ভারত, গান্ধীর ভারত’ – গৌতম রায়, ‘মানুষ-মাটি-মা’ ও ‘জন্মভূমিশ্চ’ – মোশারফ হোসেন, ‘নজরুল সাহিত্যের দিগ্বলয়’ – নুরুল আমিন বিশ্বাস, ‘জলের কান্না’ – পলাশকুমার হালদার, ‘সাম্যবাদ : ভারতীয় বিক্ষণ’ আর ‘নজরুল নানামাত্রা’ – শেখ মকবুল ইসলাম, ‘পরিবর্তনের সন্ধানে মুর্শিদাবাদের বাঙালি মুসলমান’ – সৌমেন্দ্রকুমার গুপ্ত, ‘মহাশ্বেতা দেবীর গল্পবিশ্ব : লৈঙ্গিক প্রতিরোধ’ – শিবুকান্ত বর্মন, ‘দ্য সেকুলার ভিশন অফ কাজী নজরুল ইসলাম’ – আবুল হোসেন বিশ্বাস, ‘নজরুল সাহিত্যে দেশকাল’ – সা’আদুল ইসলাম, ‘গৌরকিশোর ঘোষ মুসলিম জীবন ও অভিমানস’ – শেখ মুঈদুল ইসলাম প্রভৃতি।
ফারুক আহমেদের নিজের সম্পাদনার কাজেও তাঁর মুন্সিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হয়েছে। তাঁর সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো ‘রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অনগ্রসর ও সংখ্যালঘু’, ‘কংগ্রেস ও বাম-শাসনে মুসলিম ভোট-ব্যাঙ্ক’, ‘আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ’, ‘পশ্চিমে সূর্যোদয় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উলটপূরাণ’, ‘প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়ন’, ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’ সহ বেশ কয়েটি গ্রন্থ।
আগেই বলেছি, নিজে লেখার চাইতে অন্যকে লেখাতে বেশি আনন্দ পান ফারুক আহমেদ। তবুও ধীর গতিতে হলেও নিজের মৌলিক লেখালেখি ও গবেষণার কাজ নীরবে চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে গুণগ্রাহীদের চাপে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘বিশ্বপ্রেম’ প্রকাশিত হয়েছে ও তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘বিনির্মাণ’ প্রকাশের পথে।
বাংলায় তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি বৈদ্যুতিন চ্যানেলের টক-শোতে চ্যানেলের আমন্ত্রণে উপস্থিত থেকেছেন। তাঁর মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরেছেন বাংলার কল্যাণের জন্য। ২০০৭ সাল থেকে তিনি মুর্শিদাবাদ জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য প্রতিনিয়ত সামাজিক ভাবে জনমত গড়ে তুলেছেন। বিভিন্ন আন্দোলন করছেন এবং সরকারের কাছে লিখিত ভাবে আবেদনও করেছেন।
একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের মাটি থেকে তাঁর এই যে উড়ান, তা কেবল তাঁর একার প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরেই। বর্তমান সময়-কালে শহরের পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলে কেউই ওড়ার সাহস দেখাতে পারেনা। খুব কাছ থেকে দেখেছি, তাই বলতে পারি, কেবল ইচ্ছে-ডানায় ভর করেই তাঁর এই উড়ান। এই মুহূর্তে ফারুক আহমেদ একাধারে জনপ্রিয় সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সমাজ-চিন্তাবিদ ও দক্ষ সংগঠক।
আগামী ১৩ নভেম্বর ২০১৯ তাঁরই উদ্যোগে কলকাতার আই সি সি আর সত্যজিৎ রায় অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ‘গঙ্গা-পদ্মা সাহিত্য-সৌহার্দ্য’ বা ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী-উৎসব–২০১৯’। দুই বাংলার সংস্কৃতি ও সাহিত্যি-জগতের মেলবন্ধনের মাধ্যমে দুই বাংলা একত্রিত থাকবে আজীবন, ফারুকদের এই কামনা একদিন যথার্থ হয়ে উঠবে, দল-মত-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে, যেদিন থাকবে না কোনও লুকনো বিদ্বেষ, ভারতবাসী হিসেবে আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছি। সেই সুদিন, যা অনিবার্য এবং একদিন আসবেই।
বিশিষ্ট প্রবন্ধকার, লেখক, সাহিত্যিক, ঔপনাস্যিক প্রমুখ মানুষের ভালবাসা, সমস্ত সাহিত্যপ্রেমি মানুষের তাঁর প্রতি উচ্চাকাঙ্খ্যায় ও সর্বপরি তাঁর জীবনে উপস্থিত পরিবার, এক মূল্যবান তারা ও এক পরীর মতো রাজকন্যার অনুপ্রেরণাতে সাহিত্য আকাশে ফারুক আহমেদ হয়ে উঠেছে এক আশ্চর্য উড়ানের নাম।