আজ আমরা সবাই লেজকাটা
অমিত গোস্বামী
ধরা পড়ল লেজকাটা। তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল তার সাম্রাজ্য। অর্থগৃধ্নু চরিত্র উন্মোচিত হল। উন্মোচিত হল তার কামিনীযোগ। এমন কি প্রশ্ন উঠল পিএইচডি’র গবেষণাপত্রটি নিয়েও। দায় ঝেড়ে ফেলল তার দল স্রেফ ধুলো ঝাড়ার মত। ছয় দিন সময় নিল তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে। কেন? কারন বাকি পাপীদের পর্বতপ্রমান অর্থ ভান্ডার ইডির নাগালের বাইরে নিতে সময় লাগে। প্রথম ঝটকায় ইডি যা উদ্ধার করেছে যথেষ্ট। কিন্তু বাকিটা? চাপ আছে। দলনেত্রী তার মত বৃদ্ধ বেড়ালকে দরজাপার করে দিতে যথেষ্ঠ বিষন্ন ছিলেন। কিন্তু তরুণ ব্রিগেড? কুনাল, দেবাংশু ও আরো তৃণমূলের তরুণরা এই কুমরো পটাশীয় দুস্কর্মের ভার বইতে রাজী ছিলেন না। এরা প্রেসার সৃষ্টি করলেন ভাইপো নেতার ওপর। ফলে কাৰ্য্যকালে সমুৎপন্নে লেজকাটা আউট। প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই তরুনরা কি খুব সৎ? যে তারা সততার পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছেন? পরিস্কার বলি যে দেবাংশুর বিরুদ্ধে বা বাকি তরুণদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আঙুল না উঠলেও তাদের নেতার বিরুদ্ধে উঠেছে। প্রমাণিত নয়। বাকিটা আইনের হাতে। কিন্তু তাদের নেতা যে ক্রমে দলটিকে ক্রমাগত কর্পোরেট স্টাইলে চালাতে চাইছেন, তা স্পষ্ট। তাদের গণআন্দোলন থেকে উঠে আসা নেত্রীর স্টাইলে নয়। কিন্তু অন্য রাজ্যে ব্যর্থ হচ্ছেন প্রতিবারে। তবুও চেষ্টা করছেন। টাকার বন্যা বইছে। কিন্তু সাফল্য দূরস্ত।
Amit Goswami
তাদের দল কোন নীতি বা আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দল নয়। স্রেফ বাম বিরোধিতা করে ও তখনকার কিছু বুদ্ধিজীবিদের আত্মপ্রচারের সুযোগ দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এই বুদ্ধিজীবিদের ক্রমেই কুক্ষিগত করে নিল তারা নানা উপঢৌকন ও দানের বিনিময়ে। সংবাদ মাধ্যমকে কিনে নিল বিজ্ঞাপনের টোপে। বিরোধী কন্ঠরোধ করা হল মামলা মোকদ্দমায়। শুরু হল দলের তানা শাহী। পুলিশ বিভাগ পরিণত হল আজ্ঞাবহ দাসে। কাজেই বাতাবরন তৈরি। শিল্পহীন বঙ্গে শুরু হল নতুন শিল্প তা হল তোলা শিল্প ও শ্রী প্রকল্প। বাঙালি ভয় পেতে শুরু করল। যে বাঙালি কলকাতায় এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে রাস্তায় ঝাঁপিয়েছিল। ট্রাম পুড়িয়েছিল। গুলি খেয়েছিল। লাল বাংলাকে লালে লাল করেছিল। তারপরেও যারা নেত্রীর নেতৃত্বে কাঁপিয়েছিল গোটা কলকাতা। তার ক্রমে ক্রোধ ভুলে গেল। ভুলে গেল ঘৃণা। তারা প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিল মীম ও সোশাল মিডিয়ার রসিকতাকে। বাংলায় কায়েম হল মাকড়শা শিল্প। জাল বিস্তার করল বাংলা জুড়ে। পরিস্কার নিদান এল যে যা কামাচ্ছ তার ২৫% তুমি রাখো, ৭৫% দলকে দাও। ভাগেযোগে খাও। কাজেই মিশন ও ভিশন প্রস্তুত।
এবার স্ট্র্যাটেজি তৈরির পালা। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর স্টাইলে প্রতি ধাপে ভাগ। কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায়, ধারের টাকায় শুরু হল মেলা, খেলার মচ্ছব। ক্রমেই দেনায় ডুবল পশ্চিমবঙ্গ। পাশের রাজ্য উড়িষ্যা যেখানে পূর্বের দেনা পরিশোধ করে নিজেদের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল করে কেন্দ্রকে বলল -দান চাই না, পশ্চিমবঙ্গ তখন লোলুপজিহ্বা প্রদর্শণ করে একদিকে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিল, অন্যদিকে আমফানের টাকায় উঠল রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সুরম্য অট্টালিকা। আদালত কত দেখবে? যেখানে বিচার বিভাগে বিচারকের সংখ্যাও সীমাবদ্ধ। এই নজরদারি করার প্রয়োজন ছিল জনগনের, সংবাদপত্রের ও সুশীল সমাজের।
জনগন ভীত, সংবাদপত্র ও সুশীল সমাজ বিক্রিত। আর বিরোধী দল ? তারা তো আরো সরেস। ভোটের আগে বানের জলকে স্বাগত জানালো। নো ঝাড়াই বাছাই। পুরোন লড়াকুরা পাত্তা পেল না। তুমুল সংখ্যালঘু বিদ্বেষের প্রচার করল। যা হওয়ার তাই হল। হাওয়া। আরে, সংখ্যালঘুদের সবাই কি তাদের মন্দ ভাবে? তাহলে উত্তর প্রদেশে জেতে কিভাবে? তা হেরে গিয়েও চৈতন্য হল না। একা নন্দী রক্ষা করে নকল বুঁদির গড়। বাকিরা শিক্ষা কেলেংকারি ইস্যুতে একটা মিছিল করল ছয়দিন পরে। ভাবুন তো দুই তিন দশক আগের কথা বা তারও আগের। আসলে ক্ষমতার পিঠেভাগের সময় বাঁদরদের অভাব হয় না। কিন্তু নে, লড়ে খা, বললেই বিপ্লবীরা হাওয়া। তাহলে কি হবে? কিচ্ছু হবে না। যা ছিল তাই থাকবে। লেজকাটা থাকবে জেলে, আপাতত কিছু বিদ্রোহী শিক্ষকপদ প্রত্যাশীরা চাকরি পাবে। কিন্তু কেঁচে গন্ডুষের সম্ভাবনা খুব কম।
সিস্টেম সরকারকে চালাবে ? মনে হয় না। বরং সরকার সিস্টেমকে চালাবে। অতি লোভে না হয় তাঁতী কেস খায়, কিন্তু বলুন তো, দুর্নীতি তো ঘুঘুর বাসা গেড়ে আছে সব ক্ষেত্রে। ইডি, তাও অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের চাপে নাহয় শিক্ষার দুর্নীতি ধরেছে। কিন্তু আপনি? আমি? আমরাও তো শরিক এই দুর্নীতির। শিক্ষকরা বদলি হওয়ার জন্যে টাকা দেন নি? বুকে হাত দিয়ে বলুন। ব্যবসায়ীরা কি চুরির চালগম কিনে বাজারে বেচেন নি?
সাংবাদিকরা কি বলেন নি এই খবর করা যাবে না, তাহলে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবে? বিরোধী দল কি কালীপুজোয় উৎসাহ দেখিয়ে প্রথম টাকা উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ মিছিল বার করতে গড়িমসি করেন নি? আমরা কি সরকারের ত্রুটি নিয়ে কথা বলতে ভয় পাই নি? মনে করুন রবীন্দ্রনাথের সে পাঠ ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।‘ তাহলে ঘৃণা শুধু লেজকাটার প্রাপ্য? আমাদের নয়? কারন আজ আমরা সবাই লেজকাটা।