উলট পূরণের গল্প – নন্দলাল এবং মন্দলাল
পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়,কলকাতা ,০৩.০৮.২০২০:
নন্দলাল এবং মন্দলাল একই সময়ে একই আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেড়ে ওঠা দুজন ভিন্ন দুই চরিত্র। একজন শান্ত,ভালোমানুষ।আর একজন ধূর্ত,বাচাল।প্রথমজনের ইন্দ্রিয়গুলো অনেক সজাগ,অনুভূতিগুলো অনেক বেশি আবেগ মাখা।সে সৃষ্টিশীল।মানুষের দুঃখে তার কান্না পায়, তার সুখে সেও ভালো থাকে।দ্বিতীয় জন অনুভূতিহীন,ইন্দ্রিয়হীন অগভীর একজন মানুষ।পৃথিবীতে কি ঘটে গেল,কে কেমন থাকলো এতে তার কিছু যায় আসে না।নিজের ভালো থাকা, খাওয়া,পরা এসবেই তার শুধু নজর। একটা সময়ের পর পেশার বাইরে,প্রথমজন হলো একজন সৎ সমাজকর্মী,কবি,লেখক,প্রাবন্ধিক।দ্বিতীয় জন হলো সেবার মোড়কে তাকেই পেশা বানিয়ে নেওয়া একজন আধুনিক অসৎ রাজনৈতিক নেতা।প্রথমজনের হৃদয়ে ফুল ফোটে।দ্বিতীয়জনের বাহ্যিক চাকচিক্য অন্তঃসারশূন্য ভিতরকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে।নন্দলাল মনের আনন্দে মানুষের পাশে থাকে।মানুষ নির্ভয়ে নিঃসঙ্কোচে তার সঙ্গে মেলে মেশে কথা বলে।মন্দলাল,যখন যে দলের উপর রাজ্যপাটের শাসনভার তাদের শিবিরে আনাগোনা করে।একই রকম উপরচালাক মানুষদের নিয়ে গোষ্ঠী তৈরি করে সমাজসেবার ভান করে।ঢাক পেটানোর আড়ালে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে।গোষ্ঠীর বড় মেজ সেজ ভাইয়েরা দাদার গুণকীর্তনের ঢঙের দাপটে অনধিকারে অন্যের দেওয়াল রঙে অপভাষায় ভরিয়ে তোলে।তাকে ভগবানের পর্যায়ে তুলে দেয়।দাদা মাথায় রাজমুকুট পরে রাজভোগ খায়।ভাড়া করা লোকেদের জয়ধ্বনিতে ধন্য ধন্য পড়ে যায় চারিদিকে। কিছু মধ্যপন্থী অতটা বিগড়ে না যাওয়া নির্বোধ হাবভাব করে থাকা উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিন্তু শক্তিহীন মানুষ বিরোধী দলে ভালমানুষের নামাবলী পরে সময় কাটায় এবং শাসক হওয়ার সুযোগ খোঁজে।মনে মনে মন্দলাল হওয়ার উচ্চাশাকে লালন করে।
ভারতীয় এবং আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বাঙালি নাগরিক সমাজে এ এখন এক ভয়ানক সমস্যা,বিপন্নতা।আগে সমাজসেবা করতে সমাজসেবকের বাহ্যিক তকমা নিতে হতো না। তাতে মানুষের শ্রদ্ধা ছিলো। এখন সমাজসেবা ধান্দাবাজির নামান্তর আর সমাজসেবক কথাটা খাসা গালাগালে পরিণত হয়ে গেছে।
যোগ্য মানুষের জন্য শ্রদ্ধা মনের গভীর থেকে আসে।সব যুগের নাগরিকদেরই এ প্রবৃত্তি স্বাভাবিক হওয়া উচিত। কিন্তু যবে থেকে হীরের থেকে কাচের চাকচিক্যে সাধারণের আকর্ষণ বেড়েছে সেদিন থেকে সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে হয়ে গেছে। লোভী মানুষেরা কিছু পাওয়ার আশায় কাচের দিকে ভেড়ে।কাচেরাও কিছু পাইয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে চুনো পুঁটি রুই কাতলা সবরকম মানুষরূপী মাছ তোলে তাদের চাকচিক্য ও জৌলুসের জালে।
শিক্ষার থেকে ক্ষমতার গুরুত্ব বেশির যুগে তাই সামাজিক উন্নয়ণের মানেও পাল্টে গেছে।কি সাহিত্য,কি সংস্কৃতি কি শিল্প কি রাজনীতি সব জায়গাতে এখন মনীষী নয়, ধান্দাবাজদের রমরমা।যারা ব্যতিক্রমী তারা সামাজিক পাঠশালার পিছনের বেঞ্চে বসে মিউ মিউ করে।সামনে বসে বাঘ ভাল্লুক সেজে হালুম হুলুমের ঢাক বাজায় ফাঁকা কলসি চক্রীরা।
চরিত্র গঠন,সততা,ঔদার্য্য, ত্যাগ, কর্তব্য, একসাথে বাঁচার তাগিদ যেসব শিক্ষা কয়েক দশক আগেও বাড়ি থেকে শুরু হতো,সে নিয়ম কালের চাহিদাতে পুরোনো হয়ে গেছে এখন।অভিভাবকেরা বুঝে গেছে,এসব করে তথাকথিত বোকারা। এখন মানুষ মানে না যে গোষ্ঠীসমৃদ্ধিই আসলে সামাজিক ঔৎকর্ষের সোপান। এ ভ্রান্তির খাদ ভয়ানক গভীর।নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে কেউ এই বিপন্ন জাতিকে গভীর খাদ থেকে টেনে তুলবে এটা আজ তাই কষ্টকল্পিতই নয় শুধু,অসম্ভবও বটে।
নন্দলাল ও মন্দলাল এখন কোনো রূপক নয়, গল্পকথা নয়।প্রথমজনের সাধ্যের সমাধির বুকে দাঁড়ানো দ্বিতীয় জনের সাফল্যের বিজয়স্তম্ভ আজ এক বিশাল ও উদ্ধত উপন্যাস।
●●●●●●●●●●●●
#পলাশ_বন্দ্যোপাধ্যায়
০৩.০৮.২০২০