জীবনের প্রয়োজনে জৈবকৃষি – উত্তর খুঁজলেন কৃষি বিজ্ঞানী ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
জরুরি জবাবে জৈবকৃষি।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।
স্বচ্ছ ভারত মানে বিষমুক্ত ভারতও বোঝানো হবে?
মৃত্তিকা জননীর অকৃপণ স্তন্যরসে প্রতিপালিত ভৌমকৃষির সামূহিক সম্ভার হল জৈব ফসল বা অর্গানিক ক্রপ। এটিই হল প্রকৃত অর্থে ‘ধরণীর নজরানা’; যার দানে ভরে ওঠে দেবী অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার, দেবী শাকম্ভরীর রকমারী শাকসবজি। এই খাদ্যভান্ডার গড়তে ‘খোদার উপর খোদকারি’-র দরকার নেই। মাটির প্রাকৃতিক খাদ্য ভান্ডারকে ব্যবহার করে যে ফসল উৎপাদিত হয় তাই প্রাকৃতিক শস্য। প্রকৃতি তার সারের যোগানদার, মাটির স্বাভাবিক আর্দ্রতা তাকে রসসিক্ত করে, বৃষ্টির জল তার সেচের চাহিদা মেটায়, অনুখাদ্যের যোগান দিতে সহায়ক হয়ে ওঠে ভৌম জীবাণু-সমষ্টি, আর সর্বোপরি অফুরন্ত সূর্যালোকের সামিপ্য সান্নিধ্য তার সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার সহায়ক হয়ে ওঠে।
নির্মল বসুন্ধরার যা নিয়ত আশীর্বাদ, তারই খাদ্য-সংস্কৃতি হচ্ছে অর্গানিক ফুড। সহজ কথায় নিরাপদ আহার হল অর্গানিক ফুড। কোনও ধরনের কৃত্রিম সার বা রাসায়নিক ব্যবহার না করেই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসল হলো অর্গানিক সবজি ও শস্য। বীজশোধন থেকে শুরু করে ফসলোত্তর প্রক্রিয়াকরণ বা প্রসেসিং এবং ফসল সংরক্ষণে যদি রাসায়নিকের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা যায়, তবেই তৈরি হয় জৈব ফসল।
অর্গানিক সবজি ও শস্য কেন খাবো?
অর্গানিক কৃষিপণ্য পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে এবং সপরিবারে-সবান্ধবে বাঁচতে এবং বাঁচাতে। আমরা দৈনিক খাদ্য গ্রহণ করি কেবল পেট ভরাতে নয়, কেবল পুষ্টি লাভ করতেও নয়, নীরোগ থাকতে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থেকে সাত্ত্বিক জীবন লাভ করতে। রাসায়নিক কৃষি অনুসরণ করে সেই পরিবেশবান্ধব জীবনচর্যা সম্ভব নয়।
রাসায়নিক চাষের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের মতো মারণ রোগ, শিশুদের লিউকোমিয়া, বয়স্ক মানুষের রক্ত ও স্নায়বিক ব্যাধি। বাড়ছে চর্ম রোগের প্রকোপ, টিউমার, জিনগত বৈষম্য, অন্তঃক্ষরা নানান গ্রন্থির সমস্যা। এমন কৃষির প্রয়োজন নেই যেখানে ধরিত্রী বন্ধ্যা হয়ে ওঠে, রং বেরংঙের প্রজাপতি হারিয়ে যায়, কাঠবেড়ালির দেখা দুর্লভ হয়ে পড়ে, নানান মেরুদন্ডী প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়। এমন কৃষি যদি আমরা সত্যিই না চাই তো জৈব কৃষির অভিমুখে পা বাড়াতে হবে, অর্গানিক সবজি ও ফসল ফলিয়ে খেতে হবে এবং খাওয়াতে হবে। আরও যেটা জানানোর তা হলো, একমাত্র অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষেই গাছের প্রয়োজনীয় সমস্ত খাদ্য উপাদান মাটিতেই বজায় থাকে, তাই উৎপাদিত ফসলের পুষ্টিগুণে থাকে সুষমতা। শরীরের জন্য ভিটামিন, মিনারেল, ফাইটো-কেমিক্যাল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের যাবতীয় ভান্ডার, তার সঙ্গে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাটের যাবতীয় যোগান পাবার একমাত্র ভরসা অর্গানিক ফুড।
‘অর্গানিক ফার্মিং’ কী একটি আন্দোলনের নাম?
রাসায়নিক কৃষির মূল সমস্যা হলো কীটনাশক কেবল নির্দিষ্ট কীটটিকেই মেরে ফেলে না, মারে অসংখ্য নির্দোষ জীবকেও। তাদের আবাসস্থলকেও বিষাক্ত করে তোলে। টেকনিক্যালি একে বলা হয় নন-টার্গেট টক্সিসিটি বা লক্ষ্য বহির্ভূত বিষক্রিয়া বা দূষণ। জেনে বা জেনে এইভাবে আমরা রোজ সারা বিশ্বে অগুনতি জীবের মৃত্যু ঘটাচ্ছি অথচ যাদের মরার কথা ছিল না।
জমি-জিরেতে যে কীটঘ্ন ব্যবহার হয় তা ছাপিয়ে চলে যায় বাস্তুতন্ত্রের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কিছুটা হাওয়ার তোড়ে, কিছুটা জলপ্রবাহে, কিছুটা মাটিতে মিশে। এক ক্ষেত থেকে অন্য ক্ষেত, অন্য চারণভূমি, মনুষ্য-বসতি, জলাশয়ে তা অনতিবিলম্বে ছড়িয়ে যায়। সমস্যা বাড়ে যখন কৃষিজীবী মানুষ কীটনাশকের অপব্যবহার করে। নির্ধারিত মাত্রার বেশি হারে তা প্রয়োগ করলে পরিবেশ দূষিত তো হয়ই, তার পরেও দেখা যায় পোকামাকড় ক্রমশ কীটনাশক-সহনশীল হয়ে যাচ্ছে, অনেক নতুন পোকামাকড় যা একসময় তেমন ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত ছিল না, তাও নতুন করে ‘পেস্ট’ এর মান্যতা পাচ্ছে, মাইনর পেস্ট হয়ে যাচ্ছে মেজর পেস্ট। এ এক অভূতপূর্ব সংকট। ভারতবর্ষে চড়াই, দোয়েল, চাক দোয়েল, বুলবুলি, মুনিয়া, টুনটুনি, মৌটুসী পাখি প্রভৃতি হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আগামী দিনে নীরব বসন্ত বুঝি এভাবে আসতে চলেছে।
সাধারণ সবজি ও অর্গানিক শস্যের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
মূল পার্থক্য স্বচ্ছতায়, নির্মলতায় অথবা কলুষতায়। কীটনাশকের প্রভাবে ফসলে প্রকাশ পায় কৃত্রিম ঔজ্জ্বল্য, অনেক সময় আবার ফসলের উজ্জ্বলতা বাড়াতেও রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করা হয়। চোবানো হয় নানান রঙে। অর্গানিক ফসল ক্লেদাক্ত রসায়ন থেকে মুক্ত, প্রকৃতির দানে ভরা ‘খাঞ্চা’। স্বচ্ছ ভারত যদি গড়তে হয় তবে কৃষিক্ষেত্রকে বিষমুক্ত করতে হবে আর এই যুদ্ধ কোন রাজনৈতিক লড়াই নয়, বাঁচবার লড়াই।
জৈবপদ্ধতিতে চাষ করা মানে নানা উপায়ে কীট ও রোগকে এড়িয়ে চলা এবং অপ্রচলিত জৈবিক উপায়ে তাদের দমন করা। সবচেয়ে বড় কথা হলো অর্গানিক ফসলের গুণমানের দিকটি। তাতে ফসলের নির্ধারিত পুষ্টিমান বজায় থাকে। রাসায়নিকভাবে চাষ করা জমিতে নানান খাদ্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়, তার অভাব ও আধিক্য জনিত লক্ষণও প্রকাশিত হয়। তাই সেই ফসলের পুষ্টিগুণ সুষম হতে পারে না। অর্গানিক ফসল বাজার থেকে বাড়িতে আনলে তা ধুলেও বেরোবে না কোন কৃত্রিম রঙ, বেরোবে না কোন তেলের আস্তরণ।
অর্গানিক ফার্মিং-এ কী করবেন আর কী করবেন না?
জৈবচাষে রসায়ন ব্যবহার নিষিদ্ধ। অজৈব সার; রাসায়নিক কীটনাশক, রোগনাশক, মাকড়নাশক, কৃমিনাশক ব্যবহার না করে তার পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করে এবং জৈব পদ্ধতিতে কীটপতঙ্গ, রোগজীবাণু, মাকড় বা মাইট, ফসলের কৃমি বা নিমাটোড দমনের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাই হল জৈব চাষ।
ফসল ফলবে জমিতে, টবের মাটিতে নানান ধরনের জৈব সার প্রয়োগ করে। রোগ পোকার আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে হবে উদ্ভিজ্জ কীটনাশক বা বোটানিক্যাল পেস্টিসাইড ব্যবহার করে, কিংবা জীব-জাত বা জীবাণু কীটনাশক ব্যবহার করে এবং পরজীবী বা পরভোজী বন্ধু পোকাকে শত্রু পোকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।
বাগানের বর্জ্য, গৃহের তরকারির খোসা, মাছের কাটা; মাংসের হাড় ইত্যাদি ব্যবহার করে বাগানেই বানিয়ে নেওয়া যায় কম্পোস্ট সারের ভান্ড। গ্রামের মানুষ গোবর ও গোমূত্র ব্যবহার করে গোবর সার, তরল জৈব সার এবং কেঁচো ব্যবহার করে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার বানিয়ে পুষ্টি বাগানে প্রয়োগ করতে পারেন।
শহরের মানুষ কি অর্গানিক ফসল করতে পারবেন?
শহরের বাড়ির মালিক ছাদে, বারান্দায়, জানালার খাঁচায় জৈব বাগান তৈরি করতে পারেন, এমনকি ফ্লোর মালিকও পারেন তাঁর বারান্দা বা জানালার খোপে টবে, বস্তায় বা বোতলে মাটি রেখে তাতে নানান ফসল ফলাতে। ছাদে সামান্য মাটি ফেলে তাতে লালশাক, কাটোয়া ডাটা, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, মেথিশাক, পাটশাক ইত্যাদি চাষ করে নিতে পারেন। ছাদে বড় টবে মাটি রেখে আম্রপালি, মঞ্জিরা হাইব্রিড আম, বেঁটে জাতের পেয়ারা, ডালিম, করমচা, চেরি, মুসাম্বি, পাতি ও বাতাবি লেবু, সফেদা ইত্যাদি চাষ করে নিতে পারেন কোনরকম কেমিক্যাল ব্যবহার না করে।
Author:
Dr. Kalyan Chakraborti, Professor, Directorate of Research, Bidhan Chandra Krishi Viswavidyalaya (State Agriculture University),Kalyani, Nadia, West Bengal, India. Professor at Kalyani Agriculture University, Former WBAS (administrative) at Department of Agriculture, Government of West Bengal.