আমি এবং ইবলিশ’ : ব্যর্থ প্রেমের উদভ্রান্ত পাণ্ডুলিপি

0
1265
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:14 Minute, 24 Second

আমি এবং ইবলিশ’ : ব্যর্থ প্রেমের উদভ্রান্ত পাণ্ডুলিপি

অনামিকা নন্দী

ইবলিশ মানে শয়তান। অন্তত ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মমতে। তাই সখ করে কোনও অভিভাবক নিজের সন্তানের নাম ইবলিশ রাখেন না। কেউ অবশ্য নিজের ছদ্মনাম ইবলিশ রাখতে পারেন। সেই দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। সাহিত্যিক সৈয়দ মোস্তাফা সিরাজ তাঁর সাহিত্যজীবনের কৈশোরকালে নিজের ছদ্মনাম রেখেছিলেন ইবলিশ। ‘কবিপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক, তথা গত শতাব্দীর ষাটের দশকের ‘কবিদের কবি’ প্রভাত মুখোপাধ্যায় নিজের একটি উল্লেখযোগ্য দীর্ঘ কবিতার নাম রেখেছেন ‘ইবলিশের আত্মদর্শন’। মোস্তাফা সিরাজ ও প্রভাত মুখোপাধ্যায় দু’ জনেই আজ প্রয়াত। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত তৃতীয় বারের মতো ইবলিশ নামের দখলদারি দেখা যায় বহরমপুরের জিনাত ইসলামের ৬৪ পাতার কাব্যগ্রন্থে। আসলে গ্রন্থটির নামই ‘আমি এবং ইবলিশ’। লেখক ছত্রে ছত্রে জানিয়েছেন, এই ‘ইবলিশ’ আসলে এই ‘আমি’র প্রেমিক।

ফারুক আহমেদের ‘উদার আাকাশ’ নামের প্রকাশনা সংস্থা থেকে কাব্যগ্রন্থটি ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশের ৭ বছর পর গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনার খায়েস স্বাভাবিক বিচারে স্বাভাবিক হতে পারে না। আলোচনার এই ব্যতিক্রমী ইচ্ছার একটি ঐতিহাসিক সূত্র আছে। আলোচ্য গ্রন্থের দ্বিতীয় ‘১৩’ সংখ্যক (লেখার ব্যতিক্রমী ফর্ম অস্বীকার করলে সেটি ২৬ সংখ্যকও বলা যায়।) লেখাটিতে রয়েছে মোট ১১টি পঙক্তি। সেই লেখার শেষ দুটি পুঙক্তি, “বাঁচার নেশায় নয়নাভিরাম নষ্টেন্দুকলার আশা/ ব্যর্থ জীবন ইবলিশ তোমার রোবাইয়াৎ ছাড়া”। কবি কাজি নজরুল ইসলামের অনুবাদ সাহিত্য থেকে আমবাঙালি ‘রোবাইয়াৎ’ শব্দের সঙ্গে সবিশেষ পরিচয় লাভ করে।

নজরুলের অনুবাদ করা ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ সৈয়দ মুজতবা আলির ভূমিকা-সহ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। এই কালজয়ী গ্রন্থের লেখক পারস্যের মহাকবি ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১)। এই মহাগ্রন্থটি সারা বিশ্বের পাঠক সমাজে আদৃত হয় সৃষ্টির প্রায় সাড়ে ৭০০ বছর পর। মহাকবির মৃত্যুর ৭২৮ বছর পর রুবাইয়াৎগুলো নজরে পড়ে ইংরেজ সাহিত্যের বিশিষ্ট সমালোচক এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের। তিনি ১৮৫৯ সালে সেগুলো ইংরেজিতে ভূমিকা-সহ অনুবাদ করলে সারা বিশ্ব চমকে উঠে। সৃষ্টির সাড়ে ৭০০ বছর পরে কোনও সৃষ্টির সমালোচনা লেখার মহৎ ইতিহাস থাকায় ৭ বছর পর কোনও ‘অখ্যাত’ লেখার সমালোচনা করা বেকুফ কাজ হবে না বলেই মনে করি। বলে রাখা ভাল, সমালোচনা মানে নিন্দামন্দ কথা নয়। সমালোচনা মানে সম-আলোচনা। ভালমন্দ সবদিক খতিয়ে দেখে সমবিচারের দৃষ্টিতে আলোচনা করা।

নিজস্ব কর্মের জগৎ, আদর্শবাদ, পরিবার ও প্রতিবেশ কবির মনোভঙ্গী গঠনে অনেকটা ভূমিকা পালন করে থাকে। কবির কাব্যকর্ম বুঝতে সাহায্য করে এই সব। এই গ্রন্থ থেকে লেখক সম্পর্কে সে রকম কোনও ইঙ্গিত পাওয়ার সহজপথ নেই। মলাটের শেষ পাতায় কবি লিখেছেন, “বই শেষ। আমারও এইটি শেষ কবিতা বোধহয়। আসলে লেখার অনুপ্রেরণার মানুষটিই আর নেই। না, বেঁচে আছে। অন্য কোথাও, অন্য মানুষের হয়ে।” তিনি ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘ইবলিশ’ অংশে তাঁর পলাতক প্রেমিক সম্পর্কে লিখেছেন, “ইবলিশ আসলে পুরুষের প্রতিনিধিত্বকারী এক চরিত্র।” যে পুরুষ তাঁর কাছে ‘গৌতম বুদ্ধের মতো এসকেপিস্ট’। আবার ‘নারীর বড় আদরের’ও। পরের পাতায় ‘আমি’ অংশে কবি লিখছেন, ‘এই আমি আসলে কে? একটি আধুনিক মেয়ে। … ভালেবাসা তাঁর কাছে জল যেমন জীবন, তেমন। স্বাধীনতা তাঁর কাছে নিঃশ্বাস। প্রেম ছাড়া সে নিঃস্ব, কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া সে মৃত।”

এই কবি তাঁর প্রেমিকের স্বাধীনতায় কতটা বিশ্বাসী, কতটা শ্রদ্ধাশীল তার কোনও উল্লেখ নেই গ্রন্থের কোথাও। মানে, কবি কি একাই স্বাধীনতা পেতে আগ্রহী? পুরুষটির, মানে তাঁর প্রেমিকের স্বাধীনতার কোনও অধিকার থাকবে না? থাকলে কেমন থাকবে সেই স্বাধীনতা? সেই স্বাধীনতা কতটুকুইবা থাকবে? কাব্যগ্রন্থে তা অনুল্লিখিত। বৈষ্ণব সাহিত্যের রাধার মতো এই ‘আমি’ প্রেমে পাগল। কিন্তু রাধিকার মতো প্রেমসর্বস্ব নন। তিনি স্বাধীনতাসর্বস্ব। এই স্বাধীনতার রং রূপ স্বাদ কেমন তার পরিচয় গ্রন্থে মেলে না। দেহসর্বস্ব ‘নারীবাদ’- এর স্বাধীনতা? নাকি মানুষের সব মানবিক গুণের সমাহারের মর্যাদার দাবিদারের স্বাধীনতা? কোনটা এই কবির জীবনবোধ? এই গ্রন্থে তা পরিস্ফুট নয়। আসলে ‘আমি’ নিজেই জানেন কি, তিনি কি চান?

গ্রন্থের শুরুতেই ৫ নম্বর পাতায় জিনাত লিখছেন, “… পাহাড় প্রমাণ অসফল জীবনে সব দায় আমি সেই ফেলে আসা ইবলিশের কাঁধে তুলে দিই বা নিজের নির্বুদ্ধিতাকে অকাতরে শাপসাপান্ত করে ক্ষান্ত হই, তখন বুঝতে পারি ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে আমি কত অসহায়!” এই পাতার আত্মকথনের শেষ তিন লাইনে কবি বলছেন, “স্মৃতিচারণার জীবনজোড়া এই অধ্যায়ের নাম ‘আমি’ আর ‘ইবলিশ’, সেই মানুষ যার কোনো বিকল্প নেই… যে জীবনে একবারই আসে, একবারই হারায়, একবার… শুধুই একবার।” গ্রন্থের শেষ কবিতায় তিনি লিখছেন,

“ইবলিশ তুমি

সততঃ সত্য, আহ্নিক অঞ্জলির ফুল চন্দন

আর ব্রহ্মার মতো এক, অদ্বিতীয় শ্বাশত অবিনশ্বর

ত্রিকালজয়ী ঈশ্বর আমার তুমি

হোমের আগুনের চেয়ে নির্মল পবিত্র ……

পুনরুত্থানের অপেক্ষায়/ পুনরুত্থানের অপেক্ষায়।”

এই প্রেমিক, এই পুরুষ, এই ইবলিশ ‘নারীবাদী’ কবির কাছে কখনও ‘বাসনা-কামনা-লালসায় পীড়িত/ এক কীট’ (২৪ পৃষ্ঠা), কখনও ‘নারীর প্রতি অবিচারের ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগে তুমি নির্ভীক, পক্ষপাতদুষ্ট, নির্দয়’ (২৩ পৃষ্ঠা), কখনও ‘হে অন্তর্যামী মুগ্ধ ছিলে ৭টি বছর নারীঅঙ্গ উপবনে/ চেটেপুটে করেছ ভোগ উদ্দাম আগ্রাসনে”। এ রকম এক পাক্ষিক অভিযোগে গ্রন্থ ভর্তি। ইবলিশই কেবল চেটেপুটে উপভোগ করেছে? ৭টি বছরে প্রেমকাতর ‘আমি’ কখনও উপভোগ করেনি? ১১ পাতায় পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন’-এর নন্দিনী-শুভঙ্করের প্রসঙ্গ এসেছে। সেই সুবাদে বলা যায়, ‘কথোপকথন’ কাব্যগ্রন্থের শৈলিতে ‘আমি এবং ইবলিশ’ কাব্যগ্রন্থটি রচিত হওয়ার সমূহ সম্ভবনা ছিল। সেই সুন্দর সম্ভবনাকে কবি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সযত্নে বধ করেছেন ‘আমি’র আত্মসর্বস্বতাকে ধামাচাপা দেওয়ার তাগিদে। আত্মপ্রতারণায় মগ্ন থেকেছেন শিল্পী। এ আসলে রক্তালপ্তায় ভুগতে থাকা অপুষ্ট নারীবাদের বেপথে গমন। এই গ্রন্থে কোনও কবিতার কোনও নাম দেননি কবি। সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করেছেন। ‘১’ থেকে ‘২৫’ পর্যন্ত প্রতিটি সংখ্যায় জোড়া জোড়া কবিতা। কথোপকথনের আদলে লেখা বলে প্রথম নজরে বিভ্রম সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভবনা আছে। আসলে অবশ্য এই গ্রন্থ ‘কথোপকথন’- এর আদলে লেখা নয়।

ডান দিক ও বাঁদিক— উভয় দিকের দুটি পাতারই কথক কেবলই একজন। তিনি ‘আমি’। ইবলিশকে কোনও কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। হলে সুবিচার করা হত। কবিতার চলন একপেশে হত না। এই একপেশে কষ্ট ও দুঃখের কথা বলতে গিয়ে কবি উদভ্রান্তের মতো মাঝে মাঝেই স্ববিরোধিতায় ভুগেছেন। দ্বিতীয় ‘২’ এবং প্রথম ‘৪’ এর মতো বেশ কিছু কবিতা সাবলীল। সেখানে সুন্দর চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছে। ‘হ্যালোজেন সুন্দরী’র মতো চিত্রকল্পময় বেশ কিছু সুন্দর শব্দও কবি সৃষ্টি করেছেন, পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। ‘১৮’ কবিতায় “নদীর বুকে জেগে আছ চর হয়ে তুমি ইবলিশ/… তোমার সথে আমার দেখা ময়ুরপঙ্খীঘাটে”— এই পুঙক্তি দুটি জানিয়ে দেয়, কবি যেখানে সহজ, কাব্যভাষা সেখান জলের মতো সাবলীল ও বাউলের মতো সুন্দর।

আবার কিছু শব্দ প্রয়োগ কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত। ‘১৪’ নম্বরের প্রথম কবিতাটি প্রায় মাটি হয়ে গিয়েছে ‘কুন্দদন্তী’ ও ‘আয়স্কম্কন’- এর মতো কষ্টকল্পনাজাত কিছু প্রক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহারে। কিছু ক্ষেত্রে ছন্দপতন ঘটেছে। ভুল বানান ও যতি চিহ্নের যথেচ্ছ ব্যবহারের সীমা না থাকলেও কবিকৃত প্রচ্ছদটি ভারি সুন্দর। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত রঙের পরিমিত বোধ, রঙের স্বাদ কবিতার বিষয় ভাবনায় ও শৈলিতে ব্যবহৃত হলে অপুষ্টিতে আক্রান্ত নারীবাদের একপাক্ষিক কানাগলিতে জিনাত ইসলামকে উদভ্রান্তের মতো ঘুরপাঁক খেতে হত না। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক প্রেক্ষপটের কারণে ওপার বাংলার মুসলমান পরিবারের মহিলাদের তুলনায় এ পার বাংলার মুসলমান পরিবারের মহিলাদের লড়াই সংগ্রামের প্রেক্ষিত কিছুটা ভিন্ন। সেই প্রেক্ষিত মনে রাখলে জিনাত ইসলামের এই কাব্যপ্রয়াস উৎসাহব্যঞ্জক বটে। প্রকাশকও সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন।

গ্রন্থটি লেখক তাঁর ‘জীবনের দুই অসামান্য নারী বেগম রোকেয়া ও আমিনা বিবি’র নামে উৎসর্গ করেছেন। আমিনা সম্ভবত খ্যাতনামা কেউ নন। প্রথম নামটি ২০০৪ সালে বিবিসির পাঠকের বিচারে ষষ্ঠতম অনন্য বাঙালি হলে, নামটি হবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি নিজে বেগম ব্যবহার করতেন না। ইবলিশের স্বার্থপরতা বোঝাতে জিনাত ইসলাম তাঁর ব্যর্থ প্রেমের কবিতায় অনেকবার সুরা ও শাকী ব্যবহার করেছেন। মহাকবি ওমর খৈয়ামের রুবাইয়া তো কেবল সুরা ও শাকী দিয়ে আদ্যপ্রান্ত মোড়া এক জীবনবোধ। তাই তিনি সমকালের গোড়াতন্ত্রের কাছে ছিলেন প্রচণ্ড এক শয়তান। ইবলিশ। কবি কাজি নজরুল ইসলাম অনূদিত হাজার বছর আগের আগের সেই ইবলিশের ৩০ নম্বর রুবাইয়াতে শাকী ও সুরার ব্যবহার চিনিয়ে দেয় কবিকর্মের জাতপরিচয়।
“প্রমিকারা সব আমার মতো মাতুক প্রেমের মত্ততায়,
দ্রাক্ষা-রসের দীক্ষা নিয়ে আচার-নীতি দলুক পা’য়।
থাকি যখন সাদা চোখে, সব কথাতেই রুষ্ট হই,
শরাব পিয়ে দিল-দরিয়া উড়িয়েদি ভয়-ভাবনায়।”
পণ ভেঙে জিনাত ইসলাম আবার কবিতা লিখুক। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, বর্তমানের দুর্বলতা কাটিয়ে আরও সহজ-সরল-সুন্দর কবিতা লিখুক। পাঠক হিসাবে সেই কামনা করতেই পারি।

আমি এবং ইবলিশ
জিনাত ইসলাম
উদার আকাশ
ঘটকপুকুর, ভাঙড়,
দক্ষিণ ২৪ পরগনা-৭৪৩৫০২,
মূল্য ৮০.০০

News Source: Faruue Ahamed Editor Udar Akash

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD