ছোটোগল্প – হাস্নুহানা
হীরক মুখোপাধ্যায়
🌷
মাস ছয়েক হলো সন্দীপ এ পাড়ায় এসেছে। এখনো প্রতিবেশীদের সঙ্গে সেভাবে মেলামেশা করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই হয়নি ওর। পাড়ার সামনের দিকে পাঁচতলা যে নতুন আবাসন হয়েছে, তার দোতলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকে সন্দীপ চ্যাটার্জি।
এলাকার সবাই সন্দীপ-কে ‘আয়রন মার্চেন্ট’ বলেই চেনে। সন্দীপ বা ওর চোদ্দপুরুষ কোনোদিন লোহার ব্যবসা না করলেও এই অঞ্চলে আজকাল এটাই সন্দীপের বড়ো পরিচয় হয়ে উঠেছে।
তবে এলাকার লোক যতই ওকে ‘আয়রন মার্চেন্ট’ বলে টিজ করুক, আসলে আন্তঃরাজ্য থেকে প্রকাশিত নামজাদা প্রভাতী দৈনিক পত্রিকার এক ডেকোহেঁকো সাংবাদিক এই সন্দীপ চ্যাটার্জি। অচেনা লোকেরা ওকে সন্দীপবাবু বা সন্দীপদা বলে ডাকলেও, ওর চেনা গণ্ডিতে স্যান্ডি নামেই ও বেশি পরিচিত।
সন্দীপ অবিবাহিত। বেশ সুদর্শন সুপুরুষ, মাইনেও কম নয় ; অনায়াসেই বিয়েটা করে ফেলতে পারে। কিন্তু ওর নিজেরই যেন এবিষযে কোনো হেলদোল নেই।
নিজের বিয়ে নিয়ে চরম ঔদাসীন্যের জন্য ওর সিনিয়র বা ইয়ারদোস্তরা মাঝেমধ্যেই কবি মুকুট সেনশর্মা-র পঙক্তি ধার করে ওকে টিপ্পনী কেটে বলে, “বুড়ো ভাম আর কবে, খাটিয়া খাড়া হবে যবে !”
কিন্তু সেসব কথা গায়ে না মেখে ও হাসতে হাসতে বলে,” প্রমাণ পেলে আমি যেকোনো মুখ্যমন্ত্রী বা দেশের রাষ্ট্রপতিকেও বছরভর আইনজীবীদের পেছনে ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার মতো সবেগে ছোটাতে পারি, কিন্তু নিজের বিয়ে করা বউয়ের হাতের উদ্ধত বেলুনের সামনে কোনো অবস্থাতেই আমি কালঘাম বার করে ছুটতে রাজি নই। আরে ভাই সারাদিন ভয়ের চোটে আমিই যদি ছুটে বেড়াই, তাহলে অন্য লোকেদের ছোটাবো কখন ?”
অনেক সাংবাদিক আছে যাঁরা হয়তো আপস নীতিতে বেশি বিশ্বাসী, কিন্তু এই ক’দিনের মধ্যেই এ পাড়ার বেশিরভাগ লোক জেনে গেছে পুলিস হোক রাজনীতিবিদ কারো কাছে কোনো অবস্থাতেই হাত পাততে রাজি নয় সন্দীপ।
ওর কাজের পদ্ধতিটা যেনো পুরো আলাদা – পাড়ার কিছু উঠতি ছোকরা ক্লাবের নামে মস্তানি করছে তো ওদের পেছনে ‘আলপিন ফোটাও’, চোরের উপদ্রবে গৃহস্থদের গৃহশূণ্য হচ্ছে তো পুলিসের পেছনে ‘পেরেক গোঁজো’, স্থানীয় বিধায়ক বা সাংসদ রাজনৈতিক দলকে ঢাল বানিয়ে একশো দিনের টাকা হাপিস করছে তো ওদের পেছনে সরাসরি ‘গজাল’ ঢুকিয়ে দাও।
এলাকায় অকাতরে আলপিন থেকে গজাল পরিবেশনের জেরে জেরবার হয়ে অনেকেই আজকাল ওর অবর্তমানে ওকে ‘আয়রন মার্চেন্ট’ বলে উপহাস করেন। তবে সন্দীপ চট করে চটে না, ও শুধু হেসে বলে, “শুনতে অসম্মানজনক মনে হলেও এই মন্তব্যগুলোই আসলে আমার কাজের সেরার সেরা স্বীকৃতি, একটা উপাধি।”
সন্দীপ এ পাড়ায় এসেই শুনেছিল ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’-টা এখানে বেশ ধুমধাম করে পালন করা হয়। অনুষ্ঠান সম্পর্কে সেরকম বিশেষ কোনো আগ্রহ না থাকলেও সন্দীপ তখন থেকেই মুখিয়ে ছিলো শুধুমাত্র একটা ফার্স্টপেজ কভার স্টোরির জন্য।
১৩ ফেব্রুয়ারী মাঝরাতের কিছু আগে সন্দীপ-এর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। সন্দীপ দেখতে পেলো পাড়ার এক অতি বিশিষ্ট সমাজসেবী নেপাল চন্দ ওরফে ন্যাপলা ওকে ফোন করছে। থানার বড়োবাবুর কাছ থেকে সন্দীপ কিছুদিন আগেই শুনেছে, “ন্যাপলা আগে ওয়াগন ভাঙত। পরে ওই লাইনে ঝামেলা বেরে যেতে ওই ধান্দা ছেড়ে এখন জলাভূমি ভরাটের খেলায় মেতেছে ন্যাপলা। ব্যাঙ্কে ভালো টাকা থাকার পাশাপাশি আদালতে একটা অপহরণ আর দুটো ধর্ষণ-এর মামলাও আছে ন্যাপলা-র নামে।”
ফোনটা রিসিভ করতেই ওপ্রান্ত থেকে কথা শোনা গেলো, “এখনো ঘরে বসে কী করছেন দাদা, এখনই মাঠে চলে আসুন। সব ফার্স্ট হ্যাণ্ড মালেরা এসে গেছে…।”
ফোন পাওয়া মাত্রই ঘর থেকে বার হয়ে দরজায় তালা দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সন্দীপ এসে দাঁড়ায় স্থানীয় ‘মিসাইল ক্লাব’-এর মাঠে।
মাঠে পৌঁছে সন্দীপ দেখতে পেলো এরই মধ্যে মাঠটা বেশ ভরে উঠেছে। একদিকে যুবক যুবতীরা জোড়ায় জোড়ায় দাঁড়িয়ে তো অন্যদিকে বেশ কিছু যুবক যুবতী আলাদা আলাদা ভাবে দাঁড়িয়ে।
মাঠের দুদিকে উঠতি যুবক যুবতীদের দুভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কৌতূহল বশতঃ সন্দীপ ন্যাপলা-র হাত ধরে মাঠের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে জানতে চায়, “এভাবে ওরা আলাদা আলাদা দাঁড়িয়ে কেনো ?”
সন্দীপ-এর প্রশ্ন শুনে ন্যাপলা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ খ্যাঁ খ্যাঁ করে হেসে বলল, “এটাও বুঝলেন না দাদা, আপনি যে কী.. ! আরে একটা গ্রুপের সবাই আগে থেকেই সেটেল্ড, আর অন্য গ্রুপটা আপনার মতো.., মানে এখনো কাউকে জোটাতে পারেনি।”
ন্যাপলা-র কথা শেষ হওয়ার পর, সন্দীপ একলা একলা দাঁড়িয়ে থাকা যুবক যুবতীদের মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে মাঠটা ঘুরে দেখছিল। এভাবে মাঠটা ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা মেয়ের দিকে চোখ যেতেই ওর বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। ধমনীতে ধমনীতে জোরে রক্ত ছুটতে শুরু করলো।
মেয়েটা মাঠেরই একপাশে দাঁড়িয়ে ‘শেল’ ফাটানো দেখছিল। চারদিকে হাজার লোকের কোলাহলের মাঝেও মেয়েটার প্রাণোচ্ছল মূর্তি চোখে পড়তেই পলকহীনভাবে মেয়েটার আলগা সৌন্দর্য বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে লাগল সন্দীপ।
মাঠের বাঁশের খুঁটিতে দড়ি দিয়ে বাঁধা মাইক দিয়ে তখন তারস্বরে ভেসে আসছে, ‘রাশি রাশি ভালোবাসা ছিল মনে লুকিয়ে আমার..’।
কী গান বাজছে সেদিকে সন্দীপের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই, ও তখন দুচোখ ভরে দেখছে এক অচেনা-অজানা-অদেখা মেয়ের শারীরিক সৌন্দর্য, মেয়েটা দেখছে নক্ষত্রলোকের বুকে শেলের বিস্ফোরণজনিত রোশনাই।
🌷🌷
মাঠ থেকে ঘরে ফিরে রাতে ঘুমোতে পারল না সন্দীপ। সারা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে ও ভাবতে লাগলো – কে এই মেয়ে, কোথায় থাকে, কত দূর পড়েছে, চাকরি করে, এনগেজড নাকি এখনো আমার মতোই সিঙ্গেল !?
মেয়েটার প্রতি কৌতূহল যত বাড়তে লাগে, ততই এক কূহকী মাদকতায় আচ্ছন্ন হতে থাকে সন্দীপ। রাত যত বাড়তে লাগে সন্দীপ যেন ততই মোহগ্রস্ত হতে থাকে। অনাস্বাদিত পূর্ব এক ঘোরের মধ্যে ধীরে ধীরে ঢুকে যায় সন্দীপ।
রাত ভোর যে মেয়ে তাকে এভাবে আচ্ছন্ন করে রাখল তার সাথে কী ১৪ ফেব্রুয়ারী একটু দেখা হবে না ! ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’-তে কী একটু চোখাচোখি হতে পারেনা মেয়েটার সাথে।
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সন্দীপ একটু বেলার দিকে হাজির হলো মিসাইল ক্লাব প্রাঙ্গণের সামনে।
এদিক ওদিক বিক্ষিপ্তভাবে তাকাতেই ওর নজরে এলো গতকালের দেখা মেয়েটাও কখন যেন ওরই মতো পায়ে পায়ে মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে।
মেয়েটাকে ওভাবে একলা দেখে সন্দীপ মনে মনে ভাবলো, ‘আজ যেভাবেই হোক মেয়েটার সাথে একবার কথা বলতেই হবে, এনগেজড না থাকলে প্রথম বারেই প্রোপোজ করে দেবো।’
সন্দীপ মনে মনে বেশ একটা খুশির রেশ নিয়ে এগোতে লাগল মেয়েটার দিকে। মেয়েটার প্রায় সামনে পৌঁছে সবে মেয়েটার সাথে কথা বলতে যাবে, এমন সময় কে যেনো পেছন থেকে সন্দীপের পিঠে হাত দিলো।
বিরক্ত সন্দীপ পেছনে ফিরতেই দেখতে পেলো, ন্যাপলা ওর পেছনে এসে পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সন্দীপ জানতে চায়, “কিছু বলবে ?”
সন্দীপের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ওই মেয়েটার দিকে ইঙ্গিত করে ন্যাপলা বলে উঠলো, “দাদা পরিচয় করুন, এ হলো আমার গিন্নি – হাস্নুহানা।”
কথাটা কানে ঢোকা মাত্র সন্দীপ যেন আকাশ থেকে পড়লো। সন্দীপ মনে মনে ভাবতে লাগলো, হায় ভগবান, এ তোমার কী অপরূপ মায়ার ছলনা। সারা রাত তোমার যে সৃষ্টি তার রূপে গুণে আমাকে মোহাবিষ্ট করে রাখলো, সকাল হতে না হতেই কোন যাদুবলে সে নিজেকে সম্পূর্ণ রিক্ত করলো !
হাস্নুহানা-র মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ হাসি হাসি মুখে চেয়ে, সন্দীপ জানতে চাইল, “ও তোমার বউ… বলো কী ন্যাপলা ?”
“হ্যাঁ, দাদা।”
“তোমার বউ যখন, তখন রাতে অবিবাহিত অন্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে ও দাঁড়িয়ে ছিল কেনো ?” জানতে চায় সন্দীপ।
প্রশ্নটা কানে যেতেই, হাস্নুহানা-র একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে ন্যাপলা বলল, “বুঝলেন না দাদা ! আমার সাথে বিয়ের পরেও ওর নিজের আকর্ষণী ক্ষমতা এখনো কীরকম রয়েছে… ; সেটা হাতেকলমে বোঝার জন্যই ও গতকাল সিঙ্গেলদের দলে দাঁড়িয়েছিল।”
“বলছো বউ, অথচ ওর সিঁথিতে সিঁদুর নেই ; ব্যাপার কী ভাই ?” হাসতে হাসতে জানতে চায় সন্দীপ।
“না, না, ওসব কিছু নয় ! সিঁথিতে সিঁদুর দিলেই ওর সিঁথি চুলকোয়, আর তার পরেই সিঁথির দুপাশ থেকে চুল ঝরতে শুরু করে তাই..,” কথাগুলো বলতে বলতে ক্যাবলার মতো হাসতে থাকে ন্যাপলা।
সন্দীপ ন্যাপলা-র সাথে কথা চালিয়ে গেলেও ও একভাবে তাকিয়ে ছিল হাস্নুহানা-র মুখের দিকে। হাস্নুহানা-র দিকে ওভাবে তাকাতে তাকাতে একসময় সন্দীপের মনে হলো, এক অচেনা পরপুরুষের সামনে বিবাহিত স্বামীর মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে এই ধরনের মূল্যায়ন নিজেরই কানে শুনতে শুনতে যেন বোঁটা খসা ফুলের মতো লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে হাস্নুহানা।
বিব্রত হাস্নুহানা-কে স্বাভাবিক করার জন্যই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সন্দীপ হাসতে হাসতে বলল, “যাই বলো না কেনো, না বুঝেই হয়তো বাবা মা তোমার সার্থক নামকরণ করেছে হাস্নুহানা…।”