চৌদ্দশাক ও চৌদ্দশাক খাওয়ার উপকারিতা
হীরক মুখোপাধ্যায় (২৫ অক্টোবর ‘১৯):- দীপান্বিতা অমাবস্যার আগের দিন ভূত চতুর্দশী বা প্রেত চতুর্দশী-তে বাঙালীর ঘরে ঘরে চৌদ্দশাক খাওয়ার একটা চল রয়েছে।
এই চল বহুদিন ধরে চলে আসছে।
প্রচলিত দেশীয় প্রবাদ অনুযায়ী, আশ্বিন-কার্তিক মাসদুটো যমদ্রংস্ট্রা। কার্তিক মাসে যমের আটটা দরজাই খোলা থাকে।
এই সময়ে বিভিন্ন ঋতুজ ব্যাধি প্রতিরোধার্থ কালোপযোগী ব্যবস্থা প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের দেশ অর্থাৎ ভারতে প্রচলিত ছিল। দেশের প্রত্যেক প্রদেশেই ভিন্ন ভিন্ন ঋতুজ ব্যাধির আগমন হলেও পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু ছ’টা ঋতু অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকট হয়, তাই এখানে বিভিন্ন ঋতুজ ব্যাধি-র হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর অভিলাষে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবেই চৌদ্দশাক খাওয়ার প্রবণতা তৈরী হয়েছিল।
চৌদ্দশাকের তালিকায় যে নামগুলো পাওয়া যায়, চরক-সুশ্রুত-এর যুগে সেগুলোর গুণগত দ্রব্যশক্তি চরমভাবে নিরূপিত হয়েছিল।
প্রাচীন স্মৃতি গ্রন্থ ‘নির্ণয়া মৃত’-র অভিমত অনুসারে ১৬ শতাব্দীর নব্য স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন তাঁর ‘কৃত্যতত্ত্ব’ নামক বইয়ে লিখেছেন :-
‘ওলং কেমুকবাস্তূকং সার্ষপাংচ নিম্বং জয়াং
শালিঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলূকং গুড়ুচীন্তথা
ভন্টাকীং সুনিষণ্ণকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ
প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।’
এই চৌদ্দশাকের মধ্যে যে যে শাকগুলো পড়ছে সেই শাকগুলো হলো ওল (Amarphophallus campanulatus), কেঁউ (Costus specious), বেতো (Chenopodium album), কালকাসুন্দে (Cassia sophera), সরিষা (Brassica campestris), নিম (Azadirachta indica), জয়ন্তী (Sesbania sesban), শালিঞ্চ/শাঞ্চে (Alternanthera sessilis), গুড়ুচী/গুলঞ্চ পাতা (Tinospora cardifolia), পটুক/পটল পাতা (Trichosanthes dioica), শেলূকা/শুলফা (Cordia dichotoma), হিলমোচিকা/হিঞ্চে (Enhydra fluctuans), ভন্টাকী/ভাঁট/ঘেঁটু (Clerodendrum infortunatum), সুনিষণ্ণক/সুষণী (Marsilea quadrifolia)।
এই নির্দিষ্ট চৌদ্দ শাকের উপকার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর ‘চিরঞ্জীব বনৌষধী’ গ্রন্থের প্রথম ভাগের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “ওল অর্শ নাশ করে, কেঁউ ও ঘেঁটু পাতা ক্রিমিকে প্রতিহত করে, বেতো শাক যকৃত (লিভার)-কে শাসন করে, কালকাসুন্দে কাসি বা কাস-কে নাশ করে, সরষে শাক সংস্কার সাধন করে খেলে মলমূত্রের সারল্য আনে, নিম পিত্তজ চর্মরোগ-কে বিনষ্ট করে, জয়ন্তী ঋতু পরিবর্তনজনিত তরুণ সর্দির হাত থেকে বাঁচায়, গুলঞ্চ বায়ুবিকার দূর করে, পটল পাতা সঞ্চিত পিত্তদোষ-কে সংশোধন করে, শেলূকা ক্ষুধাবর্ধক ও রুচিকারক এবং সুষণী স্নায়ুতন্ত্রকে স্নিগ্ধ করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।”
এখন প্রশ্ন, শুধুমাত্র ভূত চতুর্দশীর দিন চৌদ্দশাক খেলেই কী অকালজ প্রেতমুক্তি বা অকাল মৃত্যু ঠেকানো যাবে ?
এই বিষয়ে আলোকপাত করে আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য লিখেছেন, “এই দিন থেকে চৌদ্দশাক খাওয়ার প্রারম্ভিক সূচনা, এই চৌদ্দরকম শাকের ভেতর থেকে প্রত্যেকদিন দুই তিন বা ততোধিক শাক ভক্ষণ করলে শরীর অনেক বেশি সুস্থ থাকবে।”
কিন্তু মজার বিষয় আজকের দিনে আমরা বাজার থেকে চৌদ্দশাক ভেবে যে শাক কিনে আনি তার মধ্যে এই শাকগুলোর বেশিরভাগই অনুপস্থিত থাকে, ফলতঃ আমরা নির্দিষ্ট উপকার লাভে বঞ্চিত হই।