ফারুক আহমেদ
সামনে ২০২১ বিধানসভার নির্বাচন পশ্চিমবাংলায় এবার নির্বাচন হোক রক্তপাতহীন। হিংসা, খুন, জখম ঘৃণার রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে বাংলা মুক্তি পাক। শান্তিতে অবাদ নির্বাচন হোক। গণতান্ত্রিক সরকার গড়তে বাংলার মানুষের রায় মেনে নিক সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। বাংলা পথ দেখতে পারে ভারতকে। মুর্শিদাবাদ জেলা সহ বাংলার তেইশটা জেলায় রাজনৈতিক খুনোখুনি বন্ধ করতে সাধারণ মানুষকেই সচেতন হতে হবে। বিগত নির্বাচনের বছরগুলোতে দেখা গেছে জেলাগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সাধারণ মানুষ নিজেদের মধ্যে মারামারি করে লাশের লাইন লাগিয়ে দেয়। এবার একটু শান্তিতে নির্বাচন হোক। প্রশাসনের কাছে আবেদন শান্তিতে নির্বাচন করতে সঠিক উদ্যোগ নিয়ে নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করতে এগিয়ে আসুন।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সংখ্যালঘুদের মধ্যে মুসলমানদের করুণ চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে দিন দিন। বিভেদকামী শক্তি জাতপাতের রেষারেষিটা মনুষ্য সমাজে বাড়িয়ে দিয়ে দেশকে বিপদে চালিত করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। এই অবস্থার নিরসনে এগিয়ে আসছেন সচেতন নাগরিকদের বড় অংশ।
বিভেদমূলক নীতির ফলে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের গনতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে দিনের পর দিন। ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি অশুভ শক্তি যেভাবে বিদ্বেষ প্রকাশ করছে তাতে ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটছে এবং তা পবিত্র ভারত ভূমিতে চরমভাবে আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে। সংবিধানকে রক্ষা করতেই হবে।
ভারতের কল্যাণে মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। বৈষম্য দূর করতেই হবে। সাধারণ মানুষকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে সাহস জুগিয়ে দেশ স্বাধীন করতে ভারতীয় আর্য-অনার্যদের সঙ্গে মুসলমানরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশ স্বাধীন করেছে।
মনে রাখতে হবে ভারতের গনতান্ত্রিক সরকারের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা রেখেই দেশ ভাগের পরও ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন তাদের বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যান নি। ভারতের মাটিকে আগলে রেখেছেন বুকের মধ্যে। ভারতের গনতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা করতে মুসলমানরা জোটবদ্ধভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রেখেছেন এবং অপূর্ব নিদর্শন আজও উপহার দিচ্ছেন দেশবাসীকে।
ভারত একদিন আবারও পৃথিবীকে আলো দেবে। বিভাজন সৃষ্টি করে ভারতীয় আত্মাকে পৃথক করা যাবে না।
আমরা জানি এবং ভারতীয় হিসেবে গর্বিত হই, এটা জেনে বিশ্বে সর্বোত্তম ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ভারতীয় নাগরিকদের বড় অংশ।
স্বাধীন ভারতের ৭৩ বছর পরেও মুসলমানদের মধ্যে আর্থিক ও সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া ঘরের ছেলেমেয়েরা বহু সংগ্রাম করে কিছু সংখ্যক উচ্চশিক্ষা নিতে এগিয়ে আসছে। এ বিষয়ে কিছু মিশন স্কুলের অবদান উল্লেখযোগ্য। মুসলিমদের পরিচালিত ট্রাস্ট ও সোসাইটির নিজস্ব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার ফলে বহু ছাত্রছাত্রী আর্থিক অনটনে উচ্চশিক্ষা অর্জনে বহু বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বেশি। রাজ্য সরকার এ বাধা দূর করার জন্য কোনও সরকারি প্রকল্প এখনও গ্রহণ করেনি। পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন বিত্তনিগম থেকে কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে ঋণ দেওয়া হয়, তার বিনিময়ে সরকারি চাকুরিরত গ্রান্টার বাধ্যতামূলক করায় বিপদ বেড়েছে। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকুরিরত মুসলমাদের সংখ্যা খুবই নগন্য, কোথাও আবার শতকরা একজনও নেই। তাহলে সরকারি চাকুরিরত গ্রান্টার পাওয়া যাবে কোথায়? একদিকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা নিতে চাইলেও অর্থের অভাবে তা তারা নিতে পারছে না। অন্যদিকে চাকুরিরত মুসলমানের সংখ্যা জনসংখ্যার (৩০%) শতাংশের অনুপাতে খুবই কম। তাহলে এই বৈষম্য ঘুচবে কি ভাবে? মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের দাবি, তারা মুসলমানদের উন্নয়নে প্রবলভাবে আন্তরিক। সভা সমাবেশ ও সমিতিতে এই দাবি জোর কদমে বলে চলেছেন শাসক দলের নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রীরা। এই মতো পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি— সরকারের পক্ষ থেকে এই সব দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষ ফান্ডের ব্যবস্থা করা হোক অথবা পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন বিত্তনিগম থেকে গ্রান্টারমুক্ত লোন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। আমরা অনুদান চাইছি না উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারের কাছ থেকে পিছিয়েপড়াদের জন্য শুধু মাত্র লোন চাইছি। পিছিয়েপড়াদের তুলে আনার ক্ষেত্রে সরকারের এটা নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘুদের জন্য যদি প্রকৃত উন্নয়ন করতে চান তাহলে এই ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তিনি দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেন এবং পিছিয়েপড়াদের মন জয়ও করতে পারেন। এই পথেই একটা পিছিয়েপড়া সমাজ আলোর স্পর্শ পাবে – আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মুক্ত চেতনা ও সর্বোপরি সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচিত হবে। মুসলিম ও সংখ্যালঘু সমাজ আলোর দিশারী হবে। এটা বড় প্রয়োজন এই মুহূর্তে।
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমি ও সর্বভারতীয় নিটে চমকে দেওয়ার মতো ফল করছে মিশনের ছাত্র-ছাত্রীরা।
বাংলার বিগত চৌত্রিশ বছর বাম শাসনে দেখেছি ইতিহাস ঘেঁটে সংখ্যালঘুদের চাকরি, শিক্ষা, বাসস্থান ও সামাজিক সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের কোনও চেষ্টাই করেনি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় সংখ্যালঘুদের সংকট বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। জ্যোতি বসুর শাসনকালে মুসলিমদের জন্য চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দাবি তুলেছিলেন জনাব হাসানুজ্জামান। তাতে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘জনাব হাসানুজ্জামান কি মুসলমানদের জন্য কারাগারেও সংরক্ষণ চাইছেন?’
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার জমানায় বলেছিলেন, ‘মাদ্রাসা-মক্তব হল সন্ত্রাসবাদ-এর আখড়া।’ এই চরম অপমানের বদলা বাংলার মানুষ ও সংখ্যালঘু সমাজ ভোটবাক্সে দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা সংখ্যালঘিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বহুগুণে ধ্বংসাত্মক আর শক্তিশালী। সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতি মুসলমানদের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, জওহরলাল নেহরু একথা স্পষ্ট করে লিখেছিলেন। এর সত্যতা বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। গোটা দেশে এই মুহূর্তে সংখ্যালঘু সাংসদ সংখ্যা মাত্র ২৭-এ নেমে এসেছে। ২০১৯ নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেখলাম বিজেপির নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যে একজনও মুসলিম সাংসদ নেই।
দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায় সংখ্যালঘু প্রার্থীদের মধ্যে যারা লোকসভা ভোটে বা বিধানসভা ভোটে জিতেছেন, ভাল কাজ করলেও তাদের অনেককেই প্রার্থী করা হয় না বা আসন বদল করা হয়। ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।
কখনও-বা ঠেলে দেওয়া হয় হেরে যাওয়া আসনগুলিতে। মুসলিম প্রার্থীদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়াও হয় সুচতুরভাবে।
সাধারণ মানুষ কিন্তু রাজনীতির এসব প্যাঁচপয়জার বোঝে না। তারা চায় প্রত্যেক এলাকায় আধুনিক মানের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠুক। যেমন মুর্শিদাবাদ জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার দাবী দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছেন জেলার মানুষ, যা আজও বাস্তবায়িত হয়নি যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খানিকটা হলেও সে দিকে অগ্রসর হতে পেরেছেন। বিল পাশ করেছেন মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু আজও পঠন-পাঠন চালু হয়নি বা অর্থ বরাদ্দও করা হয়নি। এখনও উপাচার্য নিয়োগও হয়নি। তবে কৃষ্ণনাথ কলেজ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিল নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। এর মধ্যেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের মহাসচিব ও উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষা প্রসারে মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেকগুলি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও বেশ কয়েকটি নতুন কলেজ খুলেছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। তবুও বহু জেলাতেই আরও অনেক সাধারণ স্কুল-কলেজ সহ মহিলা ডিগ্রি কলেজ গড়ার প্রয়োজন প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে।
২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে সংখ্যালঘুদের বিপুল সমর্থন পেতে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। এখন দেখার ২০২১ সালের নির্বাচনে কোন দল কীভাবে বাজিমাত করে।
সংখ্যালঘুদের বিপুল সমর্থন পেতে চাইবেন সব দলই। এখন থেকেই এই সংখ্যালঘুদের মন জয়ে সকল রাজনৈতিক দল নানা কৌশলে বাজিমাত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।
বাম-কংগ্রেস ও বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস-এর দিকে থাকা মুসলিম ভোটে থাবা বসাতে চাইছেন। তবে সচেতন সংখ্যালঘু সমাজ সমস্ত অতীত অভিজ্ঞতাকে স্মরণে রেখে যথাযথ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলেই মনে হয়।
বিগত ৩৪ বছর বাংলার মানুষ দেখেছেন সংখ্যালঘুদের সামাজিক সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের কোন চেষ্টাই করেনি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যের ২৩টা জেলায় বামফ্রন্টের পার্টি সম্পাদক আছেন, কিন্তু কোনও মুসলিমকে আজও সম্পাদক পদে বসাতে পারেননি বাম কর্তারা।
বামফ্রন্টের কর্তারা বলেন, তারা নাকি অন্যদের থেকে অসাম্প্রদায়িক। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান পদে কখনও মুসলিম আধিকারিককে বসাতে পারেননি কেন, এই প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয়। এই কালো ইতিহাস বাংলার মানুষ এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন না, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এরই পাশাপাশি আমরা দেখেছি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বিগত বছরগুলোতে কয়েকজনকে জেলা পরিষদের সভাধিপতির আসনেও বসিয়েছেন। এমনকি কলকাতা মহানগরীর মেয়র পদে অধিষ্ঠিত হয়ে জনাব ফিরহাদ হাকিম ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের আস্থা অর্জন করে চলেছেন — বিগত বামফ্রন্ট সরকার যা কখনও ভাবতেই পারেনি।
রাজনৈতিক দলের কর্তারা শুধু ভোটের সময় ভোট লুঠ করতে আর লেঠেল বাহিনী করে মুসলিমদের এবং দলিতদের এগিয়ে দিয়েছে সুচতুরভাবে। মারছে মুসলিম, মরছে মুসলিম। আর মরছে দলিতরা। দেশের ও বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ ভুলে যায়নি তাদের চালাকি ও অত্যাচারের কথা।
অপ্রত্যাশিত দেশভাগের ফলে সাবেক বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজ পশ্চিমবাংলার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। মানসিক অস্বস্তিকাতরতায় আচ্ছন্ন মুসলমান জাতিসত্তা এই সাত দশকের মাঝে এসে কোন অবস্থানে?
স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবাংলায় জীবন বিকাশের সবক্ষেত্রে বিশেষত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে নানা মতাদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের ‘গণতান্ত্রিক সাম্যতাহীন’ নির্লজ্জ স্বার্থসিদ্ধি আর নানাবিধ ধান্ধাবাজির সওয়ালে দাবার বোড়ে হিসেবে অর্থাৎ ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসাবে মুসলমানদের ব্যবহার করেছে। এই নিঃসহায় ধর্মীয় সম্প্রদায়কে মাদারি নাচের উপাদান করে তুলেছে। হরেক কিসিমের কারসাজির উৎসকেন্দ্রকে এক নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে যা স্পষ্ট তা খোলসা করে বলা দরকার। সত্য নির্মম, সেক্ষেত্রে কাউকে রেয়াত করার প্রশ্নই ওঠে না। সে সুযোগও নেই, কেননা কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী এই ধর্মবিশ্বাসী সমাজ ‘সিউডো সেকউলার’, নরম ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের সমস্ত রকমের ফন্দি আর ফিকির অনুধাবনের পূর্ণ ক্ষমতা অর্জন করেছে।
দেশবিভাগের পর তারা অন্তবিহীন সমস্যায় আক্রান্ত, জর্জরিত এবং তার রাজনৈতিক সমাধান কোন পদ্ধতিতে সম্ভব তার তত্ত্বগত, কৌশলগত আর পরিস্থিতি মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরাপারঙ্গম হয়ে উঠেছেন।
তার প্রমাণ তাঁরা দিয়েছেন বিগত দুই বিধানসভা ও ২০১৪ ও ২০১৯ লোকসভা ভোটে।
কোনও ‘ললিপপ’ আজ তাদের তৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট নয়। অতলান্তিক সমস্যা আর অস্তিত্বের সংকটগুলো অতিক্রম করে কিভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁরা থাকবেন তার পূর্ণ একটি ছকও সংখ্যালঘু মনে ক্রিয়াশীল। বিজেপি এনআরসি নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের আস্থা হারিয়েছে। হিন্দু মানুষজন তাদের পাশ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন দ্রুত।
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের দিকে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট বড় ফ্যাক্টর।
বিরোধীরা এই বাংলায় সুবিধাজনক অবস্থায় আসতে চাইলে সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা করে তা সম্ভব হবে না বলেই মনে করি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একমাত্র নেত্রী এনআরসি নিয়ে তিনি কঠোর গলায় বলে দিয়েছেন বাংলাতে তিনি বেঁচে থাকতে এনআরসি হতে দেবেন না।
বিগত বাম শাসনের অহমিকা, ঔদ্ধত্য, ভণ্ডামি আর দুর্নীতির গহ্বরে নিমজ্জিত তৎকালীন তস্কর শাসকগোষ্ঠীর বলির পাঁঠা হতে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন আর আগ্রহী নয়।
বাম জমানায় প্রশাসনিক বদমায়েশি সম্পর্কে নিরন্তর প্রতিবাদী হয়ে-ওঠা সমাজ এখনও সচেতন আছেন। তারা ভুলে যায়নি জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় সংখ্যালঘুদের সংকট চরমভাবে বেড়ে গিয়েছিল। সর্বদিক থেকে তাদের হাতে না মেরে ভাতে মারার সেই সুকৌশল আজও ভোলার নয়। এই চরম অপমানের বদলা বাংলার মানুষ ও সংখ্যালঘু সমাজ ভোটবাক্সে দিয়েছেন। যার ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল বিধান চন্দ্র রায়ের পর একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে সকলকেই চমকে দিয়ে ২১১টা আসনে জয়ী হয়েছিল বিগত বিধানসভা নির্বাচনে।
গোটা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় মিটিং-মিছিল করে জোটের মুখে ঝামা ঘসে ও চুন-কালি মাখিয়ে তাদের পতন সুনিশ্চিত করেছিলেন বাংলার অবিসংবাদি যুবনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষ।
সামনের নির্বাচনে সব দলগুলো সংখ্যা অনুপাতে ৩০ শতাংশ আসনে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিক এই দাবী উঠছে এখন থেকেই।
যেসব ওয়াকফ সম্পত্তি বেদখল হয়ে আছে তা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতেও বর্তমান সরকারকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
উচ্চশিক্ষায় চাকরিতে মুসলমানদের অবস্থান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখছি প্রতিনিয়ত অধ্যাপক, শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমশ কমছেই, এর প্রতিকার হওয়া দরকার। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নজর দিলেই উঠে আসে করুণ চিত্র। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের চাকরি ও অবস্থান নেই বললেই চলে। এই বঞ্চনার অবসান ঘটাতে রাজ্য সরকারকে সঠিক পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নিতে হবে।
তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের জমানায় হাতে-পায়ে ধরে কেউ কেউ সরকারি পদে বসেছেন। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছেন কিন্তু তাদের সরকার বিরোধী কার্যক্রম দেখে তাজ্জব বনে যাই।
আশার কথা, মানবিক চিন্তাচর্চায় যথার্থ আগ্রহী সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মেধাজীবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, সমাজ-রাষ্ট্রচিন্তক, সর্বোপরি আম-জনতার মধ্যে থেকে সচেতন অংশটি বাম শাসনের প্রশাসনিক বদমায়েশি সম্পর্কে নিরন্তর প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘিষ্ঠ সমাজ থেকে উদ্ভূত প্রতিনিধিস্থানীয় সমাজ-বেত্তা, প্রাবন্ধিকদের ভাবনাচিন্তাকেও তুলে ধরেছিলাম আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন ‘কংগ্রেস ও বাম শাসনে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক’ গ্রন্থে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের একটি অংশ, যারা আজও উটপাখির মতো মরুবালিতে মুখ গুঁজে উপেক্ষিত অংশের জাগরণকে স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত, তাদের বোধোদয় হবে এমন প্রত্যাশা করা যায়। বাম শাসনের অবসান ঘটাতে আমরাও এগিয়ে এসেছিলাম। পরন্তু সীমাহীন রাজকীয় ক্ষমতানির্ভর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ঘাড়ে-গর্দানে এক-হয়ে-যাওয়া বামফ্রন্টের রাজাবাবুরা এতদিনে যে সংখ্যালঘিষ্ঠ সমাজাংশের উপস্থিতিকেই স্বীকার করতো না, আজ তারাই বেমক্কা নির্লজ্জভাবে ছুটে যাচ্ছেন সংখ্যালঘুদের কাছে।
সংখ্যালঘুরা চান সমদৃষ্টি সমাজবিকাশ। তারা সময়ের বিচার করে এবং বিপুলভাবে জয় দিয়ে ফিরিয়ে এনেছিলেন মমতা সরকারকে। আগামীতে বঞ্চনার অবসান ঘটাতে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার সঠিক ভাবে কাজ না করলে তাদেরকেও সাধারণ মানুষ ভোটবাক্সে জবাব দিয়ে দেবেন। তাই সাধু সাবধান।
তবে বহু ক্ষেত্রে রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়ে দিয়েছেন বৈষম্য না করে উন্নয়ন করা যায়। তাই উন্নত, ঐক্যবদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল ভারত গড়ার লক্ষ্যে বাংলার ৪২টা লোকসভা কেন্দ্রে প্রকাশ্য জনসভা করেছেন বাংলার জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচনী ভোট প্রচারে তাঁর জনসভা গুলো জনসমুদ্রের আকার নিয়েছিল। কিন্তু মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়ে কী পাপ করেছিল তা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন। এনআরসি নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে বিজেপি বাংলায় দ্রুত মাটি হারিয়ে ফেলছে।
গণতন্ত্র ও সংবিধান আজ বহু রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচাতে দেশের সাধারণ নাগরিকদের আরও সচেতন হয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে হবে। ইভিএম কারচুপি রুখে স্বচ্ছ সরকার উপহার দিতে জনসাধারণকে আরও সচেতন হতেই হবে। ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সঠিক নেতা তৈরিকরতে হবে তার জন্য।
দেশের সুনাগরিকগণ আগামীতে ভালবাসার দেশকে রক্ষা করতে সঠিক পদক্ষেপ নেবেন এই আশায় আমরা। বাংলাতে এনআরসি নিয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার আতঙ্ক দূর করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাই মহান কান্ডারী হতে পারবেন কিনা তা সময় বলবে।
লেখক : সম্পাদক-প্রকাশক উদার আকাশ।
কথা: ৯৭৩৩৯৭৪৪৯৮/ ৭০০৩৮২১২৯৮