দেবাদিদেব মহাদেব হলেন হিন্দুদের সর্বোচ্চ দেবতা, সনাতন ধর্মের শাস্ত্রসমুহে তিনি পরমসত্বা রুপে ঘোষিত । সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় তিন কারনের কারন। এটা প্রণাম মন্ত্রই বারবার উঠে এসেছে, তিনি জন্মরহিত, শ্বাশ্বত সর্ব কারনের কারন, স্বরুপে বরতমান সকল জ্যোতির জ্যোতি, তুরিয়, অন্ধকারের অতীত, আদি ও অন্তবিহীন।
শিব প্রণাম মন্ত্র
———————
অজং শ্বাশ্বতং কারনং কারনানং,
শিবং কেবল ভাসকং ভাসকানম্।
তুরীয় তমঃপারমাদ্যন্তহীনং,
প্রপেদ্য পরং পাবনং দ্বৈতহীনম।।
বেদান্ত মতে তিনিই মহা ঈশ্বর, শ্বেতাশ্বত্বর উপনিষদে বলা হয়েছে “ যদাহতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রির্নসন্ন চাসচ্ছিব এব কেবলঃ” অর্থাৎ যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না, দিন-রাত্রি কিছুই ছিল না, সৎ অসৎও ছিল না তখন কেবলমাত্র ভগবান শিবই ছিলেন। তিনিই লীলাচ্ছলে ব্রম্ভারুপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরুপে ধারন করেন আবার রুদ্ররুপ ধারন করে সংহার করেন, তাই সৃষ্টির প্রাক্কালে তিনি শ্রীবিষ্ণুকে বলেন,
“অহং ভবানয়ঞ্চেব রুদ্রোহয়ং যো ভবিষ্যতি।
একং রুপনং ন ভেদোহস্তি ভেদে চ বন্ধনং ভবেৎ।।
তথাপিহ মদীয়ং শিবরুপং সনাতনম।
মুলভুতং সদা প্রোক্তং জ্ঞানমন্তকম।।
অর্থাৎ আমি তুমি ব্রম্ভা এবং রুদ্র নামে যিধি উৎপন্ন হবেন, এই সকলই এক।
শিবের অনেক রুপের মধ্যে তিনি একজন সর্বজ্ঞ যোগী, কৈলাশ পর্বতে তিনি সন্যাসীর জীবন যাপন করেন, আবার গৃহস্থরুপে তিনি পার্বতীর স্বামী অন্যদিকে তিনিই আবার দুষ্টের দমনকারী হিসাবে ভয়ংকররুপে দৈত্যবিনাশী। ওনাকে যোগ, ধ্যান, কলা ও শিল্পের দেবতাও বলা হয়। এছাড়া তিনি কৃষি ও চিকিৎসাবিদ্যারও আবিষ্কারক। ভারতবর্ষ ছাড়াও নেপাল, শ্রীলঙ্কা,বাঙলাদেশ ও পাকিস্তানের কিছু অংশে শিব পুজোর ব্যাপক প্রচলন আছে।
কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন এবং একাধিক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মতে একক মুর্তিতে একিভুত হয়ে শিবের আধুনিক রুপটা দান করেছে। লিব ধর্মের উপাসকদের শৈব বলা হয়। মহারাষ্ট্রে কৃষি ও পশুপালনের দেবতা ছিলেন ‘খান্ডোবা’, প্রধান উপাসনা কেন্দ্র ছিল জেজুরি। খান্ডোবার রুপকল্পটা ছিল ঠিক শিবের মতো। মহেঞ্জোদারো খননকার্য চলার সময় একটা সীলমোহর আবিস্কৃত হয়,তাতে খোদিত চিত্রটা মহাদেবের আদি প্রতিকৃতিরুপে দেখা যায়। ইথিফেলিক জন্তু-জানোয়ার বেষ্টিত মুর্তিটাকে পশুপতি নামে অভিহিত করা হয়। স্যার জন মার্শাল এ ছবিতে হাটু মুড়ে বসা ’যোগ ভঙ্গিমা’ দেখে একেই শিবের আদি রুপ বলে দাবি করেন।
মহাদেবের সাথে বৈদিক দেবতা রুদ্রের অনেক মিল লক্ষ করা যায়। হিন্দু ধর্মের প্রাচিন গ্রন্থ হলো ঋগ্বেদ। ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে যানা যায় তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী ১১০০—১৭০০ খ্রীষ্ট পুর্বাব্দের মধ্যে ঋগ্বেদ গ্রন্থটা রচনা করা হয়। এই গ্রন্থে তাকে মরুৎগধের পিতা বলে উল্লেখ করা আছে, মরুৎগন ছিলেন ঝঞ্জার দেবতাদের একটা গোস্ঠি।
শংকর নামের অর্থ মঙ্গলকারক আনন্দদায়ক, বৈদান্তিক দার্শনিক আদি শংকর তার সন্যাস জীবনে এই নাম ব্যাবহার শংকরাচার্য নামে পরিচিতি পান। দেশী-বিদেশী বহু ঐতিহাসিকগন, পৌরাণিক লেখক, হিন্দু শাস্ত্রের অধ্যয়ন ও গবেষনাকরগন এবং বিশ্বের বেশীরভাগ বা প্রায় সব ধর্মাবলম্বিই একটা ব্যাপারে প্রায় একমত যে সৃষ্টি থেকে ধ্বংস, ভয়ংকর ক্রোধ থেকে দয়া, অগ্নি থেকে জল সবেরই উৎপত্তি মহাদেবের থেকে। সেইজন্য বিভিন্ন লোক তার বিভিন্ন মুর্তি পুজো করেন। হিন্দুশাস্ত্র মতে তিনিই আদি তিনিই অনন্ত, আকার-নিরাকার উভয়ই তিনি, তিনিই নারী তিনিই পুরুষ তাই তাকে দেবাদিদেব মহাদেব এবং তার প্রতীককে শিবলিঙ্গ বলা হয়। শিব কথার ওপর অর্থ হলো “যার মধ্যে প্রলয়ের পর বিশ্ব নিদ্রিত থাকে” এবং লিঙ্গ মানে হলো “বিধ্বংসের পর যেখানে সখ ল সৃষ্ট বস্তু বিলীন হয়ে যায়” তার প্রতীক। মানিয়ার উইলিয়ামস ও ওয়েন্ডি ডনিসার থেকে স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত বিভিন্ন বিশেষজ্ঞগন ও সাধকবৃন্দ শিব মহিমা নিয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। অথর্ববেদ সংহিতা গ্রন্থে যুপস্তম্ভ নামে একপ্রকার বলিদান স্তম্ভের স্তোত্রে প্রথম শিবলিঙ্গ পুজোর কথা জানা যায়।
সুনন্দ মিত্র