পথের ভিখারী

0
862
Who is Beggar ?
Who is Beggar ?
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:32 Minute, 21 Second

(গল্প হলেও সত্যি)

পথের ভিখারী

হীরক মুখোপাধ্যায়,কলকাতা

“আপনার নাম কী, কতদিন এভাবে ভিক্ষা করছেন, রোজ কত টাকা আয় হয় ?” দক্ষিণেশ্বর জগদীশ্বরী (ভবতারিণী) কালী মন্দির সংলগ্ন ফেরিঘাটের চাতালে দাঁড়িয়ে এক ভিক্ষুকের কাছে জানতে চাইলেন সৌমি।

এক বিশেষ রঙের পোশাক পরে সৌমি ও সৌমি-র মতো আরো কয়েকজন তরুণ-তরুণী ভিখারীদের কাছে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে চলেছেন।
দূর থেকে এসবই দেখভাল করছিলেন এই কর্মকাণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক রাজশেখর মুখোপাধ্যায়।

হঠাৎ রাজশেখরবাবুর মনে হল কেউ যেন ওঁনার কাঁধে আলতো করে হাত ছোঁয়ালেন। কৌতূহলবশতঃ রাজশেখরবাবু “কে ?” বলে পেছন ফিরে দেখতে পেলেন সাদা দাড়িগোঁফওয়ালা গেরুয়া বস্ত্র পরা এক লম্বা চওড়া ব্যক্তি তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন।
ওঁনার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুখার্জীবাবু চিনতে পারলেন গৈরিক বসনধারী ব্যক্তিকে। চিনতে পেরেই দুহাত জোড় করে মহারাজকে সম্মান জানালেন।

মহারাজ রাজশেখরবাবুর কাছে সহাস্যবদনে জানতে চাইলেন, “পড়ন্ত বিকেলে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো ?”
“ভিখারী খুঁজছি।”
“মানে ?”
“আর বলবেন না, দেশে এই মুহুর্তে প্রকৃত ভিখারীর সংখ্যা কতো এই তথ্য জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে ভারত সরকার, আর তারই ফলশ্রুতি রূপে উত্তর ২৪ পরগনায় শুরু হয়েছে ‘ভিক্ষুকসুমারী’-র পাইলট প্রজেক্টের কাজ। এই কর্মকাণ্ডে আমাকেই আবার নোডাল অফিসার ও জেলার মুখ্য সমন্বয় আধিকারিক-এর দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছে, তাই দলবল নিয়ে ভিখারী খুঁজতে হচ্ছে।

এই কর্মকাণ্ডের আজ প্রথম দিন, তাই ভাবলাম মা’র মুখ দেখেই কাজটা শুরু করি..।”
“তুমি পারো বটে…এখানে প্রকৃত ভিখারী কোথায় ?”
“কী বলছেন আপনি ! এরা প্রকৃত ভিখারী নয় ?” অবাক হয়ে জানতে চাইলেন রাজশেখরবাবু।
“না নয়। কোনো মতেই নয়। এরা গরীব হতে পারে কিন্তু ভিখারী নয়। ভিখারীর সন্ধান পেতে হলে তোমাকে অন্য কোথাও যেতে হবে।”
“সেকি ! ওদের কোথায় খুঁজব …?”
“আমি অনেক সফিস্টিকেটেড ভিখারীর সন্ধান জানি। চলো আমার সাথে, আমি ওদের চিনিয়ে দিচ্ছি।”

মহারাজ-এর আহ্বানে মুখার্জীবাবু মনে মনে মা’কে স্মরণ করে ওখানকার সমস্ত কাজ বন্ধ করে দলবল নিয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রাঙ্গণ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

(২)
সন্ধ্যা আসন্ন, শীতের হালকা আমেজকে গায়ে মেখে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কার পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে বিএসএফ-এর ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টারকে পাশে রেখে ধীর গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলল রথতলা মোড়ের দিকে।

রথতলা মোড়ে এমনিতেই সব সময় জটলা পেকে থাকে। ওখান থেকে কোনোরকমে নিষ্কৃতি পেয়ে বাম দিক ঘুরে ধীরে ধীরে সাবলীল হল গাড়ির গতি।
চালকের পাশে বসেছেন মহারাজ। গাড়ি গতি বাড়াতেই মহারাজকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য মুখার্জীবাবু বললেন, “এঁনার সাথে পরিচয় করে নাও, এঁনার বর্তমান নাম স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজ। বীরভূমে ছিল পৈতৃক ভদ্রাসন। পূর্বাশ্রমে ইনি আরক্ষা বিভাগের পদস্থ আধিকারিক ছিলেন। তখন থেকেই আমার সাথে আলাপ। অবসর নেওয়ার কিছুদিন পরেই স্ত্রী বিয়োগ ঘটায় উনি সর্বস্ব ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তার পর থেকে ইনি পথকেই আপন করেছেন।”

ডানপাশ দিয়ে গাঁ গাঁ করে একের পর এক গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। এই গাড়িও মোটামুটি ছুটছিল, হঠাৎই ধীরে ধীরে গাড়ির বেগ কমতে কমতে একেবারে থেমে গেল।
গাড়ি থামতেই বিরক্ত গলায় মুখার্জীবাবু চালকের কাছে জানতে চাইলেন “এখানে আবার কী হল ?”

চালকের জবাব আসার আগেই সামনে থেকে হাসতে হাসতে জ্ঞানদানন্দ বললেন, “ভিখারীদের উৎপাতে এখানে পথচলা দায়। পারের কড়ি না দিয়ে এদের হাত থেকে ভগবানও যে ছাড় পায়না।”

মহারাজের কথা শুনে গাড়ির ভেতর থেকে সবাই বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন হালকা আকাশী সহ বিভিন্ন রঙের পোশাক পরা বেশ কিছু লোক লাঠি হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যানশাসন-এর ছুতোয় রাস্তায় চলাচলকারী প্রত্যেকটা গাড়ি থেকে টাকা নিচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে শুরু করে শববাহী যান কেউই এদের হাত থেকে ছাড় পাচ্ছেনা।

রাস্তার উপর জুলুমবাজি দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে মুখার্জীবাবু জানতে চাইলেন, “এখন তো কোনো পুজো নেই, এঁরা কারা ?”
“এঁরা হলেন মূলতঃ সিভিক ভলান্টিয়ার, তবে এদের সাথে রয়েছেন বারাকপুর পুলিস কমিশনারেটের বিভিন্ন বর্গের বিভিন্ন পদের পুলিস কর্মচারী। এঁদের মধ্যে পি সি পার্টির লোকও আছে ।”

জ্ঞানদানন্দের কথা শেষ হতেই অবাক হয়ে সৌমি জানতে চায় “এরা সবাই কী পিসির দলের লোক !”

“নো মাই ডিয়ার সুইট হার্ট ! তুমি যা ভাবছ তা নয়।এঁরা হলেন পুলিসের প্লেন ক্লথ উইংস। যাদের অনেকে সাদা পোশাকের পুলিস বলে চিনে থাকে। এদের মূল কাজ হল সাধারণ পোশাকে মানুষের সাথে মিশে থেকে মানুষের মনের ভেতরের কথা জেনে সরকারকে সচেতন করা বা চোর ডাকাত ধরতে সহায়তা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দ্যাখো, আইনশৃঙ্খলার পিণ্ডি চটকে বাবুরা নিজেরাই কেমন তোলা তুলছেন।”

“যাচ্চলে এরা ডাকাতদের সম্পর্কে বিভাগীয় আধিকারিকদের নতুন আর কী বার্তা দেবে, নিজেরাই তো সংঘবদ্ধ হয়ে ডাকাতি করছে !” বাইরের দিকে একপলক দৃষ্টিক্ষেপ করে রীতিমত বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন মুখার্জীবাবু।

“মহারাজ এঁদের কেউ কিছু বলেন না ?” অবাক হয়ে জানতে চায় সৌমি।
“পথের ভিখারীদের সঙ্গে কে আর মুখ লাগাবে বলো, তাই এদের সেভাবে কেউ কিছু বলেনা।”
“না না আমি বলছি কোনো পদস্থ কর্মকর্তা বা নেতা-মন্ত্রী সবকিছু জেনেও কেউ কিছু বলেন না কেন ?” আবার জানতে চায় সৌমি।
সৌমির ঘ্যানঘ্যানানি প্রশ্ন থেকে বাঁচতে জ্ঞানদানন্দ তাঁর ঘন গোঁফদাড়ির জঙ্গলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন “ওহ লাভলি…।”

একটা সরকারী কাজ পাবার পরেও নানান প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসছে বলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীগুলোর ভালোই খোঁজ রাখে সৌমি। তাই জ্ঞানদানন্দের উত্তর দেওয়ার ভঙ্গি দেখে হেসে উঠল ও।

ওরা যখন নিজেদের মধ্যে এসব কথা বলছে, তখন পথের ভিখারীদের গণ্ডির ভেতর থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে আবার গাড়ির গতি বাড়াল চালক।
ওদের গাড়িটা বিনা বাঁধায় বেরিয়ে আসতেই গাড়ির পেছন দিকে বসা একজন তরুণ জানতে চাইলেন, “মহারাজ আপনি সবসময় পুলিসদের নামে এত খারাপ খারাপ অভিযোগ করেন কেন, কই আমাদের এই গাড়ি থেকে একটা টাকা না নিয়েই তো ওরা আমাদের ছেড়ে দিল !”

কথাগুলো কানে যেতেই মহারাজ পেছন ফিরে ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে কপট গাম্ভীর্যের সাথে জানতে চাইলেন, “তুমি কী বিষয় নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিলে ভাই, একটু বলবে ?”
“আর্টস নিয়ে কেনো ?”
“ওইজন্যই এখনো চোখকান ফোটেনি,” বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে বললেন জ্ঞানদানন্দ।
“বুঝলাম না !” এবার বেশ রাগত স্বরেই আওয়াজ ভেসে এলো গাড়ির পেছন থেকে।
“তা বুঝবে কেনো…, একটা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও তোমার নেই দেখছি! আরে বাবা, তুমি যে গাড়িতে বসে আছ সেটা নীলবাতি লাগানো একটা সরকারী গাড়ি। গাড়ির সামনে হুটার লাগান আছে। এইরকম গাড়ি কেউ আটকায় নাকি !”

“ওসব কথা থাক, এই পথের ভিখারীদের বিষয়ে আরো কিছু বলুন শুনি,” জ্ঞানদানন্দের মানভঞ্জনের জন্য অনুরোধ করলেন মুখার্জীবাবু।
“তাহলে শোনো….., এরা যে শুধু রাস্তাতেই গাড়ি আটকে টাকা তোলে সেটাই একমাত্র সত্যি নয়। কারো বাড়িতে ডাকাতি বা খুন কিংবা ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর কেউ থানায় অভিযোগ করতে এলেও ‘রোজ অত পথ ঘোরার জন্য সরকার পেট্রল বা ডিজেলের পয়সা দেয়না,’ জাতীয় নানা বাহানা তুলে পীড়িত পরিবারের থেকেও তদন্তে যাওয়ার খরচা তুলতে সিদ্ধহস্ত এই হাড়হাভাতে ভিখারীরা।”
“সে কী !” মহারাজের কথায় আঁতকে উঠলেন মুখার্জীবাবু।

(৩)
গাড়ি এগিয়ে চলেছে বারাকপুর থানার দিকে, ভেতরে জ্ঞানবর্ষণ করে চলেছেন স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজ।

“জীবনে অন্য সবার মতো তুমি বা তোমরা অনেকেই হয়তো এমন অনেক গরীব মানুষ দেখেছো, যাঁরা অভাবে পড়ে পেটের তাগিদে হয়তো আঁস্তাকুড় থেকেও ফেলে দেওয়া খাবার তুলে খেতে বাধ্য হয়; কিন্তু মাসে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকার বেশি মাইনে পাওয়া কোন সরকারী কর্মচারীকে মৃতদেহের পকেট মারতে দেখেছ ?”
“অ্যাঁ… !” মহারাজের কথা শুনে আঁতকে উঠল গাড়ির সবাই।
“এ আবার কবেকার ঘটনা, আগে কখনো বলেননি তো ?” অবাক হয়ে জানতে চাইলেন রাজশেখর মুখার্জী।

“বামজমানার শেষদিকে আমার অবসর নেওয়ার কিছু আগে একদিন বিধাননগর থেকে সাদা ধোপদুরস্ত জামা প্যান্ট পরা সদা মিথ্যালাপী এক মন্ত্রীকে পথ দেখিয়ে বারাসাতের জেলা প্রশাসনিক ভবনে নিয়ে যাওয়ার সময়, হঠাৎ মধ্যমগ্রামের কাছে দেখতে পাই দেবাদিদেব মণ্ডল নামের এক পুলিস সড়ক দুর্ঘটনার শিকার এক শবের শরীর থেকে খুলে নিচ্ছে সোনার হার, আংটি। এটুকু চোখে পড়তে না পড়তেই আমাদের গাড়ি ঝড়ের বেগে দেবাদিদেবকে টপকে সামনে এগিয়ে যায়। আমি পেছন ফিরে দেখি হার, আংটি পকেটে পুরে দেবাদিদেব মৃতের পকেট হাঁতড়াচ্ছে ….।”

মহারাজ যখন কথা বলছেন তখন তাঁকে আবার কথার মাঝে থামিয়ে পেছন থেকে ওই তরুণ বলে উঠলেন, “কী আশ্চর্য ! এগুলোই তো পুলিসের কাজ।”
ওর কথা কানে যেতেই জ্ঞানদানন্দ এবার মুচকি হেসে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। রাস্তার উপর বা বাড়ির বাইরে কেউ আহত বা নিহত হলে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি বা পদস্থ কর্তাদের উপস্থিতিতে আহত বা নিহতদের শরীর থেকে গহনা বা টাকার ব্যাগ সরিয়ে সাময়িকভাবে নিজেদের হেপাজতে নেওয়াটা পুলিসের কাজ বটে। কিন্তু, ওইদিন চলন্ত গাড়ি থেকে ওয়ারলেস ম্যাসাজ মারফত বারাসাত থানাকে ঘটনার বিষয়বস্তু জানাতে ওরা আমাদের জানিয়েছিল- ‘মধ্যমগ্রাম ফাঁড়িতে খবর দিচ্ছি,’ সুতরাং সেদিনই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম ওই পুলিস আধিকারিক নিজেই ইচ্ছায় মরদেহের পকেটমারী করছে।”

“কী যাতা… এরকম আবার হয় নাকি !” চোখ গোল করে অবাক হয়ে জানতে চায় সৌমি।

“তা নয়তো কী ! এই পথের ভিখারীরা সামনে থাকলে তুমি গু-এর উপর একটা কয়েন ফেলে পেছন ঘোরার আগেই দেখবে কয়েন উধাও..।”
“আপনি ছাড়া এই ঘটনার আর অন্য কেউ সাক্ষী আছে ?” পরম কৌতূহলে জানতে চাইলেন মুখার্জীবাবু।
“নেই আবার! সেই দিন মন্ত্রীর কনভয়ের পাইলটের দায়িত্বে ছিল একজন ড্রাইভার। তখন ও বারাসাত থানার ভেতরের কোয়ার্টারে বউ আর দুই মেয়েকে নিয়ে থাকত। এখন ওর নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, শান্ত বা সুশান্ত কিছু একটা হবে। অসম্ভব জোরে গাড়ি চালাত ও। আমার পাশে বসে গাড়ি চালাতে চালাতে ঘটনাটা ও নিজেও দেখেছিল।”

“দাদা, ওই জাত ভিখারীকে কোথায় পাব বলুন না, কাল সকালেই ওর নামটা তাহলে খাতায় তুলে নেব,” হাসতে হাসতে জানতে চাইলেন মুখার্জীবাবু।
“ওর জন্য তোমাকে হন্যে হয়ে ঘুরতে হবেনা। বারাসাত থেকে বসিরহাটের মাঝে যতগুলো মন্দির আছে ওদিকে একটু নজর দিলেই ওঁনাকে খুঁজে পাবে।”
“আরে ওদিকে তো বেশ কয়েকটা মন্দির আছে। বললেন যখন, তখন পুরো ঠিকানাটাই বলুন..,” আবদার ঝরে পড়ল মুখার্জীবাবুর গলায়।
“এইটুকু খুঁজতেই হাঁপিয়ে যাবে ?
অবশ্য না পারলে আর কী করবে, ওদিককার লোকনাথ মন্দিরের দিকেই নয় শুধু নজর রাখো। তাহলেই শ্রীমান দেবাদিদেব ভোলামহেশ্বর-এর দর্শন পেয়ে যাবে।”

“এ ঘটনার কথা উপরওয়ালারা পরে কেউ শোনেননি ?” জানতে চায় সৌমি।
“সবাই সব কিছু জানে। কোন দেবতা কোন ফুলে তুষ্ট সেটা দেবাদিদেব নিজেও ভালোই জানে। তাই অতিসহজেই উপরওয়ালাদের তুষ্ট করেই তো আঠারোটা বছর শুধু বারাসাত আর মধ্যমগ্রাম করে কাটিয়ে দিল দেবাদিদেব।”
” উপরওয়ালাদের কোন ফুলে তুষ্ট করেন দেবাদিদেব ?” কৌতূহলী হয়ে জানতে চান মুখার্জীবাবু।
“তুমি বড়ো ত্যাঁদড়, এসেছিলে অতি সাধারণ ভিখারী খুঁজতে, আমি বিত্তশালী সফিস্টিকেটেড ভিখারীদের চিনিয়ে দিচ্ছি তাতে হচ্ছে না, আবার নতুন আবদার…!”
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার মুখ খুললেন স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজ। “মধ্যমগ্রামের ওদিকে মাকড়সাপুকুর বলে একটা জায়গা আছে। একসময় ওখানকার এক বাগানবাড়িতে নিত্য মজলিস বসাতো দেবাদিদেব আর পবনদেব। ওই মজলিসে উপরওয়ালারা হাজির হলে খানাপিনার পর কিছু বারবণিতাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হতো উপরওয়ালাদের খাস কামরায়।

আর এতেই খুশি হয়ে উপরওয়ালারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেবাদিদেবকে বারাসাতে নয় মধ্যমগ্রাম থানায় রেখে দিত।”
“এই পবনদেব-টা আবার কে ?” জানতে চায় সৌমি।

“বামজমানায় ও পুলিসের এক নেতা ছিল। এখন যেখানে বারাসাত জেলার এসপি-র অফিস, এক সময় ওর পেছন দিকের এক কোয়ার্টারে থাকত পবনদেব।
লোকটা যেমন ধড়িবাজ, তেমনই অসৎ। সবকিছু নষ্টামির মধ্যে থাকবে, অথচ ধরার আগেই হাওয়া। আর ধরবেটাইবা কে ! উপরওয়ালারা সবাই যে পবনদেব আর মহাদেবের বসানো মধুচক্রের নিয়মিত খরিদ্দার ছিল।”

“গায়ে গৈরিকপোশাক তুলেছেন বলেই কী মুখ দিয়ে যা নয় তাই বলবেন…!” এবার ঝাঁঝালো গলায় বিরক্তি প্রকাশ করলেন গাড়ির পেছনে বসা তরুণ।
“তুমি নেহাতই অবোধ বালক, শুনে রাখো ছোকড়া- এই জেলায় যত পাপাচার হচ্ছে তার সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত এই পথের ভিখারীরা।”
স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজ-এর তর্জন গর্জন-এর মধ্যে গাড়ি পৌঁছে গেল বারাকপুর থানার সামনে।

(৪)
বারাকপুর থানার সামনে গাড়ি পৌঁছতেই স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজ বললেন, “যাও স্বচক্ষেই দেখে নাও জাত ভিখারীদের কার্যকলাপ।”
থানার একদিকে রয়েছে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ সহ অন্যান্য আধিকারিকদের কক্ষ। থানার বিভিন্ন কক্ষে দৈনন্দিন কাজ চলছে। আস্তে আস্তে সবাই এগিয়ে গেল একটা দরজার দিকে।
ভেতরে তখন জনৈক আধিকারিক একজনকে চমকাচ্ছেন, “ভজাকে দানা খাওয়াতে তোকে কে বলেছিল বে ?”
“স্যার, যা বাওয়াল করছিল না, মাথা ঠিক রাখতে পারিনি…।”
“এখন আমি কী করব বল ?”
“স্যার, বারাকপুর রেল স্টেশনের সামনে যে ভিখারীগুলো সামনে থালা পেতে রাস্তায় বসে রোজ সকাল সন্ধ্যা সমস্যা তৈরী করে তাদের মধ্যে থেকে যে কোনো একটাকে আমার জায়গায় তুলে নিন।
চিন্তা করবেন না, অন্য বারের মতো এবারও আপনাদের পেট ভরিয়ে দেবো।”
“আরে পাগল, নতুন সিপি এসেছে না.. এবার অত সহজ হবে না রে।”
“ভাও বাড়াবেন না তো…, আজ রাতে কোনো একটাকে তুলে চালান দিন আমি এখন চললুম।”

কিছুক্ষণ কান পাততে শোনা গেল, আর এক আধিকারিক কাউকে বলছেন, “বাড়ি কোথায় ?”
“গাঁজা গলি।”
“দিন দু’হাজার টাকা।”
“পাশপোর্ট ভেরিফিকেশন করতে টাকা দেব কেন ?”
“আপনি কোথাকার হরিদাস হে ! কাজ কী এমনি এমনি হয় ! একহাতে টাকা ঢালবেন অন্য হাতে কাজ নেবেন..।”
“ঘুস আমি কিছুতেই দেবনা…।”
“ঘুষ দিতে হবে না, আপনি দেশের বাইরে ঘুরতে যাবেন আর আমাদের একটু মিষ্টি খাবার টাকা দেবেন না ; সে কি রকম কথা মশাই ! এরকম করতে নেই। ধর্মে সইবে না ভাই পাপ হবে। তার থেকে তাড়াতাড়ি টাকা বার করুন।”

“নেকস্ট নেকস্ট…” চড়া গলায় হয়তো অন্য কাউকে ডাকলেন আর এক আধিকারিক।
“কী নাম আপনার ?”
“রাধা চৌবে।”
“আপনার কী বিষয় ?”
“স্যার, চাকরির ভেরিফিকেশনটা তো এখনো করলেন না।”
“ওহ, আপনার তো ক্যালকাটা পুলিস তাই না ?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“কিন্তু আপনার বাড়ির লোকেদের তো আগেই বলেছি দশ হাজার টাকা লাগবে। এনেছেন ? আনলে দিয়ে যান। আগামীকাল সকালে ফাইল ছেড়ে দেবো।”
“স্যার, আমি তো আপনাদেরই লোক হত চলেছি, আমাকেও দিতে হবে ?”
“কী আশ্চর্য ! আপনি আমাদের লোক হবেন কেনো ? আপনি কোলকাতা পুলিসে ঢুকতে চলেছেন, আমরা ব্যারাকপুর পুলিসে আছি। আলাদা আলাদা কমিশনারেট।
আরে ঘাবাড়াচ্ছেন কেনো, বড়োবাজার থানায় পোস্টিং পেলে দেখবেন দিনের শেষে আপনি নিজেই হয়তো ত্রিশ হাজার টাকা পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ি ফিরবেন।”
“কিন্তু স্যার!”
“কোনো কিন্তু নয়, দিবে আর নিবের প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং এখান থেকেই শুরু করুন।
গুষ্টির খুনি, ডাকাত, ধর্ষকগুলো এখনই আসতে শুরু করবে। এখন এখানে বসে থাকলে ওদের মুখ থেকে বেরনো মদের গন্ধে আপনার বমি এসে যাবে। তার থেকে এখন যান, কাল সকালে পজিটিভলি টাকা নিয়ে আসবেন।”

থানার ভেতরে গান্ধীজীর হাসাহাসি মুখের ছবির তলায় বসে আধিকারিকদের নির্লজ্জের মতো হাত পাততে দেখে চুপচাপ মাথা নীচু করে বাইরে বেরিয়ে এলেন মুখার্জীবাবু সহ সকলে।

(৫)
দক্ষিণেশ্বর থেকে শুরু করে বারাকপুর থানা দূরত্বটা খুব বেশি না হলেও ভিখারীদের নানান কর্মকাণ্ড হাঁপ ধরিয়ে দিয়েছিল গাড়ির প্রায় সকলকেই। তার উপর অনেক আগেই ছুটির সময় হয়ে গেছে, তাই গাড়ির যাত্রীরা প্রায় সবাই গাড়িতে না উঠে যে যার বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন।

একজনকে নামাতে হবে দমদম জংশন স্টেশনে, তাই গাড়ি আবার উল্টো পথে ছোটা শুরু করল। গাড়ি যত এগোয় রাতের আঁধারে পথের ভিখারীদের তাণ্ডব চোখের সামনে আরো বেশি করে ফুটে উঠতে থাকে।
বারাকপুর পুলিস কমিশনারেট ছেড়ে বিধাননগর পুলিস কমিশনারেট অঞ্চলে গাড়ি ঢুকে পড়লেও ভিখারীদের ভিক্ষাবৃত্তির কোনোরকম কার্পণ্য চোখে পড়ল না।
দমদম জংশন স্টেশনের নীচে একজনকে নামিয়ে ধীর গতিতে গাড়ি এগোতে লাগল নাগের বাজারের দিকে। নাগের বাজারে ঢোকার অনেক আগে থেকেই শুরু হলো তীব্র যানজট।
“কী বুঝছো ?”

অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর আবার মুখ খুললেন স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজ।
“এরকম যানজট হলে কখন যে বাড়ি পৌঁছাবো,” আক্ষেপ ঝরে পড়ল সৌমি-র গলায়।
“ম্যাডাম আপনি তো মুখ্যমন্ত্রীকে অনেকবার ‘ম্যান মেড ফ্লাড’-এর কথা বলতে শুনেছেন, কিন্তু আমি যদি বলি এগুলো সবই ‘পুলিস মেড ট্রাফিক জ্যাম’ তাহলে কী বিশ্বাস করবেন ?”
“কীরকম ?” আগ্রহের সাথে জানতে চাইলেন মুখার্জীবাবু।
“শোনো তাহলে, প্রথমতঃ, যানশাসন-এর ‘য’ না জানা কোনো সিভিক বা অন্য পুলিস কর্মচারীদের দিয়ে যদি যানশাসন করানো হয়, তাহলে কর্মীর অজ্ঞতার কারণে যানজট তো বাড়বেই।
দ্বিতীয়তঃ, অসৎ উপায় অবলম্বনে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে পুলিস কর্মচারীদের রোজগারের প্রবণতা এই যানজটগুলো সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।”
এক জায়গায় অনেকক্ষণ আটকে থাকার পর ধীরে ধীরে শামুকের গতিতে নাগেরবাজার মোড় পার করে বারাসাতে যাওয়ার জন্য গাড়ি বামদিকে ঘুরল।

(৬)
ভারত থেকে সরাসরি বাংলাদেশ ঢোকার যতগুলো রাস্তা আছে তারমধ্যে অন্যতম প্রধান এই যশোর রোড। সেই দিক দিয়ে দেখলে এই রাস্তাকে আন্তর্জাতিক রাজমার্গ বলা যেতেই পারে।

দমদম বিমানবন্দরকে ডানদিকে রেখে সোজা এগিয়ে গিয়ে বারাসাতের ডাকবাংলো মোড় থেকে অধুনা ১২ নম্বর (সাবেক ৩৪ নম্বর) জাতীয় রাজ মার্গ ধরে যেমন উত্তরবঙ্গের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়, তেমনি ডাকবাংলো মোড় হয়ে অধুনা ১১২ নম্বর (সাবেক ৩৫ নম্বর) জাতীয় রাজমার্গ ধরে বনগাঁর পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে খুব সহজেই বাংলাদেশে চলে যাওয়া যায়।

বারাসাত ডাকবাংলো মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরে কিছুটা এগিয়ে চাঁপাডলি মোড়ে পৌঁছে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে যায়। এখান থেকে ১১২ নম্বর জাতীয় রাজমার্গ ধরে যেমন বনগাঁ হয়ে যেমন বাংলাদেশ পৌঁছনো যায়, ঠিক তেমনি রাজ্য সড়ক ২ ধরে বসিরহাট পৌঁছে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়েও বাংলাদেশে যাওয়া যায়।

উল্টোভাবে বললে, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দুটো ভিন্ন পথ চাঁপাডলি মোড়ে এসে একসাথে মিশে এগিয়ে চলে কোলকাতার দিকে।
অন্যদিকে উত্তরবঙ্গ থেকে কোলকাতা আসতে গেলেও যতগুলো রাস্তা আছে তারমধ্যে ১২ নম্বর জাতীয় রাজ মার্গ অন্যতম। এই পথ ডাকবাংলো মোড়ে এসে ১১২ নম্বর জাতীয় রাজমার্গকে স্পর্শ করে কোলকাতার হয়ে বকখালির দিকে এগিয়ে চলে।
দিনরাত এই পথ ধরেই চলছে পণ্যবাহী যানবাহন।পণ্যবাহী যানবাহনগুলো অতিরিক্ত মুনাফার লোভে সবসময়ই হয় অত্যধিক ওজন নিয়ে চলাফেরা করে, নয় বিভিন্ন অনৈতিক তথা অবৈধ কারবারের সাথে যুক্ত থাকে। তাই এই যানবাহনগুলোর থেকে অবৈধভাবে রোজগারের জন্য মুখিয়ে থাকে বিভিন্ন থানাগুলোও।

তাই নাগেরবাজার ছেড়ে দমদম বিমানবন্দরের এক নম্বর গেট হয়ে বিরাটি মোড়ের দিকে এগোতে বা ফিরতে গেলে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়।
সেই পথেই অতি ধীরে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। বিরাটি মোড় ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লো গাড়ি।

“যত্তসব এখানে আবার কী হলো ?” বিরক্তিতে গরগর করতে করতে জানতে চাইলেন মুখার্জীবাবু।
“কী আবার হবে, ভিখারীদের রাতের কালেকশন শুরু হয়েছে।”
“মানে ?” চোখ কপালে তুলে জানতে চায় সৌমি।
“গাড়ি এখান থেকে এগোতে অনেক সময় নেবে। গাড়িতে চুপচাপ বসে না থেকে নীচে নেমে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে-র নীচে কী হচ্ছে নিজেদের চোখে আগে দেখে তো এসো, নইলে আমাকে বকে মরতে হবে।”

স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজ-এর অনুরোধে গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা এগিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে-র নীচে পৌঁছতেই চোখ কপালে উঠল সৌমি আর মুখার্জীবাবুর।
ওঁরা দেখতে পেলেন গার্ডরেল দিয়ে রাস্তা আটকে প্রত্যেকটা পণ্যবাহী যান থামিয়ে থামিয়ে প্রথমে কিছু একটা দেখতে চাইছে পুলিস কর্মচারীরা। পণ্যবাহী গাড়িগুলোর চালকেরা সেই জিনিস দেখাতে পারলে ছাড় পাচ্ছে, দেখাতে না পারলে রাস্তার ধারে ওইসব গাড়িগুলো সার বেঁধে দাঁড় করানো হচ্ছে।
অনেকক্ষণ এসব দেখে গাড়িতে ফিরে এলেন সৌমি আর মুখার্জীবাবু।

“কী দেখলে ?”
সৌমি অল্প কথায় সব কিছু জানবার পর স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজ হাসতে হাসতে বলা শুরু করলেন, “যে সমস্ত পণ্যবাহী গাড়ির মালিক বা চালক পুলিসের সাথে মাসিক বন্দোবস্তে যায় বা আগাম অর্থ প্রদান করে, নিদর্শন স্বরূপ তাদের হাতে একধরনের ছবিওয়ালা কার্ড তুলে দেয় স্থানীয় থানাগুলো।
এইসব নাকাবন্দীর সময় পণ্যবাহী যানবাহনগুলো আটকে পুলিস আগে ওই কার্ডগুলোই দেখতে চায়। চালকেরা দেখাতে পারলে তৎক্ষনাত ছেড়ে দেওয়া হয়, নইলে যতক্ষণ টাকা না পায় ততক্ষণ যানবাহন তল্লাশির নামে লোক দেখানো নাটক করতে থাকে পুলিস কর্মচারীরা।”
“এই রাস্তায় তো কত থানা, সব থানাই কী এভাবে অবৈধভাবে টাকা তোলে ?”
“অবশ্যই। এমনি কি আর বলেছি ‘পুলিস মেড ট্রাফিক জ্যাম’।”

চোখের সামনে নানা পরিধানের পথের ভিখারীদের ভিক্ষাবৃত্তির নমুনা চাক্ষুষ করতে গাড়ি গার্ডরেল অতিক্রম করে এগিয়ে চলল বারাসাতের দিকে। চালকের পাশে বসে নিজের দুধসাদা গোঁফদাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে আক্ষেপের সুরে স্বামী জ্ঞানদানন্দ মহারাজ বিড়বিড় করলেন,”এরা পুলিস না পথের ভিখারী তা একমাত্র ভগবানই জানে। কিন্তু কষ্ট লাগে তখন যখন একজন সত্যিকারের সৎ পুলিশও এদের কারণে চোর বদনাম কেনে। আজও কিন্তু কিছু সৎ পুলিশ আছেন। তাই সাধু আর ধান্ধাবাজ একই আসনে আজ। সবাই পথের ভিখারী। “

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here