ছোটোগল্প – প্রমাণ
হীরক মুখোপাধ্যায়
(১)
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ডোরবেল বাজার পর আস্তে আস্তে দরজা খুলেই চমকে উঠলেন প্রজ্জ্বলের মা। মুখে একরাশ হাসি ফুটিয়ে বললেন, “কতদিন পরে তুই এলি বল তো,”।
“হ্যাঁ মাসিমা, কোরোনার জ্বালায় অনেকদিন আসতে পারিনি,” বলতে বলতে মাসিমার পিছু পিছু একেবারে খাওয়ার ঘরে ঢুকে পড়ল রাজ।
“বোস, বোস আরাম করে চেয়ারে বোস”।
চেয়ারে বসার আগে কোমর নীচু করে মাসিমাকে শুভ বিজয়ার প্রণাম করে হাতে মিষ্টির প্যাকেটটা তুলে দিতেই মাসিমা এবার অনুযোগের ঢঙে মুখ খুললেন, “হ্যাঁরে প্রজ্জ্বলের বউভাতের পর সেই যে গেলি তারপর কী আর ভুলেও একটা ফোন করতে নেই !”
“সত্যি বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে মাসিমা। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, ঘরে এখন আপনার নতুন বৌমা এসেছে, তার সাথে কথা বলতে বলতেই আপনার সময় কেটে যাচ্ছে। তাই ফোন করে আর জ্বালাতন করিনি।”
“তোর মা এখন কেমন আছে ?”
“আর্থারাইটিস নিয়ে আছে একরকম। প্রজ্জ্বল, সুমি ওরা কোথায় মাসিমা, ওদের তো দেখছিনা ?”
“আছে রে বাবা ওরা ওদের ঘরেই আছে। আগে কিছুক্ষণ আমার সাথে কথা বল, তারপর ওদের সাথে দেখা করিস।”
খাওয়ার ঘরের চেয়ার টেবিলে বসে কথায় কথায় অনেকটা সময় কেটে যায় ওদের দুজনের। প্রজ্জ্বলরা তিন ভাই, তিনজনেই বিবাহিত। বেশ কয়েক বছর প্রজ্জ্বলের বাবা মারা গেছেন। কোরোনা অতিমারীর সময় হঠাৎ এক জটিল রোগে মারা যায় প্রজ্জ্বলের বড়োবৌদি। এই বড়োবৌদি মারা যাওয়ার পর থেকেই বাড়িতে সবসময় যেন একটা ঝিম মারা ভাব।
ক্লাস টেনে পড়ার সময় মা’র অকালমৃত্যু দেখে প্রজ্জ্বলের ভাইপোর তো পাগল হওয়ার উপক্রম। পড়াশোনা তো ছেড়ে দেয় আর কি! অনেক কষ্টে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলিয়ে বলিয়ে ওকে একটু সামলানো গেছে। প্রজ্জ্বলের বড়োভাইঝিটা আবার প্রজ্জ্বলকে একটু বেশি ভালোবাসে যদিও প্রজ্জ্বলের সাংসারিক হোদবোধ একটু কম থাকায় ও এসব কিছু বুঝেও যেন বোঝেনা।
বিজয়া উপলক্ষ্যে মাসিমার হাতে বানানো নানান উপাদেয় পদ খেতে খেতে রাজ আচমকাই প্রজ্জ্বলের মা’র কাছে জানতে চাইল, “এবার অন্য কথা থাক, আপনার কথা বলুন।”
“আমার কথা তোকে আর নতুন কী বলব ! তুই তো জানিস তোর বন্ধু আমাকে একদমই সহ্য করতে পারেনা…।”
প্রজ্জ্বল মাসিমাকে খুব একটা পরোয়া করেনা, প্রজ্জ্বলের কাছের বন্ধুরা মোটামুটি সবাই এই কথা জানে। রাজও জানত, কিন্তু ওঁনার কথা বলতে গিয়ে উনি যে পুরনো ঘটনাগুলোই আবার ঝালাতে শুরু করবেন রাজ ঘুণাক্ষরেও তা বুঝতে পারেনি।
তাই ওঁনাকে দ্রুততার সাথে থামিয়ে দিয়ে রাজ আবার জানতে চায়, “আরে ওকথা সবই তো আমি জানি। ওসব ছাড়ুন, বিয়ের পর আপনার মেজোছেলের কী কী পরিবর্তন হলো তাই বলুন তো ?”
“আর বলিসনা বাবা, বকে বকে জ্বালিয়ে মারল একেবারে।”
“সেকি বলছেন মাসিমা !” অবাক হয়ে জানতে চায় রাজ।
“তাহলে আর বলছি কী রে…।”
“কেনো ও কী অতো বকছে আজকাল ?”
” এক কথা কানের কাছে হাজার বার করে বলবে, আর বলিস না…।”
মাসিমার কথা শুনতে শুনতে রাজও মনে মনে ভাবতে লাগে ঠিকই তো প্রজ্জ্বল এখন ফোন করলে ওর নিজেরই ভয়ঙ্কর রকমের বিরক্ত লাগে। খালি এককথা বারংবার কানের গোড়ায় ঘ্যানর ঘ্যানর করে বলে যাবে। এইজন্য প্রজ্জ্বল এখন ফোন করলে মাঝে মাঝে রাজের মাথাটা গরম হয়ে ওঠে।
রাজের মনে পড়ে গেল, প্রজ্জ্বল আর রাজের কমন ফ্রেণ্ড প্রদীপ্ত-র সাথে এই বিষয়ে কথা হওয়ার সময় প্রদীপ্তই রাজকে বলেছিল, “ও ফোন করলে আমি লাউড মোডে মোবাইল রেখে অন্য কাজ করি, মাঝে মাঝে শুধু হুঁ হুঁ করি। কিন্তু প্রায় কিছুই কানে নিইনা। আরে বাবা যা বলার একবার বল বলে ফোন রাখ তা না..!”
কথায় কথায় রাজও সেদিন বলে ফেলেছিল, ‘নিজে সবসময় বলে বেড়ায় ফোন একটা জরুরী পরিষেবা, এই ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করা উচিত নয়; এদিকে নিজেই ফোন ধরলে দুঘণ্টার আগে ছাড়তে চায় না।’
“কবে থেকে এসব হল বলুন তো ?” কৌতূহলের সাথে জানতে চায় রাজ।
“কবে থেকে আবার… বিয়ের পর বউয়ের পাল্লায় পড়ে ও একেবারে গোল্লায় গেছে।”
“যাহ্ বকে মরছে প্রজ্জ্বল, এতে বাপ মরা মেয়ে সুমির দোষ কোথায় ? একথা শুনলে মনে মনে ও কষ্ট পাবেনা !”
“দ্যাখ, তোদের মতো আমি কথায় কথায় যার তার জয়গান গাই না। দোষীর দোষের কথা আমি সবার সামনে মুখের উপর বলি।”
“এসব বলতে নেই মাসিমা, সংসারে অশান্তি হবে..!”
“ধুর তুই ছাড় তো ওসব কথা।” বিরক্তি আর হতাশা একযোগে ঝরে পড়ল মাসিমার কথায়।
“তা আপনার নতুন বৌমার বিষয়ে আপনি যে এসব অভিযোগ আনছেন তার কোনো ভিত্তি আছে কী ?”
“ভিত্তি না প্রমাণ চাইছিস আগে সেটা বল ?” রাজের কাছেই পাল্টা জানতে চায় প্রজ্জ্বলের মা।
“প্রমাণ থাকলে তো ভালোই..,” অপ্রস্তুত গলায় মিন মিন করে বলে রাজ।
“আমি সবই বুঝি রে রাজ। তুই তো আবার লেখালিখি করিস, খবরের কাগজে খবর আকারে যা বার করতে পারিস না, সেগুলোই গল্প আকারে মানুষকে গেলাস। তা তোর হাতেও তো কিছু প্রমাণ থাকা দরকার। তাই না…,
সুমিই যে প্রজ্জ্বলের বারোটা বাজাচ্ছে চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখতে চাস ?” এবার বেশ তীর্যক খোঁচা মেরেই জানতে চায় মাসিমা।
“দেখাতে পারবেন ?” হাসি হাসি মুখে জানতে চায় রাজ।
“অবশ্যই,” বলে রাজকে চেয়ার থেকে উঠতে ইশারা করে নিজেও চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন মাসিমা।
(২)
রাজকে নিয়ে মাসিমা এসে দাঁড়ালেন পাশের ঘরের একটা খোলা জানালার ধারে। ওই জানালাটা দিয়ে প্রজ্জ্বল আর সুমি-র ঘরের অনেকটাই বেশ ভালোভাবে দেখা যায়।
“উঁ…নে দেখ এবার,” চোখের ইশারায় রাজকে জানলায় চোখ রাখতে বলেন মাসিমা।
“আপনি পাগল! এভাবে কেউ বিয়েওয়ালা কারো ঘরে নজর দেয়। কোথা থেকে কী দেখে বসব; ওসব আমার পোষায় না। চলুন খাওয়ার ঘরেই যাই।” মাসিমার পাগলামি দেখে স্পষ্টতই বিরক্ত হল রাজ।
“ওরে বাবা! সুমি তো আমার ঘরেরই বউ, আমি তো ওর শাশুড়ি তাইনা.., তুই ভাবলি কী করে ওকে আমি নিজেই বিব্রত করব ?” রাজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জানতে চান মাসিমা।
“আপনি যেভাবে আপনার বউমার ঘরের দিকে তাকাতে বলছেন ওটা আদৌ শোভন নয়।”
“শোনো ছেলের কথা… মাসিমাকে অপবাদ দেওয়ার আগে জানলাটা কোনদিক দিয়ে খোলে বা বন্ধ হয় সেটা তো আগে দেখ!”
মাসিমার ধমকানিতে হুঁশ ফিরল রাজের। ও ভালো করে তাকিয়ে দেখল, জানালাটা প্রজ্জ্বলের ঘর থেকেই খুলতে এবং বন্ধ করতে হয়।
ও হেসে মাসিমার দিকে তাকাতে মাসিমা বললেন, “তোরা ওকে যতটা সরল ভাবিস ও ততটা সরল নয় রে। ঘরে ‘ইউ’ মার্কা সিন চললে জানালাটা হাট করে খোলা থাকে। ‘এ’ মার্কা সিন চললে জানালার পর্দা পড়ে যায় আর…”
মাসিমাকে থামিয়ে দিয়ে রাজ হাসতে হাসতে বলে, “বুঝেছি তখন জানালাটাও ভেতর থেকে আটকানো থাকে।”
“আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ এসে দেখ বাঁদর..।”
মাসিমার তাড়ায় জানালাতে চোখ রাখতেই রাজ দেখতে পেল বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছে সুমি। মাত্র ক’বছর হল বিয়ে হয়েছে সুমি আর প্রজ্জ্বলের। সুমি-র গায়ে এখনো নতুন বউ নতুন বউ গন্ধ।
মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে সুমি ঢাকল, “এই শুনছ ?”
এ ঘর থেকে রাজ আর মাসিমা দেখলেন ডাকা মাত্রই বাধ্য স্বামীর মতো বউয়ের সামনে উপস্থিত হল প্রজ্জ্বল।
“এই শোনো.., দ্যাখো রান্নাঘরে একটা বাটিতে ঠাণ্ডা ফ্যান আর তার পাশে প্লাস্টিকের ঝুড়িতে আনাজের খোসাগুলো রয়েছে। ফ্যানটা নিয়ে গিয়ে লাউ গাছটার গোড়ায় আস্তে আস্তে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে গোল করে ঢেলে দেবে। একটুও যেন বাইরে না চলে যায় বুঝেছ, আর আনাজের খোসাগুলো সার জমানোর গর্তয় ফেলে এসো।”
সুমি-র কথা শুনে প্রজ্জ্বল হতভম্ব তোতলাতে থাকে,” আ..আ..আমি ?”
“হ্যাঁ গো হ্যাঁ তুমি।”
“যাহ্ কী বলছ !”
“আশ্চর্য তুমি জানো না, ‘নির্মল বিদ্যালয় অভিযান’-এর মাধ্যমে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে বিদ্যালয়ের প্রাত্যহিক ময়লা পরিস্কার করতে হয়।”
“কিন্তু এটা তো স্কুল নয়..?” আমতা আমতা করে বলে প্রজ্জ্বল।
“আহ! অবাধ্যতা আমার সহ্য হয়না তা তুমি জাননা ?”
জানালা ওপারে প্রজ্জ্বলের ঘাড় কাত করা দেখে রাজ বুঝতে পারল প্রজ্জ্বলকে এরই মধ্যে বেশ ভালোভাবেই শিক্ষা দিয়েছে কোলকাতার কোনো এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সফলতম শিক্ষিকা সুমি।
সুমি প্রজ্জ্বলের কাছে জানতে চায়, “আমি তোমাকে কি টাস্ক দিলাম একবার বলো দেখি সোনা ?”
রাজ আর মাসিমা এ ঘর থেকে দেখলেন বাধ্য ছাত্রের মতো প্রজ্জ্বল কড় গুনে গুনে বলছে, “বাটির ঠাণ্ডা ফ্যান বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে লাউগাছের গোড়ায় ঢালতে হবে, আর সারগাদার গর্তে আনাজের খোসাগুলো ফেলতে হবে।”
“এই তো সব বুঝে গেছে আমার বাবু। যাও চট করে ফেলে এসো দেখি।” মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়ে প্রজ্জ্বলকে কাজে নামতে ইশারা করল সুমি।
রাজ মাসিমার দিকে তাকাতে মাসিমা চোখ মেরে বলল, “আর একটু দেখ, আরো অনেক কিছু দেখতে পাবি!”
মাসিমার অঙ্গভঙ্গি দেখে লজ্জায় দুচোখে হাত দিয়ে ফিক ফিক করে হাসতে শুরু করল রাজ। এভাবে রাজ কতক্ষণ হেসেছিল ভগবান জানে, হঠাৎ সজাগ হল সুমির গলা পেয়ে।
“কী হল এখনো হয়নি, তাড়াতাড়ি নাও আরো কিছু কাজ বাকি আছে তো!”
বাইরে থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল “হয়ে গেছে, যাচ্ছি দাঁড়াও।”
রাজ দেখতে পেল কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ঘরে ঢুকে এল প্রজ্জ্বল। প্রজ্জ্বলকে দেখতে পেয়ে সুমি জানতে চাইল, “কাজটা করেছ ?”
প্রজ্জ্বল ঘাড় নেড়ে বলল, “হুঁ, কিন্তু কী মশা গো ওদিকটায়, যা কামড়েছেনা দ্যাখো কী রকম ফুলিয়ে দিয়েছে।”
মোবাইল থেকে চোখ না তুলে মুখে একটা হালকা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে সুমি বলল, “গুড, কিন্তু কীভাবে করলে একবার বলো ?”
এ ঘর থেকে মাসিমার পাশে দাঁড়িয়ে রাজ শুনল, “রান্নাঘর থেকে ফ্যানভর্তি বাটি নিয়ে বাইরে গিয়ে ফ্যানটা ধীরে ধীরে লাউগাছের চারধারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলার পর আনাজের খোসাগুলো সারগাদার গর্তের ভেতর ফেলেছি।”
“বাহ, আমার সোনা ডার্লিং.., এবার চট করে ঘরটা ফুলঝাড়ু দিয়ে একবার ঝাঁট দিয়ে ফেলতো…।”
“না আমি বলছিলাম ওটা পরে করব, এখন একটু..” আবদারের সুরে বলে উঠল প্রজ্জ্বল।
“না এখন ওসব একদম নয়, ওরকম করলে রাতে কিন্তু..”
মাসিমার পাশে দাঁড়িয়ে ও ঘরের ঘটনাগুলো চোখের সামনে দেখতে দেখতে রাজ মনে মনে ওর সাথে প্রজ্জ্বলের ফোনে হওয়া কথোপকথনগুলো ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে রাজ বুঝতে পারল, প্রজ্জ্বলের এককথা বারংবার বলার বদভ্যাসটা বোধহয় সুমি-রই সার্থক শিক্ষাদানের ফল।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বোঝাবার জন্য এক কথা বারবার বলার যে অভ্যাসটা ট্রেনিং প্রিয়োর্ডে সুমি রপ্ত করেছিল, সেই পদ্ধতিটা বিদ্যালয়ের বাইরে বৈবাহিক জীবনে প্রয়োগ করার ফলে সবসময় বকবকম্ করে চলেছে প্রজ্জ্বল।
সুমি-র ফলবতী শিক্ষার গুণের ভারে একইসাথে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রজ্জ্বলের পরিবারের সদস্য আর কাছের বন্ধুরা। একসাথে জ্বলে পুড়ে মরছে প্রজ্জ্বল আর সুমি-র শুভাকাঙ্ক্ষীগণ। আর এরই জন্য মাসিমার রোষানলে পড়ে গেছে সুমি।
জানালার গরাদ ধরে রাজ যখন এসব কথা ভাবছে তখন কানের কাছে ফিসফিস করে মাসিমা জানতে চাইলেন, “আমার কথাগুলো বিশ্বাস করার জন্য তোর আর কোনো হাতেগরম প্রমাণ চাই ?”