ছোটোগল্প – দোষ কথা

0
787
Law
Law
0 0
Azadi Ka Amrit Mahoutsav

InterServer Web Hosting and VPS
Read Time:13 Minute, 1 Second

(ছোটোগল্প )

দোষ কথা

হীরক মুখোপাধ্যায়

“বিয়ের দু’বছরের মধ্যেই আপনার স্ত্রী-র আত্মহত্যা সংক্রান্ত মামলায় উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনার পর, ভারতীয় দণ্ডবিধি-র ৩০৪ বি ধারা অনুযায়ী আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে, এবিষযে আপনার কিছু বলার আছে ?”  আসনে বসে সূর্য্য ভটচাজের কাছে জানতে চাইলেন বারাসাত জেলা ও দায়রা আদালতের এক বিচারক।

বিচারকের কথা কানে আসতেই বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে সূর্য্য ভটচাজ স্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন, “আপনার রায় আপনি আপনার কাছেই রেখে দিন, ও রায় আমি শুনতেও চাইনা মানা তো অনেক পরের কথা।”
ভরা এজলাসে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে ওঁনারই মুখের উপর নির্লজ্জ অভিযুক্তের মতো কটকট করে কথা বলার দুঃসাহস দেখে চমকে উঠলেন আদালত কক্ষে উপস্থিত সমস্ত আইনজীবী ও পুলিস কর্মচারীরা।

ছোটোবেলা থেকে বাবার পাশে বসে বসে পুজোপাঠ করতে শিখেছিলেন দিলীপ ভটচাজের ছেলে সূর্য্য ভটচাজ। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বছর পনেরো ধরে এখন নিজেই বাবার সমস্ত যজমানদের বাড়ির পুজোপাঠ, শ্রাদ্ধ, শান্তি স্বস্তায়ণের কাজ সামলাচ্ছেন উনি।
বছর দুয়েক আগে সূর্য্য-র বিয়ে হয় ছায়া-র সাথে, পুলিসি বিবরণ অনুযায়ী, কয়েকমাস আগে ছায়াদেবী আত্মহত্যা করেন। মামলা শুরু হওয়ার পর থেকে এতদিন ধরে সবপক্ষের সকল বক্তব্য শুনে আজ সূর্য্য ভটচাজকে দোষী সাব্যস্ত করতে গিয়েই বিচারক ওই কথা বলছিলেন।

“এই রায় না মানলে, আপনাকে উচ্চ ন্যায়ালয়ে আবেদন করতে হবে,” গম্ভীরভাবে বললেন বিচারক।
“সাজাটা একটু কম করুন জজসাহেব, তাহলে অসুবিধা হবেনা।”
“পুরোহিতমশাই, এটা আপনার দোষ কাটাবার ফর্দ নয় যে লিস্ট থেকে নিজের ইচ্ছায় কিছু কমানো বা বাড়ানো যাবে।” 
“সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু ক’পাদ বা ক’পো দোষ লেগেছিল সেটা আর একবার বলুন শুনি ?”
“দোষ তো অনেকই লেগেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৩০৪ বি-তে এসে ঠেকেছে,” গম্ভীর মুখে বললেন বিচারক।
“না না ওসব কথা বললে হবেনা। আমি এক পো থেকে চার পো দোষ সম্পর্কে সবকিছু জানি, আর ওই দোষগুলো আমি কাটাতেও পারি; কিন্তু ৩০৪ না কতো পো যেন বললেন সেই দোষের কথা আমি বাপের জন্মেও শুনিনি !”
“আপনাদের ধর্মশাস্ত্রে কী লেখা আছে সেটা তো আমি পড়িনি, কিন্তু আমি আপনাকে যা বলছি সেটা আমাদের আইনশাস্ত্রের পুঁথিতে মোটা মোটা করে লেখা আছে।” গম্ভীর গলায় বললেন বিচারক।
“ওসব নিয়ে ভেবে ভেবে একদম রক্তচাপ বাড়াবেন না জজসাহেব, ওতে শরীর খারাপ করে; সুগার বেড়ে যায়। সুগার বেড়ে গেলে জীবন থেকে সুখ শান্তি সব চলে যায়, এমনকি স্ত্রীও সঙ্গসুখে বঞ্চিত হয়ে কটুবাক্য প্রয়োগ করে।
আবার স্ত্রী কুপিত হলে প্রথমে বাপেরবাড়ি এমনকি পরে পরপুরুষের বাড়িতেও চলে যেতে পারে…।
সব বইতেই ওরকম অনেক নিদানের কথা লেখা থাকে। আমাদের ধর্মশাস্ত্রেও তো লেখা আছে, প্রত্যেক অনুষ্ঠানে নতুন বস্ত্র, তৈজসপত্র লাগবে। ওসব জেনেও আমি তো যজমানের সুবিধার জন্য এক যজমান বাড়ির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান থেকে পাওয়া গামছা আর এক যজমানের বিয়ের সময় তাঁর হাতের উপর রাখি।
একটু এদিক ওদিক করতেই হয়। নইলে ব্যবসা টেকে না। আপনিও ওরকম একটু করুন জজসাহেব, নইলে আমাকে তো জেলে যেতে হবে।”
“কী মুশকিল ! করেছি তো, এই মামলায় আপনার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ার কথা। আমি আপনার কথা ভেবে ওটাকে কমাতে কমাতে ৭ বছর রাখার কথা ভেবেছি। এর পর আমাকে আর সাজা কমানোর অনুরোধ করবেননা পুরোহিতমশাই।” বিচারকের আসন থেকে জোড়হাত করে বললেন বিচারক।

ভরা আদালত কক্ষের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের যজমান রূপী বিচারকের মুখ থেকে তাঁর অপারগতার কথা শুনতে শুনতে একসময় ধৈর্য্যর বাঁধ ভেঙে গেল সূর্য্য ভটচাজের।
উনি চেঁচাতে শুরু করলেন, “বছর দুয়েক আগে আপনার বাবা মারা যান। মৃত্যুকালে তিনি বার দোষ না পেলেও তিথি ও নক্ষত্র দোষ পেয়েছিলেন। শাস্ত্র বিধান অনুযায়ী, তিথি দোষে এক পাদ ও নক্ষত্র দোষে দ্বিপাদ দোষ মিলিয়ে তিনি মোট ত্রিপাদ বা তিন পো দোষ পেয়েছিলেন।
সেজন্য আমিও তখন আপনাকে ওই ৩ পো দোষের নিদান দিয়েছিলাম।
সেদিন আমি আপনাকে বলেছিলাম, কারো দুই পো দোষ লাগলে ‘পঞ্চাঙ্গ স্বস্তায়ণ’ করলেই হয়, কিন্তু তিন পো দোষ পেলে শ্রাদ্ধশান্তি-র সাথে সাথে পিতৃতর্পণ, রুদ্রাভিষেক, নক্ষত্রপূজা, মহামৃত্যুঞ্জয় জপ ও যঞ্জ এবং এর সাথে পঞ্চাঙ্গ শান্তি স্বস্তায়ণ মতে চণ্ডীপাঠ, দুর্গামন্ত্র জপ, পার্থিব শিব পূজা, নারায়ণকে তুলসি দান ও মধুসূদনমন্ত্র জপ করতে হয়, না হলে তিথি দোষের জন্য গোধন ও নক্ষত্র দোষের জন্য গোত্র নাশ হয়।
আপনার বাবা যেহেতু বুধবার মারা গিয়েছিলেন সেহেতু বার দোষ না পেলেও তাঁর মৃত্যুদোষ ছিল মরলোক বা মর্ত্যলোকগামী। কোনো জাতক ত্রিপাদ দোষ পেলে সেই বাড়িতে শান্তিতে একবছরও থাকা যায় না। তাই আপৎকালীন ভিত্তিতে সবার আগে যেমন দোষ কাটানোর দরকার, তেমনই বাৎসরিক শ্রাদ্ধশান্তির পরেই বাড়িতে দক্ষিণাকালী পূজা করাও সবিশেষ প্রয়োজন।
আমার সেই নিদানের জন্য আজ আপনি সবার সামনে আমাকে ৩০৪ পো দোষের ছুতো দেখিয়ে ৭ বছরের জন্য জেলে পাঠাতে চাইছেন !
সেদিন আপনি যেমন ধর্মশাস্ত্রের রায়কে উপেক্ষা করেছিলেন, ঠিক সেভাবে আজ আমিও আপনার আইনশাস্ত্রের রায়কে উপেক্ষা করে বলছি- ওসব বুজরুকি রায় আমি মানিনা।”

নিজের এজলাসে বসে অপরাধীসম এক ব্যক্তির মুখ থেকে এহেন অযৌক্তিক কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বিচারক। গম্ভীর গলায় উনি পাবলিক প্রসিকিউটরের কাছে জানতে চাইলেন, ” ওঁনার আইনজীবী কে আছেন ?”
বিচারকের কথা শুনে আদালত কক্ষের ভেতর থেকে হাড় জিরজিরে এক আইনজীবী উঠে বললেন, “আমি আছি সাহেব।”
অভিযুক্তের আইনজীবীকে দেখতে পেয়েই ওঁনার দিকে খর চোখে তাকিয়ে বিচারক বললেন, “আপনার মক্কেলকে বোঝান, ওভাবে দোষ কাটাবার কোনো ব্যবস্থা এই আদালতে নেই..ওই ব্যবসা আমরা করিওনা।”
“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু স্যার, এই মুহুর্তে সূর্য্য ভটচাজের তরফে আমার একটা ছোট্ট আবেদন আছে।”
“না, না, এসব আবার কী আবদার। আপনি ভালোভাবেই জানেন উভয়পক্ষের সমস্ত বক্তব্য শোনার পরেই আজ অভিযুক্তকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হচ্ছে, এখন আপনার আর কোনো আবেদনই গ্রাহ্য করা হবেনা।”
“কিন্তু এই আবেদন আপনি গ্রহণ না করলে প্রকৃত দোষী যে অধরাই থেকে যাবে স্যার !”
“কী যা তা কথা বলছেন উকিল সাহেব..” স্পষ্টতই বিরক্তি ঝরে পড়ল বিচারকের গলা দিয়ে।
“আপনার কথা মতো আমি সূর্য্য ভটচাজকে নতুন করে কী আর বোঝাব সাহেব…, আপনিই বলুন না; কারো চোখের সামনে তাঁর মৃত ঘোষিত বিবাহিত স্ত্রী জলজ্যান্তভাবে বসে থাকলে সে কী আর কোনো বিচারকের কোনো রায়কে তোয়াক্কা করে !”
“কী বলছেন ! পাগল হয়ে গেলেন নাকি ?” চোখ গোল গোল করে জানতে চাইলেন বিচারক।
“এখনো পুরোপুরি পাগল হইনি, তবে মনে হচ্ছে হতে আর বেশি দেরী নেই ! ধর্মশাস্ত্রকে অমান্য করে ধর্মের নজরে আপনি দোষী, না আইনশাস্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আইনের নজরে ভটচাজমশাই দোষী নাকি প্রকৃত সত্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দিয়ে মিথ্যার ব্যাবসা করার জন্য সামাজিকভাবে অন্য কেউ দোষী সেই কথা ভেবেই এখন আমরা আঁতকে উঠছি।
আইনের এই মহান পীঠস্থানে আইনের সমস্ত কলকব্জাকে অকেজো করে ধর্মের কল যে কীভাবে মাথা চাড়া দিয়ে বাতাসে নড়ে উঠলো, নিজের চোখে সেটা দেখেই আমি ও আমার সহকারীগণ একেবারে হতবাক হয়ে গেছি স্যার..।”
“কী হেঁয়ালি করছেন !” রাগে গরগর করতে করতে বললেন বিচারক।
“বিশ্বাস করুন স্যার, আমি এবং আমরা এখন স্পষ্টতই হতবাক, মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমার এতদিনের পেশাজীবনে কোনোদিন এইরকম বৈচিত্র্যময় মামলা দেখিনি !”
“পরিস্কার করে বলুন কী হয়েছে ?” অবাক হয়ে জানতে চান বিচারক।
“আর বলবেননা..! আপনি যখন সূর্য্য ভটচাজের সাথে কথা বলছিলেন, তখন এক মহিলা আদালত কক্ষে আমার সাথে দেখা করে নিজেকে সূর্য্য ভটচাজের স্ত্রী ছায়াদেবী বলে দাবী করেছেন। উনি জানিয়েছেন ‘উনি মরেননি, এখনো জীবিতই আছেন’।
এই মহিলার কথা শুনে আমি বা আমরা নিজেরাই এখন বুঝতে পারছি না দুই বছর আগে ছায়াদেবী আদপেও মারা গিয়েছিলেন না জীবিত ছিলেন ! জীবিত থাকলে এতদিন ছায়াদেবী কোথায় ছিলেন, কার কাছে ছিলেন, কীভাবে ছিলেন, ইনি যদি আসল ছায়াদেবী হন, তাহলে সেইদিন কাকে সৎকার করা হয়েছিল, আর তিনি যদি আসল ছায়াদেবী হয়ে থাকেন তাহলে ইনি কে ?”

আজ বিচারালয়ে আসার আগে বিচারক ভেবেছিলেন সূর্য্য ভটচাজ বনাম ছায়াদেবীর পরিবার-এর মামলাটা ইতি টেনে দিয়ে তিনি বিড়লা তারামণ্ডলে গিয়ে সৌরমণ্ডলের বর্তমান অবস্থাটা একটু দেখে আসবেন।
কিন্তু বাড়ি থেকে বেরবার সময় ওঁনার ধর্মপত্নী পিছু ডাকতেই উনি বুঝেছিলেন, সামনে সমস্যা আসছে। কিন্তু তাঁর এজলাসে বিনা নোটিশে যে এভাবে ধূমকেতুর আগমন হবে সেটা তিনি ভুলেও ঠাওর করতে পারেননি।

মামলার রায় ঘোষণার আগের দিন মামলার মোড় ঘুরে যাওয়ার ঘটনায় বিরক্ত হয়ে ছায়াদেবী-কে হোমে পাঠাবার আদেশ দিয়ে সেদিনের মতো মামলা মুলতবি ঘোষণা করে রাগে গরগর করতে করতে এজলাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন বিচারক।

About Post Author

Editor Desk

Antara Tripathy M.Sc., B.Ed. by qualification and bring 15 years of media reporting experience.. Coverred many illustarted events like, G20, ICC,MCCI,British High Commission, Bangladesh etc. She took over from the founder Editor of IBG NEWS Suman Munshi (15/Mar/2012- 09/Aug/2018 and October 2020 to 13 June 2023).
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Advertisements

USD





LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here